ডিজিটাল অর্থমন্ত্রীর ডিজিটাল পাগলামি

আমিন বরিশালি
Published : 14 Feb 2012, 04:19 PM
Updated : 14 Feb 2012, 04:19 PM

বয়োজ্যেষ্ঠ অর্থমন্ত্রীকে নিয়ে মহাজোট সরকার মহাবিপদে পড়েছে দেখছি। ঘরে-বাইরে আগুন লাগার দশা হয়েছে। শেয়ারবাজার, মুদ্রাবাজার, অর্থনীতি সেই যে গহীন খাদে পড়েছে—শুধু অতলে তলিয়েই যাচ্ছে। এখন আর এই চোরাবালি থেকে টেনে তোলা সম্ভব নয়। অর্থ মন্ত্রণালয়, মন্ত্রীর দফতর সিলগালা করে দেয়াই উত্তম।

অর্থমন্ত্রীকে নিয়ে শেয়ারবাজারের স্লোগান, পোস্টার—পত্র-পত্রিকার পাঠক কলামে যা বলা ও লেখা হচ্ছে, তা রীতিমত বে-ইজ্জতি কারবার। তার ওপর সরকারি দলের এমপিরাও সংসদে আগুন হয়ে উঠেছেন। আর দশচক্রে ভগবান ভূতের মতো অর্থমন্ত্রীও আবোল-তাবোল বকতে শুরু করেছেন। ৩১ জানুয়ারি তিনি সংসদে বললেন, আমরা এখন অর্থনৈতিক দিক থেকে কালো ছায়ার মধ্যে রয়েছি।

এদিন তার চোখে ছানি পড়েছিল কি-না কে জানে। কেননা পরদিনই কালো ছায়া কেটে গেল। ১ ফেব্রুয়ারি তিনি বললেন, অর্থনীতিতে কোনো সঙ্কট নেই। দেশ খুব ভালো চলছে। ১৬ কোটি মানুষের ক্ষোভ, কষ্ট ও প্রতিক্রিয়াকে বোগাস, রাবিশ ও ফালতু বলে আখ্যা দিয়ে অর্থমন্ত্রী এরই মধ্যে অতি সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। দেশের কোথাও তিনি কোনো সমস্যা দেখেন না। খালি দেখেন উন্নতি। স্বাধীনতার পর এখন অর্থনীতির সবচেয়ে সুসময় চলছে—দাবি করেও লোক হাসিয়েছেন তিনি।

ডলারের দাম ৭০ থেকে ৮৫/৮৬ টাকা হলো। সমস্যা দেখেন না তিনি। মূল্যস্ফীতি এক লাফে ১১.৫৯ শতাংশ বাড়লেও তার দৃষ্টিতে তা সুলক্ষণ। ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি-অবনতির চমকদার বিজ্ঞাপন—শেয়ারবাজার চোরাবালিতে তলিয়ে গেলেও তিনি চিন্তিত নন।

তারপরও না হয় একদিনের জন্য তিনি 'কালো ছায়া' দেখার ভ্রম করেছিলেন। আবার পরদিনই তোতা ময়না পাখি হয়ে গেলেন। এ কি বয়স ভারের বিভ্রম, না-কি অন্য কিছু।
সম্প্রতি তিনি সিলেটে বলেছেন, পদত্যাগ করার অভ্যাসটি তার রয়েছে। খুবই রাশভারি কণ্ঠে বললেন। ভাবখানা দলের ভেতরে-বাইরে, সংসদে- মাঠে-ময়দানে এইসব কটু মন্তব্য না থামালে পদত্যাগ করে তিনি মহাজোট সরকার ও জোটকে মহাবিপদে ফেলে দেবেন।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত স্বাধীনতা-উত্তর এ যাবতকালের শ্রেষ্ঠতম অর্থমন্ত্রী (তার ভাষায়) হওয়া সত্ত্বেও পদত্যাগের কথা কেন ভাবছেন?
মনে হচ্ছে জটিল অর্থনীতির দেখভালের ফাঁকে তিনি পত্র-পত্রিকাতেও নজর দিচ্ছেন। ৭ ফেব্রুয়ারির আমার দেশ-এর নাগরিক প্রতিক্রিয়া পাতায় কয়েকশ' বিশিষ্ট নাগরিক অর্থমন্ত্রীর কীর্তিকাণ্ড মূল্যায়ন করেছেন।
এই মূল্যায়নের সারসংক্ষেপ হলো অর্থমন্ত্রী পাগলের প্রলাপ বকছেন। তার উচিত ক্ষমতা ছেড়ে জনগণকে মুক্তি দেয়া। তিনি গবু রাজার হবু মন্ত্রী। ডিজিটাল সরকারের ডিজিটাল অর্থমন্ত্রী। ডিজিটাল অর্থহীন কথা। ডিজিটাল তাচ্ছিল্য সরকারের পতন-পূর্ব পাগলামির ডিজিটাল লক্ষণ। অর্থমন্ত্রীর কথায় কথায় 'ইংরেজিপ্রীতি'কে অনেকে বলছেন চরম দুর্দশাগ্রস্ত অর্থনীতিকে আড়াল করতে ভেজাল ইংরেজির চতুরতা। অনভিজ্ঞ অর্থমন্ত্রীর উদ্ভট বক্তব্যের জন্য অর্থনীতির এই বেহাল।

সংসদেও কথার তুবড়ি ছুটছে। তোফায়েল আহমেদ বলেছেন আর নীরব বসে থাকা যায় না। ৮ হাজার পয়েন্টের শেয়ারবাজার কীভাবে ৩ হাজার পয়েন্টে নামল। লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে শত শত কোটি টাকা নেয়া হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ নিঃস্ব। বিনিয়োগকারীদের পুলিশ দিয়ে পেটানো হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সমন্বয়হীন। হাসানুল হক ইনু বলেছেন, শেয়ারবাজার কারসাজির হোতাদের জেলে পোরা হচ্ছে না কেন। রাশেদ খান মেনন বলেন, পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। বিরোধী দলবিহীন সংসদে ট্রেজারি বেঞ্চেই চলছিল অর্থমন্ত্রী বিরোধী ধুন্দুমার। এমপিরা বলেন, টাইমস পত্রিকা বিশ্বের নিকৃষ্টতম পুঁজিবাজার বলে যে আখ্যা দিয়েছে বাংলাদেশকে তা সর্বাংশে সত্য।

এসব কটু অথচ সত্য মন্তব্য শুনে অর্থমন্ত্রীর ঘুমন্ত ব্যক্তিত্ব অবশ্যই জেগে ওঠা উচিত। পদত্যাগ করার অভ্যাস তার আছে—তিনি বলছেন বটে, কিন্তু এরশাদ জমানার কথাই যদি ধরি বাস্তবতা হলো তিনি সবসময় ঠেকায় পড়ে সরে দাঁড়িয়েছেন। যখন পায়ের নিচের মাটি পুরোটা সরে যায়, তখন ত্যাগেই শেষ রক্ষা। কেননা এখন শুধু অর্থমন্ত্রীর পায়ের নিচের মাটি সরে যায়নি; খোদ মহাজোট সরকারের পায়ের নিচের মাটি আলগা হচ্ছে প্রতিদিন।

অর্থমন্ত্রী যদি সত্যই পদত্যাগের অভ্যাসটা বাস্তবায়ন করেন, তাতে খুব বেশি বিপদে পড়বে কী মহাজোট সরকার। একদমই মনে হয় না। পাইপলাইনে তাদের অতি সুদক্ষ মন্ত্রী রয়েছেন। যে যাই বলুক, আমি বলব, আবুল মাল আবদুল মুহিত দশচক্রে ভগবান ভূত হয়েছেন। তিনি দশ দস্যুগোষ্ঠীর ঠেলায়-গুঁতায় টানাহিঁচড়ায়—শেয়ারবাজার দুর্নীতি ও পদ্মা সেতু দুর্নীতির কারণে আজ দেশের ইতিহাসের ব্যর্থতম অর্থমন্ত্রীতে পরিণত হয়েছেন। তিনি দস্যুতাকে ঠেকাননি। দস্যুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি; শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছেন আর 'আমিই সেরা' বলে জপ করে চলেছেন। কিন্তু তিনি নিজে দস্যুদের কেউ নন।
মহাজোট সরকারের আকণ্ঠ ব্যর্থতার নিষ্ঠুর বলি হওয়া এখন তার নিয়তির লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন আমাদেরও দেখার পালা—তিনি সরে দাঁড়ান; না-কি তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি তার প্রশংসা করেছেন। বলেছেন, মুহিত সাহেব ভালো অর্থনীতি বিশ্লেষক। প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিতে মুহিত ভালো অর্থমন্ত্রী কি-না, সে প্রশ্ন অজানাই রয়ে গেল।