লাখ-কোটি ৫০ টাকার জাল নোট ও বারাকাত ভাইয়ের সূক্ষ স্যাটায়ার

আমিন বরিশালি
Published : 15 Feb 2012, 05:04 PM
Updated : 15 Feb 2012, 05:04 PM

সরকারি দল, বিরোধী দল যে যার মতো বলুক—মহাজোট জমানায় অর্থনীতির হাল কেমন, সেটির নিরপেক্ষ মূল্যায়ন জানতে আমরা ৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে অংশ নিতে পারি। প্রেস ক্লাবে ওই গোলটেবিলে প্রধান বক্তা ছিলেন জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আবুল বারাকাত।

বারাকাত ভাই বিরল মেধাবী মানুষ। তার সূক্ষ্ম স্যাটায়ার ছাত্রজীবনে দারুণ উপভোগ করেছি। তিনি বলেন কম, বুঝিয়ে দেন বেশি।
সেমিনারে তিনি নিজে তত্ত্ব কপচাতে যাননি। ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট শীর্ষতম মেধাবী সত্ত্বেও সেটা দাবি করে লোক হাসাতে যাননি; বরং তিনি প্রদর্শন করেন হাল অর্থনীতির এক তৃণমূল মুখকে।

এই তৃণমূল বক্তাটি হলেন গুলিস্তানের ছেঁড়া নোটের অখ্যাত কারবারি সানোয়ার হোসেন। ফুটপাতের মানুষ।
সানোয়ার তেমন কিছু বলেননি। শুধু জানিয়েছেন বিচ্ছিন্ন কিছু তথ্য।

তিনি জানান, দেশে বর্তমান বাজারে প্রচলিত ৫০ টাকার নোটের বেশির ভাগই জাল। এগুলো সাধারণত ১০ টাকার নোটের ওপর ৫০ টাকার ছাপ মারা। ছোট নোট বলে কেউ ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না।
কিভাবে এই লাখ-কোটি ৫০ টাকার জাল নোট ছড়িয়ে পড়ল?

জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবুল বারাকাত বলেন, জাল টাকা চক্রের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে সাতটি মামলার আসামি হয়েছেন সানোয়ার। আজ তাকে আমি এনেছি কথা বলার জন্য, আগামীকাল তাকে খুঁজে পাওয়া না গেলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।

বারাকাত বলেন, মাত্র ১২ পয়সা বাঁচানোর জন্য নানা মানের টাকার সাইজ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা একই করা হয়েছে। এতে দেশের অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়েছে।

সানোয়ার বলেন, '১০ টাকার নোট এবং ৫০ টাকার নোট সমান মাপের হওয়ায় ১০ টাকার নোটে কেমিক্যাল দিয়ে সাদা করে ৫০ টাকার ছাপ মারা হচ্ছে। ছিঁড়ে যাওয়ার পর আমার কাছে বদলে নিতে আসা নোটের ৮০ ভাগেই জাল দেখা যাচ্ছে।'

১০০ এবং ৫০০ টাকার নোট একই মাপের করাটাই ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ঐতিহাসিক ভুল। ১০০ টাকার নোটকে বিশেষ ধরনের কেমিক্যাল দিয়ে সাদা করে ৫০০ টাকার ছাপ দেয়া হচ্ছে। এতে করে নিরাপত্তা চিহ্ন এবং কাগজের মান একই থাকায় সাধারণ মেশিনেও এই জাল টাকা ধরা কঠিন হয়ে পড়েছে।

সানোয়ার বলেন, ১০০ টাকার নোটের ওপর ছাপ মেরে ৫০০ টাকা করা নোট জাল আমার কাছে ধরা পড়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের সব পর্যায়ের কর্মকর্তাকে অবহিত করি।

বাংলাদেশ ব্যাংকে ছেঁড়া টাকা বদল করে দেয়ার পর পুড়িয়ে ফেলার নিয়ম থাকলেও আংশিক পোড়ানো হচ্ছে, বাকি টাকা আবার পরিবর্তন করা হচ্ছে বলেও বিষয়টি নিয়ে তিনি অভিযোগ করেন।
২০০৮ সালে লিখিতভাবে গভর্নরকে জানাই। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা খন্দকার মাযহারের সঙ্গে দেখা করে কথা বলি।

তিনি আরও দাবি করেন, বর্তমান আইনে কোনো নোটের ৬৫ শতাংশ জমা দিতে পারলেই তাকে ওই নোটের সমপরিমাণ টাকা দিতে বাধ্য বাংলাদেশ ব্যাংক। এই আইনটির অপব্যবহার করছে চোরাকারবারিরা। এর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা জড়িত।

তিনি বলেন, বিশেষ কায়দায় ১০০০ টাকার ৬৫ শতাংশ আলাদা করা হচ্ছে। একইভাবে অপর ১০০০ টাকার নোট ৬৫ শতাংশ আলাদা করে ব্যাংক থেকে টাকা নেয়া হচ্ছে। পরে দুটি টাকার অবশিষ্ট ছেঁড়া ৩৫ শতাংশ একত্রে যোগ করে ৭০ শতাংশ করে আরও ১০০০ টাকা নেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে তিনি হাইকোর্টে রিট করেছেন বলেও দাবি করেন।

জানান, ২০১০ সালের ২৫ জুলাই ডেপুটি গভর্নরের সঙ্গে সব বিষয়ে কথা বলার পর আমার নামে সাতটি মামলা হয়েছে।

দেশের অর্থনীতি কোন পথে, কীভাবে হাঁটছে ভাবুন। পুঁজিবাজারের মুরব্বি ভাইকিং দস্যুরাই কি কেবল শেয়ারবাজার লুটে চলেছে। দস্যুবৃত্তি চলছে ছেঁড়া নোটের ক্ষুদ্র কারবারেও। সেখানেও একজন সত্ ক্ষুদে কারবারি মৃত্যু পরোয়ানা হাতে নিয়ে ঘুরছেন। সরকার সমর্থক একজন শীর্ষ অর্থনীতিবিদ, যিনি কি-না একটি বিশাল ব্যাংকের কর্ণধার, তিনিও সানোয়ারের নিরাপত্তার গ্যারান্টি হতে পারছেন না।

শোনা যায়, অর্থনীতির এই নিহত দশাকে সামাল দিতে অকাতরে নোট ছেপে চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে জন্য মূল্যস্ফীতি আকাশছোঁয়া। ১০ টাকা ও ৫০ টাকা, ১০০ টাকা ও ৫০০ টাকার নোট একই মাপের করা হয়েছে কার বুদ্ধিতে। ১২ পয়সা বাঁচাতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নোটের নিয়ন্ত্রণ তুলে দিল জাল কারবারিদের হাতে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে পরিমাণ টাকার অংকের নোট ছেপে তাদের হিসাবপাতি করছে, বাস্তবে একই সংখ্যক নোটের সরবরাহে বাজারে টাকা রয়েছে কয়েকগুণ বেশি।

গুলিস্তানের তুচ্ছ টাকা কারবারি ফুটপাতে বসে যে সত্য জানছেন; অর্থনীতিকে যেভাবে তিনি বুঝতে পারছেন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সচিবালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক হেড অফিসে বসে মেধাবী অর্থমন্ত্রী ও অনন্য মেধাবী গভর্নর কি তার ছিটেফোঁটাও অনুধাবন করতে পারছেন!

অপ্রিয় সত্যকে বলে সানোয়ার তার জীবনকে বন্ধক রেখেছেন দস্যুদের হাতে। আগামীকাল পর্যন্ত তার জীবনের গ্যারান্টি নেই—তারপরও সত্য বলতে তিনি অকুতোভয়।
সেখানে অর্থমন্ত্রীর বিবেক কি একটুও দংশিত হয় না। তার চোখের সামনে এক লাখ কোটি টাকা লুটপাট; জ্বালানি তেলের দাম, রেন্টাল বিদ্যুতের নামে লুট—সব জেনেশুনে তিনি কেবল ছড়া কাটছেন—আই অ্যাম দ্য বেস্ট। একদিন একরত্তি সত্য বললেন, পরদিন আবার তা প্রত্যাহার।

পদের মোহ, মন্ত্রীর গাড়ি-বাড়ি, আরাম-বিলাসের তিনি এতই কাঙাল! শিখুন সানোয়ারের কাছে। সত্যের অসঙ্কোচ প্রকাশে তার কি দুরন্ত সাহস! ৭টি মামলা দিয়েও ভয় খাওয়ানো যাচ্ছে না। সেখানে একটু চোখ রাঙানি দেখেই মুখের কথা একরাতের মধ্যে উল্টে ফেলেন মন্ত্রী।