শোন গো মেয়ে, নগ্নতা মানেই নারী স্বাধীনতা নয়!

আমিনা মুন্নী
Published : 21 July 2016, 05:12 PM
Updated : 21 July 2016, 05:12 PM

কান্দেল বেলুচ—
পাকিস্তানি মডেল অভিনেত্রী যে অশালীন কর্মকাণ্ডের অভিযোগে নিজ ভাইয়ের হাতে খুন হয়েছেন। খুনের কারণ হিসাবে ভাই উল্লেখ করেছেন, বোনের সীমাহীন অশ্লীলতা ভাই হিসাবে তার পক্ষে আর হজম করা সম্ভব হচ্ছিল না। পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে তাই বোন কে হত্যা করা ছাড়া তার সামনে আর কোন রাস্তা খোলা ছিল না বিধায় যে নিজের হাতে তিনি বোন কে হত্যা করেছেন এবং তার জন্য তিনি বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নন। স্বভাবতই 'পাকিস্তানের অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন মডেল খুন' এই ধরনের শিরোনামে বাংলাদেশের মিডিয়ায় খবর ছাপতে দেখে আমি মডেলের ব্যাপারে কিছুটা উৎসাহী বোধ করি এবং তার ব্যাপারে কিছু ইন্টারনেট এ সামান্য রিসার্চ করি। রিসার্চের প্রথম finding ছিল বাংলাদেশের খবরের কাগজগুলো জনপ্রিয় শিরোনাম দিয়ে যে নিউজ করেছে তা সম্পূর্ণ ভুল। বরং বলা যেতে পারে কান্দেল বেলুচ পাকিস্তানের সবচেয়ে কুখ্যাত ও সমালোচিত মডেল ছিলেন যে সস্তা পাবলিসিটির জন্য এমন কোন কাজ নেই যা করে নি। কান্দেল বেলুচ- একটি অসুস্থতার নাম। যে রোগ আমাদের সমাজের কিছু মেয়েদের ভেতরও প্রকট ভাবে আছে। চিপ পাবলিসিটির জন্যে আমাদের সোসাইটিরও কিছু মেয়ে আছে যারা সোশ্যাল মিডিয়া কে পুঁজি করে বিকৃত রুচি সম্পন্ন ছবি পোস্ট করে নিজেদের ফলোয়ার বাড়ানোর চেষ্টা করছে। উদ্দেশ্য বিশাল সংখ্যক মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ ও মিডিয়াতে খুব কম সময়ে জায়গা করে নেয়া। কান্দেল বেলুচ এবং এই ঘরানার কিছু স্বঘোষিত নারীবাদী যাদের অস্তিত্ব মোটামুটি পৃথিবীর সব জায়গাতেই কম বেশি দেখা যায়। প্রয়োজনের বাইরে নারী শরীর কে নগ্ন ভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে তারা নারী মুক্তির বার্তা ছড়িয়ে দেন। নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলেন। নারী মুক্তি, নারী ক্ষমতায়ন বা নারী স্বাধীনতা- তিনটি ব্যাপারেই কেন জানি না এদের সবার প্রধান এবং একমাত্র অস্ত্র হচ্ছে কাপড় খোলা! নিজেকে নগ্ন ভাবে উপস্থাপন করা। আমি নগ্ন হয়ে মিনিংলেস ছবি সোশ্যাল মিডিয়া তে আপলোড করবো, সেই সস্তা কুরুচি পূর্ণ ভিডিও গুলো ছেলেরা দেখবে আর বাথরুমে গিয়ে শুক্রাণু বিসর্জন দেবে এর ভেতর নারী মুক্তির কোন উপজীব্য লুকিয়ে আছে তা আমার ঠিক বোধগম্য নয়। তবে একথা সত্যি কান্দেল বেলুচ এর মত কনফিউজড মেয়েরা আরও কনফিউজড হয়ে যায় কিছু তথাকথিত নারীবাদীদের প্রশ্রয়ে যারা নারী মুক্তি বলতে নারীর যেমন খুশি তেমন জীবন যাপন পদ্ধতিকেই কেবল বোঝায়। অথচ বাস্তবতা বলে, শরীর কে পুঁজি করে স্বল্প সময়ে খ্যাতি অর্জনের এই চেষ্টা নারীকে কেবল ছোটই করে। এটা কোন সম্মান বয়ে আনে না, কোন রেভল্যুশনও ঘটাতে পারে না। কোন নারী যদি মনে করেন সমাজে তার প্রাপ্য থেকে কেউ তাকে বঞ্ছিত করছে, তবে প্রাপ্য বুঝে নিতে তাকে তার মেধা কে কাজে লাগাতে হবে। সাহসী ও পরিশ্রমি হতে হবে। কান্দেল বেলুচ এর মত মেয়েরা সস্তা প্রচার বা খ্যাতির জন্য যা করে, তাতে সাহস বা পরিশ্রম কোনটিরই প্রয়োজন হয় না!


শরীর ঈশ্বর প্রদত্ত। এটি প্রদর্শনে ও অশালীন প্রদর্শনে কোন যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না। একে নগ্ন ভাবে উপস্থাপনের মধ্যে নারীর পণ্য রূপ টিকেই কেবল স্বীকৃতি দেয়া হয়… কান্দেলদের সৃষ্টির পেছনে প্রচার মাধ্যমগুলোয় আসলে দায়ী। যে মেয়েটি সংসারে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে সন্তানদের মানুষ করে বাসে চেপে হাজার মানুষের ঘামের বিশ্রী গন্ধ আর ভিড় ঠেলে প্রতিদিন অফিস যাচ্ছে, নানা প্রতিকুল পরিস্থিতি সামাল দিয়ে যে মেয়েগুলো কোন আপোষ না করে মাথা উচু করে বেঁচে আছে, এ যুগের প্রচারমাধ্যমগুলোতে নারী ক্ষমতায়নের প্রতীক হিসাবে এই সব মেয়েদের মুল্যায়ন করা হয় না। বরং যে যত কাপড় খুলবে তার মুল্যায়ন এদের কাছে তত বেশি। তাই লাইম লাইটে আসতে যে মেয়েগুলো অতিরিক্ত ক্ষুধার্ত অনুভব করে, কাপড় খোলার এই শর্ট কার্ট মাধ্যমটিকেই তারাই বেশি বেছে নেয়। কান্দেল বেলুচরা যত না তৈরি হয়, তার চেয়ে বেশি মিডিয়া নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এদের তৈরি করে নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে । এদের নার্সিং করে, গ্রুমিং করায়। এই কান্দাল বা নায়লা নাইমরা অসম্মানিত হওয়ার মত কাজ করবে, নগ্নতাকে পুঁজি করে ব্যবসা করবে, ছেলেদের প্ররোচিত করবে, প্রচার লোভী মেয়েদের উস্কে দেবে, আবার এরাই কোন ছেলে তাদের নিয়ে আবিউসিভ কথা বললে নারী নির্যাতনের মামলা ঠুকে বসবে!!। পুরুষ সমাজ কে ভোগী বলবে। … hypocrites! সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটের হলেও এদেশের হালের এমন একজন সমালোচিত ব্যক্তি হলেন হিরো আলম। ফেসবুকে বা ব্লগে লেখালিখির মাধ্যমে অনেকেই হিরো আলম কে বাস্তবিক অর্থেই সাধারণ জনতার চোখে হিরো বানানোর চেষ্টা করে চলেছেন। কিন্তু আদতেও কি তিনি তাই?? অজ পাড়াগাঁয়ের হিরো আলম, পাকিস্তানের কান্দেল বেলুচ বা বাংলাদেশের নায়লা নাইম বা জ্যাকুলিন মিথিলা… সবাই কিন্তু জনপ্রিয়তা ও সস্তা খ্যাতির জন্য সেই আদিম অবলম্বন শরীর টাঁকেই বেছে নিয়েছেন। মেধা আর পরিশ্রম এখানে সম্পূর্ণ অনুপুস্থিত! আশ্চর্যের ঘটনা, এদের কে যেই মিডিয়া যে সমাজ স্বীকৃতি দিচ্ছে, সেই একই মিডিয়া ভ্রাম্যমান পতিতাদের অচ্ছুত ঘোষণা করছে। কান্দালেরা ফাইভ স্টার হোটেলে যায়, ভ্রাম্যমান পতিতাগুলো খুপরিতে গিয়ে ঢোকে। কান্দালেরা যদি নারী সাহসিকতার প্রতীক হয়ে উঠে… জীবিকার তাগিদে ঘুরে বেড়ানো পতিতাগুলো নারী স্বাধীনতার প্রতীক কেন হবে না!!!??? আসলে নারী মুক্তির প্রধান অন্তরায় এই কান্দালরা!! এদের বিকৃত আর নগ্ন শরীর প্রদর্শনে পুরুষের লালসায় কেবল পূরণ হয়, সাধারণ নারীদের স্বাধীনতা অর্জন হয় না!.. এদের কারণেই পুরুষেরা এখনও পরিবারের বাইরের মেয়েদের অন্য সব ট্যালেন্ট কে অগ্রাহ্য করে কেবল রক্ত মাংসের নারী শরীরটাকেই সবার আগে consider করে বেশি। কান্দেলরাই নারী অগ্রগতির, নারী মুক্তির প্রধান প্রতিবন্ধক! তবে কান্দালদের এমন মৃত্যুতে কোন সমাধান নেই। এই সমাজ ব্যবস্থা, খ্যাতির নেশা কান্দালদের অসুস্থ করে দিয়েছে। হাজার হাজার খ্যাতিকামি মেয়েদের মাঝে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার জন্য কান্দালরা সবচেয়ে প্রচারের সবচেয়ে সস্তা মাধ্যমটিকে বেছে নিয়েছে। খ্যাতিমান হওয়ার এই নোংরা প্রতিযোগীটা তাই সবার আগে বন্ধ করতে হবে। আইএস যেমন অনেক তরুনের কাছে একটা ব্র্যান্ড, ইয়াবা বা গাঁজা যেমন একটা ভয়ঙ্কর নেশা, খ্যাতির জন্য নিজের শরীর বা রূপকে সস্তা ভাবে উপস্থাপনও একটা বিকৃত নেশা। আর সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে মুসলিম সমাজের আধুনিক অনেক মেয়েরাও এই নেশায়, এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে! … কোন নেশার ফলাফলই সমাজের জন্য মঙ্গলকর হয় না! নগ্নতার এই নেশার পরিনতিও তাই কারও জন্য ভালো ফল বয়ে আনতে পারে না কখনও। আজ কান্দেলদের হয় কেউ হত্যা করবে, অথবা এরা আত্মঘাতী হবে। যাদের অনুকরণ করে আজকে এক এক জন কান্দেল তৈরি হয়েছে, তাদের অতীত কিন্তু তাই বলে!