ইস্যুভিত্তিক চেতনা: ভাল না খারাপ?

অমিত বাগচী
Published : 2 Sept 2017, 04:13 PM
Updated : 2 Sept 2017, 04:13 PM

এখন যদি জানতে চাওয়া হয় যে, এই মুহূর্তে দেশের আলোচিত ইস্যু কী? আপনার জন্য উত্তর দেয়াটা কঠিন কিছু হবে কি? আপনি যদি সোস্যাল মিডিয়াতে অ্যাক্টিভ কেউ হন তাহলে অন্তত উত্তর দেয়া মোটেই কঠিন কিছু নয়। সোস্যাল মিডিয়া আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে যেকোন ইস্যুতে নিজের মতামত দেয়ার। নিজের চিন্তাভাবনাকে সবার সামনে তুলে ধরার। কাজেই, দেশের আলোচিত ইস্যুগুলো নিয়ে ফেসবুকের মত মিডিয়াতে তা নিয়ে কথা হবে এটাই স্বাভাবিক। এসব যে একেবারে নতুন তা কিন্তু নয়। সংবাদপত্রে আসা আলোচিত কোন ইস্যু নিয়ে তখন হয়তো চায়ের দোকানে হৈ চৈ হত। আর এখন সেই হৈ চৈ এর ব্যপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে এতটাই যে বাংলাদেশের অস্ট্রেলিয়া জয়ের আনন্দ প্রকাশিত হয় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার অফিসিয়াল পেজে গিয়ে। অস্ট্রেলিয়ার একজন তরুন ক্রিকেটভক্তও জানতে পারে আপনার আমার কথা। আমরা সেখানে গালি দিলে তারা অবগত হন বাংলাদেশীদের রুচী সম্পর্কে।

এসবের ফলে একটা ব্যপার অন্তত হচ্ছে। আজ পত্রিকার পাতায় রূপা ধর্ষণের খবর পড়ার পর আমি হয়তো পাতা উলটে বাংলাদেশ ক্রিকেটের খবরটা নিয়েই বেশি মেতে থাকতাম। কিন্তু, যখন ফেসবুকের হোমপেজে আমার কোন ফেসবুক বন্ধু তার অনুভূতির কথা জানাচ্ছে, বিচারের দাবি জানাচ্ছে তখন আমার মনে হতেই পারে যে আমি কেন চুপ করে আছি? তারপর যখন অনেককেই দেখব ফেসবুকে একই বিষয় নিয়ে কথা বলতে তখন যে বিষয়টি নিয়ে আমার ভাববার কথা নয় সেই বিষয়টি নিয়েও আমি ভাবছি। চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে গিয়ে হয়তো বা আমি নিজেও কিছু লিখছি। এভাবে লিখছেন আরো অনেকেই। একটা ব্যপার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। যে যার মত করে তাদের চিন্তাগুলো শেয়ার করছেন। তা থেকে নতুন কিছুতো আসতেও পারে; নয় কি? আমি এটাকে ইস্যুভিত্তিক চেতনা বলছি কারন এই ইস্যুটি না আসলেতো আর এই বিষয় নিয়ে কোন চিন্তাভাবনা অনেকেই করত না; তাই না?

খারাপ দিক হচ্ছে এটাই যে, আজ এই ইস্যু কাল ঐ ইস্যু…এভাবে চলতে থাকলে শেষ পর্যন্ত কোন কিছুরই গভীরে আর যাওয়া হয় না। একটা ইস্যুকে ভুলিয়ে দেয়ার জন্য আরেকটা নতুন ইস্যুই যথেষ্ট হয়ে যায়! আজ যখন বাংলাদেশের খেলায় আম্পায়ারিং নিয়ে অভিযোগ উঠবে সেই তখনই হয়তো দেশের কোন শিশু নির্যাতনের কথা আমরা খেয়ালই করব না! কিংবা করলেও দুই দিন পর রোহিঙ্গা ইস্যুর মত কোন ইস্যু আসামাত্র আমরা ঐটা ভুলে যাব। অথচ ইস্যু হিসেবে প্রত্যেকটিই কিন্তু পর্যাপ্ত চিন্তাভাবনার দাবি রাখে। নতুন ইস্যু আসা মানেই যে আর আগের ইস্যু নিয়ে ভাবা যাবে না তার কোন মানে নেই। অথচ সেটাই ঘটে অনেক মানুষের ক্ষেত্রে। We Are Social and Hootsuit এর জরিপমতে ঢাকাই হচ্ছে পৃথিবীর দ্বিতীয় জনপ্রিয় অ্যাক্টিভ ফেসবুক ইউজারদের শহর। শুনে মনে হতে পারে যে, এই শহরের মানুষ প্রযুক্তিগতভাবে যথেষ্ট এগিয়ে কারন ফেসবুকতো আধুনিক প্রযুক্তির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত! কিন্তু, বাস্তবতা যে আলাদা তা কিন্তু আপনি আমি সবাই জানি। সবচেয়ে দু:খজনক ব্যপার এটাই যে, ফেসবুক আসার পর যেকোন ইস্যুতে মন্তব্য করাটা এমন এক অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, যে ব্যপারে একজনের বিন্দুমাত্র কোন ধারনা নেই সেও চেষ্টা করে কোন মতামত দিয়ে দেয়ার। চায়ের দোকানে বসে করা সেই মন্তব্যের সাথে এই মন্তব্যের পার্থক্য হচ্ছে এটি কিন্তু  চায়ের দোকানের মত সীমিত সংখ্যক মানুষের কাছে যাচ্ছে না। যাচ্ছে এক বিপুল জনগোষ্টীর কাছে। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার পেজটা যে বাড়ির পাশের চায়ের দোকান না তা বুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্ব কিন্তু মার্ক জুকারবার্গ নেন নাই। এটা আপনাকে, আমাকেই বুঝতে হবে। শুধুমাত্র বর্তমান ইস্যু নিয়ে মাতামাতি, জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আর কান্ডজ্ঞানহীনতার ফলই হচ্ছে এসব অনাকাঙ্খিত কার্যকলাপ।

বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহার গবেষণা হয়েছে খুবই কম। Statcounter নামে একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় উঠে এসেছে যে, বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে যেখানে প্রায় ৯৬ শতাংশ ফেসবুক ব্যবহার করছে সেখানে লিংকডইন ব্যবহার করেন ০.১১ শতাংশ! মোবাইল অপারেটরগুলো ব্যবসা করার জন্যই  লিংকডইন ব্যবহারে কোন প্যাকেজ দেন না। প্যাকেজ দেন ফেসবুক ব্যবহার করার জন্য। তরুন প্রজন্মের ফেসবুকে ঢুকে দেশে চাকরি নাই বলে ক্ষোভ প্রকাশ করবে কিন্তু লিংকডইনের নাম শুনলে অবাক হয়ে ভাববে, এটা আবার কি! দু:খিত, প্রসঙ্গ থেকে কিছুটা সরে এসেছি হয়ত। যাইহোক, যা বলছিলাম তা হচ্ছে, এ দেশে সম্ভবত পর্যাপ্ত গবেষণা হয়নি ফেসবুক স্ট্যাটাসের ধরণের উপরে। অন্তত আমি নেট সার্চ করেও খুঁজে পাইনি তেমন। গবেষণা হলে হয়তো দেখা যেতো যে, ফেসবুক ইউজারদের একটি বড় অংশ দেশের প্রত্যেকটি আলোচিত ইস্যুতেই কোন না কোন স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। এরপর স্ট্যাটাস দেয়ার পাশাপাশি তাদের কত শতাংশ সেই ইস্যুটি নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন তার একটি তুলনামূলক চিত্র হয়ত পাওয়া যেত। যদিও ফেসবুকের ভাইরাল হওয়া কোন কিছুর প্রভাব আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি বেশ কয়েকবার। মাত্র কয়েকদিন আগে অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদের পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার অভিযোগটি ফেসবুকের মাধ্যমেই কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হয়। পরে আবার পরীক্ষা নেয়ার পর যখন উত্তরপত্রে ভুলের কথা বলে ফেসবুকে অভিযোগ করা হয় তখন সেই ফেসবুকে যোগাযোগের মাধ্যমেই কিন্তু বেশ কয়েকজন পরীক্ষার্থী কর্তৃপক্ষের সামনে গিয়ে হাজির হয় এবং উত্তরপত্র পূর্ণমূল্যায়ণ করা হয়। একইভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর আরোপিত অতিরক্ত ৭% ভ্যাট নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় নামলে ঐ সময়টায় ফেসবুক ছিল সরগরম। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও ফেসবুকের মাধ্যমে একাত্বতা প্রকাশ করেছিলেন এই দাবির সাথে। আর শেষপর্যন্ত সেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনটি সফলও হয়। এটা কিন্তু সম্ভব হয়েছিল এই ইস্যুভিত্তিক অ্যাক্টিভিটি এর মাধ্যমেই।  আর একই ফেসবুকের কারণেই কিন্তু রসরাজের মত পরিণতি বরণ করতে হয়েছে অনেককে।

শেষ কথায় আসি। যখন যে ইস্যু আসবে তখন সেই ইস্যু নিয়ে কথা হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু, আমাদের চিন্তাভাবনাগুলো কেন এমন হয় যে একটা নতুন ইস্যু আসামাত্রই আমরা আগের ইস্যুটিকে ভুলে যাই? আমাদের চেতনা যদি ঘুমন্ত না হয় তাহলে একটা ইস্যুর পুরোপুরি সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সেটিকে ভোলারতো কথা নয়। সমস্যায় জর্জরিত একটি দেশে কিছু দিন পরপরই নতুন কোন বেদনাদায়ক ঘটনা সামনে আসবে আর আমাদের ভাবাবে-এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, ফেসবুকের কারনেই হয়তো আমরা আজকাল খুব দ্রুত কোন কিছু ভুলতে শিখেছি। শিশু নির্যাতনের একটি ভিডিও যখন আমাদের কাঁদায় ঠিক পরমুহূর্তেই হয়তো কোন Yo Bro এর কৌতুকে আমরা আবার হেসে উঠি। তাহলে যে চেতনার জন্য একটু আগেই চোখে জল এসেছিল সে চেতনার শক্তি আসলে কতটুকু? চেতনা কি এমনই হওয়া উচিৎ? আমরা কি সব দোষ আদৌ ফেসবুককে দিতে পারি? ফেসবুক না থাকলে শিশু রাজনের উপরে সেই নির্মম নির্যাতনের ভিডিও আমাদের চোখের সামনে আসত না। আমরা জানতাম না যে মানবিকতা আজ কতটা নীচে নেমেছে। আমরা জানতাম না যে, এই সমাজে আপনার আমার সাথেই কোন শ্রেণীর মানুষ বাস করে। কিন্তু, এরপরই যদি কোন তারকার বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে আপনি আবারও অশ্রুসজল চোখে বেদনায় ভরপুর কোন স্ট্যাটাস দিয়ে বসেন তবে আপনার ফেসবুক বন্ধুরা বিভ্রান্ত হয়ে ভাববে যে আপনার চোখের জল খুব সহজলভ্য কিছু কিনা।

সমাজে সমস্যার অন্ত নেই। এই সমস্যার ভিড়ে কিছু মানুষ নিরন্তর কাজ করে চলেছেন বিশেষ কোন ক্ষেত্র নিয়ে। কেউ নারী অধিকার নিয়ে কাজ করছেন। কেউ কাজ করছে পথশিশুদের নিয়ে। চেতনা জাগ্রত করার মত কাজ করছেন তারাই। তারাই পথ দেখাতে পারেন জাতিকে কারন তাদের এই নিরন্তর শ্রম কোন ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ইস্যুকেন্দ্রিক নয়। তারা কাজ করেন তাদের বিবেকের তাগিদে। তবে, তাদের দেখানো পথে আমরা কতটুকু চলতে শিখেছি তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হলেও উত্তর মিলবে কিনা সন্দেহ।