শ্রদ্ধেয় লাকী আখন্দ, করুণা নয়, ন্যায্য অধিকার চান

আনা নাসরীন
Published : 19 July 2016, 12:00 PM
Updated : 19 July 2016, 12:00 PM

একজন শিল্পী ভয়ঙ্কর কোন অসুখে আক্রান্ত হবেন বা ভয়ঙ্কর আর্থিক দুর্যোগে পতিত হবেন, তারপর সরকারের কাছে আর্থিক সাহায্য চাইবেন, ভাগ্য ভালো হলে তিনি সরকারের করুণা পাবেন, আর ভাগ্য খারাপ হলে ধুঁকে ধুঁকে মরবেন – এই চিত্র আমরা আমাদের দেখি হরহামেশাই। এই প্রবণতার নবতম সংযোজন অনেক জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা লাকী আখন্দ।

যে স্রষ্টা এমন গান সৃষ্টি করতে পেরেছেন যেটা যুগ যুগ ধরে টিকে আছে, যে গান আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে, সেই স্রষ্টাকেও আজ রাষ্ট্রের করুণা ভিক্ষা করতে হচ্ছে – কী মর্মান্তিক! অবশ্য অসুস্থতার শুরুতে লাকী এই চেনা পথে হাঁটতে চাননি – মনে পড়ে, বেশ কয়েক মাস আগে যখন তাঁর ক্যানসার ধরা পড়লো, তখন তিনি সরকারের কাছে সাহায্য চাইতে অস্বীকার করেছিলেন। আজ সেই লাকী কতোটা নিরুপায় হয়ে সরকারের কাছে সাহায্য চাইছেন সেটা অনুভব করি।

লাকী আখন্দ এর মত একজন কিংবদন্তি শিল্পী ও শিল্পের স্রষ্টাকে জীবন শেষে কেন সাহায্যের জন্য হাত পাততে হল? শুধু লাকী আখন্দ ই নন আরও অনেক শিল্পীকেই আমরা এরকম অসহায় পরিস্থিতিতে হাত পাততে দেখেছি। বিনা চিকিৎসায় দীর্ঘকাল ভুগতেও দেখেছি। সৰ্বশেষ যেটা দেখে থাকি সেটা হল আমাদের 'মহৎ' সরকার জনগণের রাজস্বের অর্থ যা দেশের উন্নয়নে ব্যবহার করবার কথা ছিল সেই অর্থ দান করে শিল্পীকে কৃতার্থ করে জনগণের বাহবা কুড়িয়ে থাকেন! এটিই কি কাম্য ছিল? একজন মৃত্যুপথযাত্রী বা দুঃস্থ শিল্পীকে কিছুটা করুণা দেখিয়ে যে রাষ্ট্র ধন্যবাদ পায় শিল্পীর, বাহবা পায় আমাদের, সেই পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে সেই রাষ্ট্রের দায় নিয়ে আমরা খুব কমই আলোচনা করি।

একজন শিল্পীর সারা জীবনের পুঁজি তার সাধনা ও মেধা, যেটা নিয়ে এক পাক্ষিক বাণিজ্য ও বেশুমার মুনাফা করেছে এক দুষ্ট চক্র। সেই চক্রের বিরুদ্ধে, এই দুষ্ট বাণিজ্য ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ কি নিয়েছে সরকার? একটি গানকে পুঁজি করে যে বাণিজ্যগুলো হয়েছে ও হচ্ছে যত বার রেডিও-টিভিতে বেজেছে, ফোন কোম্পানি গুলো যে পরিমান ব্যবহার করেছে, যত হাজার কলার টিউন এই টিউন এ ব্যবহার করা হয়েছে, এক একটি গান ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা হয়েছে তার একটা ন্যূনতম পার্সেন্টেজও কি শিল্পী পেয়েছেন? পূর্বের যেসব রেকর্ড এসব নব মাত্রার বাণিজ্য ব্যবস্থার আগেই সম্পন্ন হয়েছিল, যাদের সাথে কোম্পানিগুলোর কোনো চুক্তি হয়নি ধুমিয়ে ব্যবসা করার পরও তারা মুনাফার কোন অংশ শিল্পীকে দেয়নি।

আমরা, সাধারণ শ্রোতারা, যারা অনলাইন থেকে একটা গান ডাউনলোড করে শুনি তারাও কপিরাইট/ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইট ভাঙছি; এটাও অনৈতিক, বেআইনী। কিন্তু আমরা যেহেতু সেটা শুধু ব্যক্তিগতভাবেই শুনছি সেটা, এতে অনৈতিকতার মাত্রা কম। কিন্তু রেডিও-টিভি এবং মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো বিনে পয়সার গান দিয়ে বিশাল ব্যবসা করেছে; আর সেই ব্যবসার ন্যূনতম হিস্যা মূল ব্যক্তিটিকে না দেয়াটা ভয়ঙ্কর অপরাধ। কিছুদিন আগে থেকে আমাদের শিল্পীরা বাণিজ্যের হিস্যা পাবার দাবিটিই মূলতঃ তুলেছেন; বাস্তবতার নিরিখেই অলাভজনক ব্যবহারের ক্ষেত্রে এখনো তাঁরা জোর দাবী তোলেননি।

কিছুদিন হলো শিল্পীরা তাঁদের সৃষ্টির বাণিজ্যিক ব্যবহারের রয়্যালটি পেতে শুরু করেছেন, যদিও সেটার পরিমাণ শিল্পীদের জন্য আদৌ ন্যায্য কিনা সেটা নিয়ে বিরাট প্রশ্ন আছে। কিন্তু লাকীর মতো আরও অনেক শিল্পী আছেন, যারা রয়্যালটি বঞ্চিত হয়েই জীবন সায়াহ্নে এসে উপস্থিত হয়েছেন। এখন থেকে দেয়া শুরু হলেও, এতো দিনকার বঞ্চনার ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন কি আড়ালেই থেকে যাবে? সেই প্রাপ্যের অতি সামান্য অংশ পেলেও কি বিপদে পড়ে লাকী বা আর কোন শিল্পীর সরকারের করুণা চাইতে হয়?

আবারো বলছি এর জন্য শতভাগ দায়ী সরকার। মুনাফার সর্বোচ্চকরণে বিশ্বাসী বেনিয়াদের কাছে মানবিকতা, নৈতিকতা আশা করা বাতুলতা, তাই সেটা করিও না। সরকারেরই দায়িত্ব তার নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষায় নীতিমালা-আইন তৈরি করা এবং সেটা প্রয়োগ করা। কিন্তু সরকার বছরের পর বছর কাটিয়েছে ওই পথ না মাড়িয়ে।

আমি দুঃখিত, লাকীর সরকারি সাহায্য চাওয়াটা আমি খুব একটা ভালোভাবে দেখি না, যদিও আমি সত্যিই অনুভব করি, শ্রদ্ধেয় লাকী আখন্দ কতোটা নিরুপায় হয়ে আগের অবস্থান থেকে সরে এসে সরকারের করুণা চাইছেন। আমি খুব খুশী হতাম যদি দেখতাম, তাঁর জীবনের এই পরিস্থিতিতে তিনি সরকারের করুণা না চেয়ে খুব দৃঢ়ভাবে তাঁর ন্যায্য অধিকার চাইছেন সরকারের কাছে, যেহেতু সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণেই তাঁকে আজ এই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে।

সরকারের উচিৎ যেসব প্রতিষ্ঠান তাঁর গান ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করেছে, তাদের ঘাড় ধরে তাঁর প্রাপ্য টাকার অতি সামান্য অংশ হলেও এনে দেয়া। অনুমান করি সেই সামান্য অংকও এতোটা হবে যে, সেটা দিয়ে তাঁর চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহ তো হতোই, তাঁর পরিবারেরও ভবিষ্যৎ আর্থিক অনিশ্চয়তা দূর হতো। অন্যদিকে তাঁর পক্ষ থেকে এই চাপ নিশ্চয়ই তাঁর মতো অন্য শিল্পীদের জন্যও আশীর্বাদ হয়ে আসতো।

আমরা, সাধারণ জনগণ চাই, জনগনের করের টাকা দিয়ে করার মতো আরও অনেক জরুরী কাজ সরকারের আছে, তাই সেই টাকা দিয়ে কাউকে করুণা দেখানোর কোন প্রয়োজন নেই। বরং সরকারের ওপর আমাদের এই চাপ জারি রাখা উচিৎ, সরকার যেন তার কর্তব্য পালন করে সঠিকভাবে, তাতেই ন্যায্য হিস্যা পেয়ে শিল্পীরা ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারবেন।

অবশ্য এতে মাঝে মাঝে কিছু দুঃস্থ-অসুস্থ শিল্পীকে টাকা অনুদান দিয়ে সরকারের মহৎ সাজা হবে না, আমাদের হাততালি পাওয়া হবে না। এজন্যই কি………।