‘মগের মুলুকে’ আফসানা হত্যার বিচার চাওয়া আর চিন্তার স্ববিরোধিতা

আনা নাসরীন
Published : 21 August 2016, 02:55 AM
Updated : 21 August 2016, 02:55 AM

যে 'মৃত্যু উপত্যকায়' আমাদের বসবাস সেখানে খুনের ঘটনা ঘটে আকছারই। প্রায় সব খুনই আমাদের গা সওয়া, ওসব খুন আমাদের আর চাঞ্চল্য জাগায় না। অবশ্য কোন কোন খুন এখনও জাগায় কিছুটা চাঞ্চল্য। চাঞ্চল্যেরও আছে আবার রকমফের – কোনটার চাঞ্চল্য খুব কম, কোনটার আবার বেশী। ছাত্রলীগ নেতার হাতে আফসানা'র খুন হওয়া তৈরি করেছে খুব সামান্য চাঞ্চল্য – মূলধারার মিডিয়া, কিংবা সামাজিক মিডিয়ায় তাই আমাদের 'প্রতিক্রিয়া' অনেক কম।

যারা এই ঘটনায় 'প্রতিক্রিয়া' দেখিয়েছেন, তাঁরা স্বভাবিকভাবেই বিচার চেয়েছেন আফসানা হত্যার। 'বিচার চাওয়া' বিষয়টাই হাস্যকর – বিচার কি চাওয়ার বিষয়? বিচার কি রাষ্ট্রের স্বতঃপ্রণোদিত বিষয় নয়? তো আমরা রাষ্ট্র বানিয়েছি কেন? ট্যাক্সের টাকায় প্রশাসন-বিচার বিভাগ পুষি কেন? জানি, কেউ কেউ বলবেন আমাদের রাষ্ট্রের মতো রাষ্ট্র এসব একেবারেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে করবে, এটা নেহায়েৎ ই ইউটোপিয়ান চিন্তা। এটাও সঠিক কথা, তাহলে তো আমার পাল্টা প্রশ্ন আছে; সেটা নিয়ে কথা বলা যাক আরেকটু পরে।

এই দেশে আইন কাদের জন্য, সেটা কি এর মধ্যেই আমরা জেনে যাইনি? এই দেশেই একজন এমপি'র গাড়িতে তার পিস্তলের গুলিতে ড্রাইভার মারা যায়; আমরা পরে জানতে পারি এমপি সাহেবের ফেলে যাওয়া পিস্তল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে গুলি বেরিয়ে মারা যায় ড্রাইভার। জনৈক এমপি সারা রাত মদ খেয়ে মাস্তি করে বাসায় ফেরার সময় গুলি করে আহত করেন শিশুকে। এরপর একটা 'আইওয়াশ' গ্রেফতার, আর কয়েকদিন পরেই ফুলের মালা গলায় দিয়ে বীরের বেশে বেরিয়ে আসেন।

সারা দেশের মানুষ রীতিমত ভিডিওতে দেখলো একজন এমপি একজন শিক্ষককে কান ধরিয়ে উঠবস করাচ্ছেন, কিন্তু ক'দিন আগে হাইকোর্টে পুলিশের রিপোর্ট যায়, এমপি সাহেব নির্দোষ, তিনি জাস্ট পরিস্থিতির শিকার। এমপি'র কথা বাদই দেই, পত্রিকায় দেখলাম গত ছয় বছরে ছাত্রলীগের হাতেই খুন হয়েছে ৫৪ জন। বিচার দূরেই থাকুক, কোন মামলা ঠিকঠাক চলার খবর কি জানি আমরা? এই সরকার ক্ষমতায় আছে বলে এখনকার উদাহরণ দিলাম, কিন্তু একই ধরণের ঘটনা ঘটেছে বিএনপি সরকারের সময়ও।

'তনু হত্যা' দিয়ে উদাহরণগুলো শেষ করছি। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তো অসাধারণ চাঞ্চল্য তৈরি করেছিল আমাদের মধ্যে, সামাজিক মাধ্যমে, এমনকি যেটা সচরাচর দেখা যায় না, এই সময়ে মানুষ রাস্তায়ও নেমে এসেছিল প্রচণ্ড বিক্ষোভে। কিন্তু ওই ঘটনার ঘটনাস্থল ক্যান্টনমেন্ট, এটুকুই সম্ভবত বলা যথেষ্ট, কী হয়েছিল ওই ঘটনার তদন্ত আর বিচারের ভাগ্যে। তনু হত্যার কয়েক মাস পর তনুর মায়ের উক্তি "গরীব বলে কি আমরা বিচার পাবো না?" বের করে দেয় থলের বিড়াল। হ্যাঁ, এই দেশে কেউ যদি কোন না কোনভাবে ক্ষমতাশালী হয়, প্রশাসন-বিচার ব্যবস্থা তার পক্ষে।

'গরীব' শব্দটা আসলে এখানে ক্ষমতাহীনতার প্রতীক। শুধু গরিব, প্রান্তিক মানুষ কেন, সমাজে প্রতিষ্ঠিত মানুষও যদি দারুণ ক্ষমতাশালীদের পথের কাঁটা হয়, তার ফলাফলও সেই ক্ষমতাশালীদের পক্ষেই যায়; সাগর-রুনি হত্যাকান্ড সেই সত্যটাই আমাদেরকে সেই কঠিন সত্যিটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছে।

যে রাষ্ট্র তার ক্ষমতাহীন নাগরিকের পক্ষে দাঁড়ায় না, যে রাষ্ট্র কেবলই ক্ষমতাশালীদের স্বার্থ রক্ষার যন্ত্র হয়ে থাকে, দুঃখিত, সেটাকে রাষ্ট্র বলে মানতে ভীষণ আপত্তি আছে আমার। সেটা স্রেফ একটা 'মগের মুলুক'। সেই কালের মগের মুলুকের বাসিন্দাদের তবুও একটা সান্ত্বনা ছিল, তারা কষ্টের টাকা থেকে ট্যাক্স দিয়ে কোন সরকার পুষতো না। এ কালের মগের মুলুকে আমাদের করতে হয় সেটাও।

একটা রাষ্ট্রে বিচার একটা স্বয়ংক্রিয় ব্যাপার হওয়া উচিৎ বলায় আমাদের দেশের বিবেচনায় কারো কাছে যদি সেটাকে ইউটোপিয়ান চিন্তা বলে মনে হয়, তাহলে বছরের পর বছর আমাদের রাষ্ট্র-রূপী মগের মুলুকে থেকে কি আমরা দেখেছি না, বিচার এই দেশে কার জন্য? তাহলে বিচার চাইছি কেন আমরা? এই বিচার চাওয়া আর পাওয়ার স্বপ্ন দেখাটাও কি চরম ইউটোপিয়ান চিন্তা নয়?

আসলে রাষ্ট্রের এই চরিত্র বহাল রেখে আমরা সাধারণ, ক্ষমতাহীনদের জন্য ন্যায়বিচার কোনোদিনও পাবো না। তাই এই রকম রাষ্ট্রব্যবস্থার পাল্টানোর চেষ্টা না করে সেই ব্যবস্থার কাছেই সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার চাওয়া একটা স্ববিরোধীতা।

সবার আগে বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলোৎপাটন করে একটা কল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থার পত্তন করা হওয়া উচিৎ সর্বপ্রথম অগ্রাধিকার। তার আগে সামাজিক মিডিয়ায় যাবতীয় 'বিচার চাই, বিচার চাই' আবেদন স্রেফ ডিজিটাল কোলাহল ছাড়া আর কিছু নয়।