আমরা ক্রিকেট খাই, মোটা চালের ভাত তো খাই না

আনা নাসরীন
Published : 12 Oct 2016, 06:06 PM
Updated : 12 Oct 2016, 06:06 PM

অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বাড়তে বাড়তে মোটা চালের কেজি ২৫/২৬ টাকা থেকে এখন ৪০ টাকায় পৌঁছেছে (বিস্তারিত পড়ুন – মোটা চালের কেজি ৪০ টাকায় উঠেছে)। এটা ধান ওঠার মৌসুম না, তাই এই দাম বৃদ্ধির কোন সুফল পৌঁছছে না প্রান্তিক কৃষকদের কাছে। এটা স্রেফ কিছু ধনী মিল মালিকদের কারসাজি। অল্প কয়েকদিনেই এই ধনী লোকগুলো বানিয়ে নিয়েছে অনেক টাকা।

প্রতিবছর যখন নতুন ধান ওঠে তখন ধানের দাম খুব বাজেভাবে যাতে পড়ে না যায়, সেজন্য সরকার ধান-চাল সংগ্রহ করে। তাত্ত্বিকভাবে এতে কৃষক কিছুটা হলেও ন্যায্য মূল্য পাবার সম্ভাবনা তৈরি হবার কথা। কিন্তু প্রতি বছর এই সংগ্রহ অভিযান শুরু হতে দেরি হয়ই, আর ধান চাষের সময় নানা ঋণে জর্জরিত কৃষক বাধ্য হয় অত্যন্ত কম দামে তাদের ধান বিক্রি করে দিতে। যখন সরকার ধান-চাল সংগ্রহ করতে শুরু করে ততোদিনে প্রায় সব ধান কৃষকের হাতছাড়া হয়ে চলে যায় মিল মালিকদের কাছে। এরপর সরকারের দামে চাল সরবরাহ করে মিল মালিকরা করে করে মোটা লাভ, যার একটা বড় অংশের ভাগিদার ছিলো কৃষকরা (বিস্তারিত পড়ুন – ধানে সর্বস্বান্ত কৃষক)।

একটা সরকার যদি ন্যূনতমও মানুষের কথা ভাবে, তাহলে তাকে মোটা চালের দাম নিয়ে ভাবতে হবে, কারণ এটা নিম্ন আয়ের মানুষরা খায়। এমনকি চাল উৎপাদক প্রান্তিক চাষীদের বেশিরভাগই নতুন ধান ওঠার আগ পর্যন্ত চালের ক্রেতাই। 'পানির দামে' ধান বিক্রিতে বাধ্য হওয়া মানুষগুলোও এখন ৪০ টাকা কেজিতে চাল কিনে খাচ্ছে।

সরকার বলতে পারে, তারা তো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ১০ টাকা কেজি দরে চাল দিচ্ছে। এই কর্মসূচির আওতায় এসেছে প্রয়োজনের তুলণায় অনেক কম মানুষ, আর এই রিপোর্ট (১০ টাকার চাল বিক্রিতে ১০ ধরনের অনিয়ম) পড়লে স্পষ্ট হবে বরাবরের মতো এই চাল আদতে সরকারি দলের লোকজনের পকেটই ভরাবে। ওদিকে ওএমএস এর চাল বিক্রি করা হবে বলা হলেও আজ পর্যন্ত সেটা শুরু করা হয়নি। অথচ চালের দাম একদিন সকালে ৪০ টাকা হয়ে যায়নি – দুই/তিন মাসে ধাপে ধাপে হয়েছে।

পোকায় কাটা গম কিনে শত শত কোটি টাকা লোপাট করার অভিযোগ থাকার পরও খাদ্যমন্ত্রী টিকে আছেন পদে, এমনকি হাইকোর্ট কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত হবার পরও তিনি গদিতে থাকেন বহাল তবিয়তে। এর এখন মোটা চালের এই কেলেঙ্কারির পরও তিনি মন্ত্রী থেকে যাবেন, জানি এটা। এদেশের কোন সরকার কোনোদিন গরিবের স্বার্থ দেখার সরকার ছিল না।

এই পর্যন্ত পড়ে মনে প্রশ্ন আসা স্বাভবিক, শিরোনামে ক্রিকেটের কথা উল্লেখ করাটা কি 'ধান ভানতে শিবের গীত' হয়ে গেল না? এটা এসেছে আসলে ফেইসবুক দেখে। এটা ইদানিং খুব স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে যে আমরা অনেক ইস্যুতে ফেইসবুকে লিখে, বা খবরের লিংক শেয়ার করে আমাদের অবস্থান জানাই। এতে খুব কাজ হয়, সেটা বলছি না, তবে এতে কোন বিষয়ে মানুষের এক ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা যায়। কিছু ক্ষেত্রে সরকারকেও রেসপন্স করতে দেখা যায়।

মোটা চালের দাম বৃদ্ধি নিয়ে খুব মন দিয়ে ফেইসবুক খেয়াল করেও আমি দেখলাম প্রায় কেউই কথা এই ব্যাপারে কথা বলছে না। অথচ এটা নিয়ে আমাদেরই কথা বলার কথা ছিল, কারণ মোটা চাল খাওয়া মানুষগুলো ফেইসবুক পর্যন্ত পৌঁছে এসব লিখার পর্যায়ে নেই। আমরা ফেইসবুকে এটা নিয়ে প্রচণ্ড শোরগোল করলে কে জানে, কিছুটা কাজ হতেও পারতো হয়তো। কিন্তু আমাদের জাতি বুঁদ হয়ে আছে ক্রিকেট খেলায়, দুর্বল আফগানিস্তান হোক বা শক্তিশালী ইংল্যান্ড আমাদের আগ্রহের কোন কমতি নেই। এই উন্মাদনাই চলছে ফেইসবুকে।

মোটা চালের দাম বৃদ্ধিতে আসলে আমাদের কিছু আসে যায় না, কারণ ফেইসবুকে নানা ইস্যুতে ঝড় তোলা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ক্রিকেট খায় দারুণ; তারা মোটা চাল খায় না।