মেয়র আতিককে আমার স্ত্রীর চায়ের নিমন্ত্রণ

তন্ময় ইমরানতন্ময় ইমরান
Published : 8 Jan 2012, 08:12 PM
Updated : 12 March 2020, 01:15 PM

ঢাকা উত্তরের মাননীয় মেয়র আতিকুল ইসলাম, কিছুদিন আগে শেষ হয়ে যাওয়া ঢাকা সিটি নির্বাচনে আপনার চা বানানোর একটি দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুব সমালোচিত হয়। লোকে বলতে শুরু করেছিল- আপনি শো-অফ করেছেন, স্টান্ট করছেন। আমিও তাদের সাথে সুর মিলিয়েছিলাম। একটু অন্যভাবে দেখেছিল আমার স্ত্রী। সে বলেছিল- "লোকটা 'শো অফ' এর জন্য হলেও তো একবার দোকানে বসে চা বানিয়েছেন। ভিন্নচিন্তা করেছেন; আমার মনে হচ্ছে তিনি একটু ভিন্ন হবেন।"

আমি আমার স্ত্রীর কথায় এখন পর্যন্ত একমত নই। কেননা নতুন মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর আপনি হয়তো এখনো কিছু করে দেখানোর সুযোগ ও সময় পাননি। আমার স্ত্রী এখন অন্ত:সত্তা। অন্ত:সত্তা সেই নারী আপনাকে এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়াতে চেয়েছে মাননীয় মেয়র। আমি কেবল তার নিমন্ত্রণ আপনার কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। কেন হঠাৎ আপনাকেই নিমন্ত্রণ করা হলো সে বিষয়টিও কিছুটা বলে রাখছি।

সাংবাদিকতার সাথে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত বলেই জানি, বাংলাদেশে একজন মেয়রের খুব বেশি ক্ষমতা নেই। সে তুলনায় তার দায় অনেক বেশি। স্বল্পতা রয়েছে সিটি কর্পোরেশনের বাজেটের। কেবল মশানিধনের সাথেই জড়িত হয়তো সরকারের তিন বা চারটে বিভাগ, দায় কেবল মেয়রকে নিতে হয়।

করোনাভাইরাস, ডেঙ্গু ইত্যাদি অনেক ইস্যু নিয়ে হয়তো আপনি ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। সে যাহোক আমার অন্ত:সত্তা স্ত্রী ঠিক যে কারণে আপনাকে দাওয়াত দিয়েছেন সেটিই বরং বলি। সমস্যাটি হচ্ছে- নেড়ি কুকুর। ভদ্রভাষায় আমরা বলি- কমিউনিটি ডগ কিংবা স্ট্রে ডগ।

অনেকদিন আগে থেকেই আমি এলাকার দুটো নেড়ি কুকুরকে দেখা হলে খাওয়াতাম। স্ত্রীর পরামর্শে রাতে ভাত দেওয়া শুরু করি। বাড়তি ভাত, তরকারির এঁটোকুটোই ছিল সম্বল। সেই কুকুরগুলো কিন্তু কোনওদিন খেত, কোনওদিন খেত না। আমরাও কোনও কোনও দিন খাবার দিতাম, কোনও কোনও দিন দিতাম না। অভুক্ত দুই কুকুর খিদে লাগলে নিচ থেকে খাবার দেওয়ার জন্য ডেকে জানান দিত। গতবছর তাদের একটি বেশ কয়েকটি বাচ্চা দেয়। ভয়ঙ্কর পার্ভো ভাইরাসে তিনটি বাচ্চা মারা যায়। যেটি সুস্থ ছিল- সেটি গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা যায়। আমি ও আমার স্ত্রী যেহেতু কখনো কুকুর পুষিনি, কিংবা পোষার মনোভাবও ছিল না। কাজেই পার্ভো ভাইরাসের ব্যাপারটা অনেক পরে জানতে পারি।

সেই বাচ্চাগুলো মারা যাওয়ার পর আমরা সিদ্ধান্ত নেই কুকুরগুলোকে আর যাই হোক এরপর টিকা দিয়ে দিব, যাতে তারা অন্তত বাঁচে। এর মাঝে একদিন এলাকার একটি খুব ছোট কুকুরের দিকে চোখ পড়ে। সেটিও নেড়ি কুকুরের বাচ্চা, গাড়ির নিচে পড়ে যার একটি পায়ে পচন ধরেছিল। খোঁড়াতে খোঁড়াতে তিনপা নিয়েই খাবার ও পানি খুঁজছিল, কুইকুই করে কাঁদছিল। খুব মায়া হয়। ওই ছোট্ট ছানাকে বাঁচাতে গিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের একটি মহান সহযোগী উদ্যোগের সাথে পরিচিত হই- অভয়ারণ্য।

অভয়ারণ্য- পোষা প্রাণী নিয়ে কাজ করে, কুকুর বেড়ালের ভ্যাকসিন দেয়, অসুস্থ হলে চিকিৎসা করে। মনটা সেদিন খুব ভালো হয়ে গিয়েছিল। কাজটা শুরু হয়েছে দেশে।

উন্নয়ন বলতে মানুষ যে চমকের কথা বোঝে, আমি তারচেয়ে ঢের বুঝি, এইসব ছোট ছোট পরিবর্তনকে, এগুলোই তো একটা সিস্টেমকে ধীরে ধীরে গড়ে তোলে।

ফিরে আসি আমার ও আমার স্ত্রীর গল্পে। হ্যাঁ সাথে পাশের বাসার বড়ভাইকেও রাখতে হয়। মিরপুরের যে এলাকায় আমরা থাকি সেখানকার আমরা প্রথমদিককার বসতি গড়া মানুষ। আমাদের বাড়ির চারপাশে বেশ কিছু জায়গা রয়েছে। প্রায়ই বেড়াল কিংবা কুকুর আশ্রয় নেয়, বিশ্রাম নেয়। বছর বছর বাচ্চা দেয়।

আমরা যে দুটো কুকুরকে খাবার দিতাম এরমধ্যে কালো কুকুর (ডাক নাম কালু) গতবছর ডিসেম্বরের দিকে আটটি বাচ্চা দিয়েছে। পাশের বাসার ভাইয়ার গ্যারেজের মধ্যে একটি স্টোর রুমে সে বাচ্চা দেয়।

কি ফুটফুটে একেকটা বাচ্চা! বাচ্চাগুলো মাস দেড়েক পর যখন প্রথমবার বাইরে বের হলো, তখন মানুষজনের মধ্যে তাদের নিয়ে খুব একটা বিদ্বেষ ছিল না। দ্বিতীয়দিনই একটি বাচ্চা গাড়ির নিচে পড়ে মারা যায়। আমরা ঠিক করি, বাকি বাচ্চাগুলোকে কিছুদিন আটকে রেখে রাস্তায় ছাড়বো, যাতে এই নির্মম দৃশ্য সহ্য করতে না হয়।

তাছাড়া আরেকটি অমানবিক দৃশ্য হচ্ছে, কুকুরের বাচ্চা বা বেড়ালের বাচ্চা এলাকার নৈশপ্রহরীদের পয়সা দিয়ে বস্তায় ভরে প্রধান সড়কে ফেলে দিয়ে আসা। কয়েকটা রাত মা প্রাণীটা কাঁদে, বাচ্চাগুলো খোঁজে! প্রায় প্রত্যেকবছর এই দৃশ্য দেখতে হয়। ভাবতে পারেন মাননীয় মেয়র- কান্নারত মায়ের বাচ্চারা ততোক্ষণে খেতে না পেয়ে, কিংবা প্রধান সড়কে গাড়িচাপা পড়ে মারা যাচ্ছে, আর আমরা কেবল শান্তির ঘুম দিয়ে যাচ্ছি।

আবাসিক এলাকার মৃত কুকুর সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা পয়সা ছাড়া তুলতে চান না। আর সে পয়সা বাড়িওয়ালাদের কেউ কেউ দিতে কার্পণ্য করেন। ফলে কুকুর মৃতদেহ পড়ে থাকে দু'তিনদিনও। প্রতিবছরই আমার এরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। ভাবতে কষ্ট হয়, এতো অমানবিক একটা শহরে বাস করছি।

আমি-স্ত্রী ও পাশের বাসার ভাই মিলে ঠিক করলাম সামান্য কিছুদিন কুকুরের বাচ্চাগুলোকে আটকে রাখবো। পরিকল্পনা ছিল এরপর তারা যখন ঠিকঠাক মতো হাঁটতে পারবে, গাড়ি-ঘোড়া চিনবে, তখন ছেড়ে দিব। কে জানতো এই সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে! একটু বড় হওয়ার পর কুকুরগুলো যখন প্রথমবার রাস্তায় বের হলো, তখনই মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়া মুসুল্লিরা আপত্তি তুললেন। কেবল তারাই নয়, এলাকার বেশিরভাগ লোকই আপত্তি তুললেন। তাদের দাবি কুকুরের বাচ্চাগুলোকে হয় আটকে রাখুন নইলে ফেলে দিয়ে আসুন। তারা ভয় পান। তাদের শিশুদেরও ভয় দেখান- কুকুর কামড়ে দিবে বলে।

আমরা তিনজন বললাম- অন্য এলাকায় ছেড়ে দিলে তো পরোক্ষভাবে এটা হত্যা হবে। মায়ের থেকে সন্তান কেন আলাদা করবো? আচ্ছা ঠিক আছে কিছুদিন আটকে রাখি। বাচ্চাগুলো তখন দুধ ছেড়েছে কেবল।

যেহেতু আটকে রাখি সেক্ষেত্রে দুইবেলা খাবার দিতে হয়। আমাদের আশা ছিল বাচ্চাগুলো একটু বড় হওয়ার দু-তিনদিন পরেই ছড়িয়ে পড়বে। একসময় বাচ্চাগুলো বেরিয়ে আসতে শুরু করলো। তিন মাস পর তাদের ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। আসলে যে দেয়ালে তাদের বন্দি রেখেছিলাম সেই দেয়াল টপকেই তারা বেরিয়ে যেতে লাগলো।

নানা দিক থেকে তাদের আটকে রাখার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু খাওয়ানোর জন্য তো দুপুরে আর রাতে একবার ছাড়তেই হয়। এবারও আপত্তি উঠলো মহল্লাবাসীর পক্ষ থেকে। তারা বললো, কুকুর কামড়াবে। কেউ কেউ দাবি করলো কামড়েছে। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো, একজন একটা কাটা দাগ ছাড়া (সেটি কুকুরে কাটার দাগ না হলেও প্রতিবাদ না করে সান্তনা দিয়ে এসেছি এবং ক্ষমাও চেয়ে এসেছি!) আজ পর্যন্ত তেমন কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেননি।

আমি মানছি, দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকার পর বাচ্চা কুকুররা যখন বের হয়, তখন কিছু কিছু মানুষকে তেড়ে যায়। ঘেউ ঘেউ করা পর্যন্তই। এর বাইরে আক্রমণ তারা করে না। কুকুরকে খাবার কেন দেই, মানুষকে আমরা বিরক্ত করছি, কুকুর নাপাক প্রাণী, কুকুর কেন রাস্তায় হাগু করে, কুকুর কেন রাতে ডাকে, তারা কেন চুপচাপ এক রাস্তাতেই বসে থাকে- এসবই এখন আমাদের দোষ।

এলাকার লোকের একমাত্র কথা- কুকুরের বাচ্চাগুলো ধরে কোথাও ছেড়ে দিয়ে আসো। আমি তাদের বোঝাতে পারি না, কুকুররা একটু বড় হলে এলাকা বাছাই করে নেয়। ছড়িয়ে পড়ে। আমরা তিনজন এলাকাবাসীদের বোঝাতে বোঝাতে ক্লান্ত- কুকুর পাশের এলাকায় আমরা হয়তো ফেলে দিব, কিন্তু ওই এলাকা থেকে আমার এলাকায় কুকুর ফেলাবে। অথবা পিটিয়ে মারবে। এক এলাকার কুকুর আরেক এলাকায় যাবে। এতে সমস্যার সমাধান হবে না। তারচেয়ে অনেক ভালো এবং কম নৃশংস উপায় হচ্ছে কুকুরগুলোকে নিউটার বা প্রজননহীন করে দেওয়া। তারা বিশ্বাস করে না, সিটি কর্পোরেশন এই কাজ করতে পারে। তারা বিশ্বাস করে না- সিটি কর্পোরেশনের এই উদ্যোগ আছে।

সমস্যা হলো কমিউনিটি ডগ বা নেড়ি কুকুর হাসপাতাল পর্যন্ত পরিবহন করা কঠিন এবং প্রায় অসাধ্য কাজ, যদি নিজেদের গাড়ি না থাকে। তাছাড়া এলাকার মানুষের একগলিতে বেশি কুকুর থাকায় সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু একবারও তারা ভেবে দেখছে না, তারা আসলে পৃথিবীতে আসা মানুষের সবচেয়ে বিশ্বস্ত এ জীবগুলোর মৃত্যু কামনা করছেন। তারা মনে করছেন, একবার বাচ্চাগুলো ফেলে দিয়ে আসলে আর কুকুর হবে না। বাস্তব হচ্ছে খাবার খুঁজতে খুঁতে অন্য কুকুর এই এলাকায় আসবে এবং একই সমস্যা করবে।

মাননীয় মেয়র, আপনি আমার এলাকায় আসুন। ছোট্ট একটি এলাকা পরিবর্তন দিয়ে ইতিহাস শুরু করুন। এই এলাকার কুকুরগুলোকে নিউটার করার ঘোষণা দিন, ব্যবস্থা নিন। প্রয়োজন হলে ক্যাম্প করুন।

ঢাকার বেশিরভাগ এলাকায় এখন মালিক সমিতি রয়েছে। বাড়ি বাড়ি থেকে এরা সবাই বিপুল অংকের চাদা তোলেন। কিন্তু দিনশেষে এলাকায় তেমন কোনও দৃশ্যমান কাজ চোখে পড়ে না। ওয়ার্ড কমিশনারদেরও কোনও উদ্যোগ চোখে পড়ে না।

মাননীয় মেয়র, আপনার আওতাভুক্ত ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সাথে কাজ করা অভয়ারণ্য দিয়ে একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করুন। এলাকার মালিক সমিতির কাছ থেকে অর্থ নিন, সহায়তা নিন। এলাকায় এলাকায় কুকুর নিউটার করা, ভ্যাকসিন দেওয়া, হটলাইন ও পোষাপ্রাণী অধিকার রক্ষার ভলান্টিয়ার তৈরি করা ইত্যাদি নিয়ে ক্যাম্প করুন।

আমার স্ত্রীর ভেতরে ভ্রূণ বড় হচ্ছে। ছোট্ট একটা প্রাণ। যতো দিন যাচ্ছে সে খাবার দেওয়া কুকুরের ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর মধ্য দিয়ে নিজের সন্তানকে অনুভব করছে। সারাক্ষণই সে উদ্বিগ্ন থাকছে। আমিও।

স্ত্রী বলেছে, মেয়রকে সে স্রেফ এক কাপ চা খাওয়াতে চায়, যাতে তার শিশু প্রাণিহত্যা ও নির্যাতনের সংস্কৃতিতে না বেড়ে ওঠে, সেই অনুরোধ জানাতে চায়।

সে বলেছে, তার চা ভালো হয় এবং মেয়রকে সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চা বানিয়ে খাওয়াবে। যদিও আমার ধারণা, আপনি যেদিন নিমন্ত্রণ রক্ষা করবেন- সেদিন আবেগে তার চা সবচেয়ে বিস্বাদ হবে।

বিশ্বাস করুন, আপনি উদ্যোগ নিলে পরিবর্তন আসবে। একে একে ঢাকার সব এলাকা হয়ে উঠবে আরও মানবিক। মুজিববর্ষে একেবারে অন্যরকম একটি উদ্যোগ কি আমার এলাকা দিয়ে শুরু হতে পারে না!