খেলার সাথে রাজনৈতিক উত্তেজনা কেন!

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 17 Feb 2012, 06:33 AM
Updated : 19 Nov 2021, 01:17 PM

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাজে ফলাফলের পর মিরপুরে নিজেদের মাঠে প্রথম ম্যাচেই আবার হারলো বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের ফলের কারণে দলে অনেক পরিবর্তন এসেছে। হয়েছে প্রচুর সমালোচনা। বলতে দ্বিধা নেই, বেশিরভাগ সমালোচনাই খেলার গণ্ডি ছাপিয়ে খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবনকে নিয়েই হয়েছে। খেলাকে খেলার জায়গায় রাখিনি আমরা। কোনও কিছুকেই আবেগের বাইরে রাখতে শিখিনি আমরা। আমাদের স্বভাবই এমন। প্রথম খেলায় হারের পর দেখা যাবে, আরও কঠোর সমালোচনার বন্যা বইছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মূলধারার গণমাধ্যমে। দলটি যে তরুণদের নিয়ে গড়া, সেটি অনেক ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরই (!) মাথায় থাকবে না। 

বাংলাদেশ সফরে আসা অতিথি দলগুলোর ব্যাপারে আমাদের যতো আবেগ আর অনুভূতি দেশের বেলায় ততোটা আছে আসলে? উপমহাদেশে ক্রিকেট যতোটা জনপ্রিয় কিংবা এটা নিয়ে মানুষের যে উত্তেজনা তা কিন্তু অন্য কোনও খেলাতে নেই। একসময় ফুটবল ছিল শীর্ষে।  আমাদের বড় হবার সময় মোহমেডান-আবাহনী-ব্রাদার্স ফুটবল দলের ছিল জয়জয়কার। রাতের পর রাত নিদ্রাহীন কেটেছে আমাদের। সময়ের সাথে সাথে ক্রিকেট আসলো তার আপন গতিতে। পাকিস্তান-ভারত ও আমরা এক দেশ ছিলাম। ভাঙতে ভাঙতে তিন দেশ হয়েছে বটে, মন-মানসিকতা আর চিন্তায় এখনো আমরা একে অপরকে ছাড়তে পারিনি। হয়তো সে কারণেই এই তিন দেশের সবকিছুতেই উত্তেজনা আর আক্রোশ।

আমি থাকি অস্ট্রেলিয়ায়, ক্রিকেটের শক্তিশালী দেশ। ২৬ বছর আগে এদেশে আসার পর ভেবেছিলাম এখানকার সমাজ দেখবো ক্রিকেট পাগল। দুইটি কারণে তা নয়। প্রথমত সময়ের ব্যাপারটা । শুরুতে এসে রাত জেগে জেগে কিছু খেলা দেখেছিলাম। সেই সময় আমার এক ম্যানেজার আমাকে বলেছিলেন, "এটা সাময়িক। কিছুদিন পর আর এভাবে ক্রিকেট দেখতে পারবে না।" অস্ট্রেলিয়া এমন একটা ভৌগোলিক অবস্থানে যেখানে পুরো দুনিয়ার সাথে তার সময় বড় গোলমেলে। এই যে এবারের টি-টোয়েন্টি ফাইনাল সেটাও দেখেননি এদেশের সিংহভাগ মানুষ। মধ্যরাতে ক্রিকেট দেখে অফিস ফাঁকি দেওয়া বা অফিসে না যাওয়া এখানে অসম্ভব ব্যাপার। ফলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো পুনর্প্রচার দেখেই খুশি থাকতে হয়েছে সিংহভাগ মানুষকে। আর একটা কারণ, এসব দেশে আবেগের চাইতে বেগের প্রাধান্য অধিক।

যে সমাজে আবেগ বেশি, কিন্তু গতিবেগ নাই- তাদের উৎকৃষ্ট উদাহরণ সম্ভবত বাংলাদেশ। খেলা তো নয়, আশেপাশের সবকিছু নিয়েও অনেক আবেগ আমাদের। জার্সি, অনুশীলন, কথা, আচরণ সবকিছু নিয়ে সবাই মতামত দিয়ে সামাজিক মিডিয়া তোলপাড় করা ছাড়া আর কী করি আমরা? প্যাঁচ লাগানো আর তর্ক করা দুটো ভিন্ন বিষয়। আমাদের এ উত্তেজনাপ্রবণ সমাজ তা মানে না। অথচ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতার পরও সিডনিতে কোথাও মিছিল তো দূরে থাক, একটা পটকাও ফোটেনি। আনন্দের বহির্প্রকাশ ছিল কেবলই ঘরোয়া। 

মাঠে গিয়েও খেলা দেখি আমি। আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের ফুটবল খেলা দেখেছি মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের মাঠে। ধারণযোগ্যতায় দুনিয়ার অন্যতম বড় মাঠ ও  বেশি আসনের এ স্টেডিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ ছিল সেদিন। দুই দেশের জার্সি গায়ে চাপিয়ে যাওয়া দর্শকেরা যার যার মতো আনন্দ উল্লাস করেছেন। কিন্তু যখনই মেসির নাম ঘোষণা হচ্ছিল এবং তার পায়ে বল যাচ্ছিল, সবাই মিলে অভিনন্দিত করছিল তাকে। সেরাকে 'সেরা'র মর্যাদা দেবার এই প্রবণতাই বলে দেয় সভ্য মানুষের আচরণ কাকে বলে।

আমরা এসব মানি না। আমাদের সবকিছুতে বাধা-নিষেধ, নয়তো উন্মাদনা। নিজেদের খেলা, নিজেদের দল নিয়েও বিভক্ত আমরা। দুনিয়ার কোনও দেশে এমন দেখি না। 

যেমন বিশ্বকাপে হারের পর আমাদের দেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ এবং আম-মানুষের  প্রতিক্রিয়া যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখবো- সেগুলোর মধ্যেও যথেষ্ট পরিমাণ বিদ্বেষ আর সাম্প্রদায়িক মনোভাব রয়েছে। যতোদিন আমাদের মন তৈরি না হবে, রাজনীতিকে খেলার বাইরে রাখতে না পারবো- এ দুর্ভোগ যাবে না। 

একটা ছোট উদাহরণ দিতে চাই। দেশের ডিজিটাল মিডিয়ার এক পরিচিত সাংবাদিক তার এক ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তার আনন্দ ছিল দুটো। প্রথমত ভালো খেলেও পাকিস্তানের বিদায়। পরের কারণ নাকি ভারতের লজ্জাজনক হার! এমন চিন্তা যে কারো মাথায় থাকতেই পারে। 

আমি ক্রিকেট ভালোবাসি। একসময় ক্রিকেট পাগল থাকলেও এখন ভালোবাসা ছাড়া পাগলামি নাই।  ভারতীয় দল যে মিডিয়া ও প্রচারে এগিয়ে, সেটা আমি মানি। এর বাইরে তাদের সাধারণ চেহারা আহামরি কিছু না। পাকিস্তান ক্রিকেটে মাঝে মাঝে ঝলসে উঠলেও উত্তেজনা, জোশ আর ধারাবাহিক খেলার পার্থক্য বোঝে না। সে কারণে তারা শীর্ষে যেতে যেতে পা পিছলে পড়ে যায়। কিন্তু তাই বলে কি বাংলাদেশি হিসেবে এমন খোলামেলা মন্তব্য করা উচিত? অকারণে পাকিস্তান আর ভারতবিদ্বেষী পোস্ট দেওয়ার ভেতর আর যাই থাক সৌজন্য কিংবা ভদ্রতা নাই। একজন দায়িত্ববান সাংবাদিক যদি এসব ঢালাও মন্তব্য করতে পারেন, সাধারণ মানুষ গালাগাল দেবে এটাই তো স্বাভাবিক।

বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যত আর আমাদের খেলোয়াড়দের খেলার মান ছাড়া বাকি বিষয়গুলো ঠুনকো। অথচ সে বিষয়ে কোনও মত দেওয়ার মানুষ নাই। বিসিবির কর্তাদের গুষ্টি উদ্ধার, তাদের ইচ্ছেমতো গালাগাল দেওয়ার পাশাপাশি 'খেলোয়াড়রা জিতলে মহামানব হারলে দানব'- এ সবে কী লাভ? সত্যিকার দেশপ্রেমী মানুষ তার দেশের মঙ্গল কামনা করেন। জয় চান। পরাজয়ে ধৈর্য ধারণ করেন। আমরা সেইসবের আশেপাশে নাই। এর ফাঁকে সামাজিক বিভেদ আর বৈষম্য বাড়িয়ে চলেছি সবাই। বাড়ছে অবিশ্বাস আর হানাহানি। সেদিন দূরে না এ ক্রিকেট বা খেলাবিষয়ক পোস্ট নিয়েও আমরা বাংলাদেশিরা দাঙ্গা বাঁধাবো। আমরা সবসময় একটা কথা ভুলে যাই- আমাদের আচরণ আর কাউকে কষ্ট দেয়, কি দেয় না। আমাদের মনে থাকে না, একটা দেশে ভিন্ন ভিন্ন বহুমত থাকে। নিজেদের মত ছাড়াও বাকিদের মতের গুরুত্ব থাকতে পারে। আমাদের সবার ধারণা, আমি যা বলি তাই কেবল সত্য।

কয় বলে এক ওভার, স্ট্যাম্পিং কাকে বলে, কোনটা ডিপ ফাইন লেগ বা ওভার বাউন্ডারির সীমানা কী- এসব যারা জানেন না, তারাও আজকাল বিশেষজ্ঞ মতামত দেওয়ার ব্যাপারে ওস্তাদ। অথচ ভারত পাকিস্তানের সাথে লড়াই ও সমানতালে এগিয়ে যেতে হলে দরকার পরিশ্রম, মেধা আর অভিজ্ঞতার সমন্বয় । ফুটবল, ক্রিকেট বা যেকোনও খেলাকে খেলা হিসেবে নিতে হবে। তারপরই না উৎকর্ষ আর অগ্রগতি আসবে।

ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা- যে দেশই আসুক, তারা বিনা আমন্ত্রণে এদেশে আসে না। তারা মাঠে সমর্থন পাবেন না এটা জেনেই আসেন। কিন্তু অতিথিরা আশা করেন তাদের জন্য থাকবে অতিথিসুলভ আচরণ। সবকিছুকে রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পরিবেশ বিষময় করা আমাদের স্বভাব বলে আমরা তা মানি না মানতে চাই না। একবারও ভাবিনা আমাদের বাজে আচরণ কী বার্তা দেয় তাদের। একবারও আমরা ভাবিনা, কী মনোভাব আর ইমেজ নিয়ে ফিরবেন তারা। দেশ বা জাতির সম্মান বাঁচানোর জন্য খেলায় নিজদলকে সমর্থন করার পাশাপাশি অন্যদের সম্মান জানাতে শিখতে হবে আমাদের। নিজেদের রাজনীতি, দলাদলি, ইতিহাস-অতীত টেনে হাঙামা বাঁধানোর জায়গা খেলার মাঠ নয়। সমাজের সব জায়গায় ঘা রেখে এখানে মলম লাগানোর কোন মানে আছে?

এটুকু বোঝার মতো পরিপক্ক কি ৫০ বছরে হয়নি বাংলাদেশ?

সিডনি

১৮.১১.২১