কবিতা ‘খোয়াবনামা’ : একটু মন দিয়ে পড়া

hasanazizul_hoque
Published : 16 July 2014, 05:25 PM
Updated : 16 July 2014, 05:25 PM

আমি হঠাৎ একটি আশ্চর্য চিঠি দেখে ফেলেছি। এই চিঠিটিকে আর লুকিয়ে রাখা এখন ঠিক হবে না। এখন এটা সবাই দেখতে পারবেন। চিঠিটি লিখেছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ১৯৭৯ সনের জানুয়ারী মাসের ১৩ তারিখে। প্রবাসী কবি ওমর শামসের কাছ থেকে তাঁর কবিতার বই 'খোয়াবনামা' আর কিছু মার্গ-সংগীতের ক্যাসেট হাতে আসার কথা জানিয়েছেন এই চিঠিতে। ওমর শামসের দ্বিতীয় কবিতার বই 'খোয়াবনামা' প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৬-তে (এই খবরটি আমার কিছুদিন আগেও জানা ছিলো না, সে-অজ্ঞতার দায় অবশ্য পুরোপুরি আমারই), তখনই কোনো এক-সময়ে ইলিয়াসের টিকাটুলির বাসায় 'খোয়াবনামা'-সহ আরও কয়েকটি কবিতা শামস নিজেই ইলিয়াসকে পড়ে শুনিয়েছিলেন। ইলিয়াস এই চিঠিতে জানিয়েছেন 'খোয়াবনামা'-র কবিতাগুলি তখন সেই ১৯৮৬ সনে ভাল করে পড়া হয় নি এবং তারপরে জানিয়েছেন একটি বিদ্যুদ্গর্ভ তীব্র সংক্ষিপ্ত সংবাদ যে, তিনি 'খোয়াবনামা' নামে একটি উপন্যাস লিখতে পারেন। বলাই বাহুল্য, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের এবং বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ উপন্যাস 'খোয়াবনামা'-র তখন গর্ভধারণ ঘটে নি। আমরা জানি, এই উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৬ সনে। চিঠির এই ছোট্ট সংবাদটি যেন কঠিন চাবুক চালিয়ে আমার দৃষ্টিকে ফিরিয়ে দিলো ইলিয়াসের উপন্যাসের দিকে নয়, ওমর শামসের কবিতা 'খোয়াবনামা'-র দিকে। ইলিয়াসের কথাটিকে আর মামুলি একটি খবর হিসেবে নিতে পারি না। নিজের উপন্যাসের নাম 'খোয়াবনামা' রাখার জন্য শামসের কবিতা পড়ার কোনো দরকার ছিলো না। 'খোয়াবনামা', 'খাবনামা' কতো কতো গেঁয়ো-ছাপা চটি বই তো কবে থেকে বেরিয়ে আসছে। নিজের উপন্যাসটির নাম দেবার জন্য এ-সব চটি বইয়ের কথা ভাবেন নি, ভেবেছেন ওমর শামসের কবিতা পড়েই। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, 'তোমার অনুমতি নিয়ে রাখলাম। ব্যক্তির খোয়াব কেবল তার নিজের একার সাধ কি গ্লানি, ইচ্ছা কি আশাভঙ্গের কথা নাড়া দিয়ে যায় না, তার পূর্বপুরুষ, তার লুপ্ত পূর্বপুরুষের স্মৃতি, তার সম্প্রদায়ের ঝাপসা অতীত বা অসন্তুষ্ট বর্তমান স্বপ্নে উঁকি দিয়ে যায়'।

এখন আমরা 'খোয়াবনামা' কবিতাটি একবার পড়বো। তাতে কি একটু বোঝা যাবে কবিতাটি পড়ার পরে ইলিয়াস তাঁর উপন্যাস 'খোয়াবনামা' লেখার কথা ভাবতে শুরু করেন, না কি উপন্যাসটি ভেবেই রেখেছিলেন–কবিতাটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাবনা সংকল্পে পরিণত হয়? ওমর শামসের কবিতা শুরু হচ্ছে :

নক্ষত্রের তলে কেউ জেগে নেই,
জেগে নেই কেউ আজ রাতে।
সবাই ঘুমোয় ঢের–স্বনিদ্রায় সব্বাই স্বপ্নে বিভোর।

একটু জীবনানন্দীয় শোনাচ্ছে? তা শোনাক, তুলনার কোন কথাই নেই। দুজনের কবি-স্বভাবই আলাদা। নিবিষ্টতার চেয়ে ওমর শামসের ঝোঁক বিস্তৃত পটে ছড়ানো জীবনযাপনের দিকে। জীবনের দিকে এগিয়ে যান তিনি, একেবারে সামনে, একেবারে ভিতরে চলতে চলতেই স্বপ্নেরা দেখা দেয়, যে আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হতে পারে নি তার স্বপ্ন, যে বাসনা তৃপ্ত হয় না তার স্বপ্ন, চাকা আর স্থিতির স্বপ্ন, চলতে হয় আর থামতে হয়, তৃষ্ণার জল চাই, জলের প্রশান্তি চাই। চারিদিকে স্বপ্নের বুদ্বুদ দেখা দিচ্ছে, মিলিয়ে যাচ্ছে বর্ণিল-মলিন; গৃহহীনের ঘাসের বালিশ চাই বা না জুটলে ইটের বালিশ। তুলোর বালিশ-ও চাই, পালকের বালিশ। স্বচ্ছ চোখের মাঝে ঘুমের জায়গায় স্বপ্নেরা ভেসে বেড়ায়। ওমর শামসের পরিক্রমণ শেষ হতে চায় না–স্বপ্নেরা সম্ভবপরতার সীমা অতিক্রম করে অসম্ভবপর সীমাও অতিক্রম করে। চোর স্বপ্ন দ্যাখে কাঁসার বাটি, মনে পরিতৃপ্তি তার স্বপ্নে স্বপ্নে, ঘটি-বাটি-শাড়ির স্বপ্ন যেনো টাকশাল থেকে বেরুনো চকচকে টাকা! পাহাড়প্রমাণ স্বপ্নের বোঝা সমতল থেকে পাহাড়ে টেনে তুলছে মানুষ-পিঁপড়েরা।

স্বপ্নের বয়ান আর শেষ হতে চায় না। পাতার পর পাতা গড়িয়ে চলে–বারাঙ্গনা, বীরাঙ্গনা মুছে ফেলে ক্ষণ-পুরুষের পুরুষ্ট গোঁফের চিহ্ন। কোথায় সে? কোথায় সে? এ তো সে নয়। শামস ছড়িয়ে যাচ্ছেন। গোটা বাংলাদেশের মুক্ত পুরুষেরা যে আসলে আটকানো মানুষ। কবরের ভিতরে মরছে যে শিশু সে কাঁদতে ব্যস্ত, সে বেরিয়ে আসতে চায়, কনুই আটকায় পাথরে। শিশুদের সামনে বিদ্যুৎ-অবিদ্যুতের খরস্রোতা প্রবাহিণী। রুটি আছে সামনে, হাত পৌঁছায় না। এরপর একটি অসাধারণ চিত্রকল্প : 'বাস্তব সিদ্ধ হয়ে উঠেছে আউশ ধানের মতো'। রৌদ্রময়, ধুলিময়, বৃষ্টিময়, কুয়াশাময় এই বাংলাদেশে ওমর শামস লক্ষ-কোটি স্বপ্ন মাথায় নিয়ে কেবলই ছড়িয়ে যেতে থাকেন :

আমি হেঁটেছি শহরে, মফস্বলে, গ্রামে-গঞ্জে-ঘাটে
গাবতলী, ফতুল্লা, নবাহাট, সাতক্ষীরা,
পীরবান্দা, নিশিধান্দা, কমলকান্দা,
নীলগঞ্জ, চুরুলিয়া, কুতুবদিয়া, দেউলিচর,
সারিয়াকান্দি, শর্ষেবাড়ি, বাঘাপাড়া, নিশিন্দর

আমি হেঁটেছি

ওমর শামসের কবিতা 'খোয়াবনামা'-র একটা মানচিত্র আঁকুন এবং সেটাকে মানুষ দিয়ে ভরিয়ে দিন, স্বপ্নদের কোলাহল শুনতে পাবেন। তার মধ্যে থেকে এক তীক্ষ্ন আর্তি-পিপাসার কান্না আসছে :

সে তো, আহা! স্বপ্ন নয়,
সে দৃঢ় বাস্তব
বেঁচে থাকা
দুটো ভাত
একটি লবণ,
কোটি-কোটি খোয়াবের রুটি তসবীর দানা হয়ে গেঁথে আছে,
হাজার লবণদানা, লক্ষ ভাতের দানা, অনন্ত তন্দুরী।

সবশেষে আজানের প্রসঙ্গ; জিব্রাইল দূতের প্রসঙ্গ। কি রকম মোক্ষম নির্মোহ প্রকাশ : খোয়াবের পবিত্র আয়াত! সংবাদবাহক জিব্রাইল বয়ে নিয়ে যান 'জীবনের খোয়াবের অফুরান ফরিয়াদ' :

নিয়ে যাও, নিয়ে যাও
তাঁহারই প্রশংসার নাম
কোটি-কোটি তন্দুর,
সহস্র সিদ্ধ চাল
সিন্ধু লবণ খচা
রক্তের, মাংশের, মানুষের, মানুষীর অনন্ত তস্বী :
জীবনের খোয়াবের অফুরান ফরিয়াদ!

এইবার গথিক উপন্যাস 'খোয়াবনামা'-র সঙ্গে এই কবিতা মিলিয়ে দেখুন। আপনি শিউরে উঠবেন : একদিকে কবিতার পেলব তনু, আর অন্যদিকে রক্ত-মাংস-পেশি-তন্তু-কঠিন হাড়কাঠামো।

খোয়াবনামা
ওমর শামস

নক্ষত্রের তলে কেউ জেগে নেই,
জেগে নেই কেউ আজ রাতে।
সবাই ঘুমোয় ঢের– স্বনিদ্রায় সব্বাই স্বপ্নে বিভোর।

একা আমি হারুন রশীদ,
গুনছি তস্বি,
তোমাদের খোয়াবের অনন্ত জহরৎ।
স্বপ্ন :
মানে মানুষের যতো সাধ,
তৃপ্ত হতে পারতো এমন কিছু আকাক্সক্ষা,
চাকার জীবন থেকে স্থিতি অথবা
জীবনকে জটিলতর ক'রে তুলবার অবোধ্য বিবেচনা,
জীবনের বাদশার হাতে একটি গোলাপ তুলে দেবার জন্য
জীবনের জুয়াড়ীর সামনে মদ ও যৌবনের যুগল ছক্কার
মাৎ-চাল ছুঁড়ে দেবার জন্য
জীবনের প্রেমিককে অবিভাজ্য পৌনঃপুনিকের মতো
এক অনন্ত হৃদয়িনী পুরস্কার দেবার জন্য
স্বপ্ন
অযুত-অযুত যূথ, স্বপ্ন আজ পৃথিবীর তলে।

স্বপ্ন : ঘাসের বালিশে
স্বপ্ন : ইটের বালিশে
স্বপ্ন : তুলোর বালিশে
পাখির পালকের বালিশে
প্রবাহিত হয়ে চলেছে স্বপ্ন।

সিঁদচোরের কথা বলি :
তার স্বপ্নের মধ্যে ঝলসে উঠেছে কাঁসার বাটি,
কাচের গেলাস, শাড়ি, ঘড়ি।
তার চোখ ঘুমের মধ্যেও চক্-চক্ ক'রে উঠেছে।
খোয়াবে-খোয়াবে সে এখন বড়ো তৈলাক্ত।

শহরের পাহাড়ের মিনারের কাছে গিয়ে দেখেছি,
পিঁপড়ের মতো দেহ তুলনায় সত্তর গুণ
স্বপ্নের বোঝা টেনে উঠোচ্ছে কারা!
কোথায় নিয়ে চলেছো
স্বপ্ন থেকে বাস্তবে,
কল্পনা থেকে ভোগে?

চিনেছি, যতো ধাপ্পাবাজ
ওদের মধ্যে ফতোয়াবাজ রয়েছে
রাজনীতিবাজ রয়েছে
আমলাতান্ত্রিক রয়েছে
মেডেলে-মেডেলে বিমণ্ডিত সমরবাজ তারাও।

একটি মহিলা আয়নায় ঘ'ষে-ঘ'ষে তুলেছে ক্ষণিক পুরুষের স্মৃতি,
দৌড়ে-দৌড়ে উঠেছে সাফা আর মারোয়ার পাহাড়ে,
ঢিল ছুঁড়ে-ছুঁড়ে বলেছে, চ'লে যাও! চ'লে যাও।

বৃষ্টির মতো নেমেছে আবার
ময়ূরকে জিজ্ঞাসা করেছে, কই সে?
হরিণকে জিজ্ঞাসা করেছে, কই সে?
সুপদ্ম চোখ দুটি নিজে-নিজে নিজেকে অবিশ্বাস ক'রে ডুকরে উঠেছে,
এই সেই নয়, হায়! এই সেই নয়!

একটি শিশু জেগে উঠেছে কবরের থেকে।
চীৎকার ক'রে উঠেছে,
কেননা পাথর ঠেকেছে তার কনুই-এ,
সে কিছুতেই হাত বাড়াতে পারছে না
এক টুকরো রুটির দিকে।

দুশো শিশু জেগে উঠেছে,
তাদের সামনে নদী।
দু-হাজার শিশু চীৎকার ক'রে উঠেছে,
দু-লক্ষ শিশু চীৎকার ক'রে উঠেছে ,
পথে-পথে বিদ্যুতের তরবারি।
ওরা হাত বাড়াতে পারছে না এক টুকরো রুটির দিকে।
বাস্তব সিদ্ধ হয়ে উঠেছে আউষ ধানের মতো,

কখনো কখন
দৃপ্ত স্বপন
ঝল্সে উঠেছে
ঝল্সে উঠেছে
রুটির মতোন।

কোথাও বাজছে স্বপ্ন
সফেদ ফেরেশতার কন্ঠে সদ্যনাজিল একটি সবুজ আয়াতের মতো।
মানুষটি শুয়ে আছে ফিরোজা ঘাসে
সে না কি বিলিয়ে দিয়েছিলো তার
সমস্ত খয়েরী বাস্তব এবং ময়ূরকণ্ঠনীল স্বপ্ন।

পোষা পাখি যেন, খোয়াব ফিরেছে তবু ঘরে,
উচ্চকন্ঠ হয়েছে গোলাপী আয়াতের মতো–
ভিড় জমেছে সফেদ ফেরেশতাদের।

আমি হেঁটেছি শহরে, মফস্বলে, গ্রামে-গঞ্জে-ঘাটে–
গাবতলী, ফতুল্লা, নবাহাট, সাতক্ষীরা,
পীরবান্দা, নিশিধান্দা, কমলকান্দা,
নীলগঞ্জ, চুরুলিয়া, কুতুবদিয়া, দেউলিচর,
সারিয়াকান্দি, শর্ষেবাড়ি, বাঘাপাড়া, নিশিন্দর

আমি হেঁটেছি–

নবাবপুরের বাস্তহারাদের শিথানে গিয়েছি
ফকিরাপুলের নবাবদের শিথানে গিয়েছি
কুড়িয়ে-কুড়িয়ে এনেছি স্বপ্ন।

সাতমাথা, দড়াটানা, নলিনীকান্ত রোড
সবখানে লেখা আছে আমার পায়ের দাগ
দরোজায়-দরোজায় হাতের মোহর।
শরৎকুটির, ১২৭ নং হাজী মহসিন রোড,
রওশন-মঞ্জিল, কালীতলা, চুয়াডাঙ্গা, সদর যশোর।
যে সড়কের কোন নাম নেই
যে রাস্তার কোন নম্বর নেই
হেঁটে-হেঁটে পৌঁছেছি
যে বাড়ির কোন ঠিকানা নেই
দরোজা নেই, জানালা নেই, বিছানা নেই, বালিশ নেই।

গেঁথে-গেঁথে নিয়ে এসেছি তোমাদের অনন্ত স্বপ্নাবলী,
জামায়-জামায় জমা মানুষের নামাবলী
তস্বীতে খোয়াবের বেশুমার দানা।
আমি গুনছি :
স্বাধের স্বপ্ন আছে
সুখের স্বপ্ন আছে
প্রেমের স্বপ্ন আছে
লোভ-ভোগ, গতি-উন্নতি সে-ও।

কিন্তু গুনে গুনে গুণফলে যে স্বপ্ন সবচেয়ে বেশি,
সে তো, আহা! স্বপ্ন নয়,
সে দৃঢ় বাস্তব
বেঁচে থাকা
দুটো ভাত
একটি লবণ,

কোটি-কোটি খোয়াবের রুটি তসবীর দানা হয়ে গেঁথে আছে,
হাজার লবণদানা, লক্ষ ভাতের দানা, অনন্ত তন্দুরী।
ভোর হচ্ছে,
মুখর হয়েছে আবাবিল পাখিরা।
মিনারে-মিনারে আজান,

আমি প'ড়ে চ'লেছি তোমাদের খোয়াবের পবিত্র আয়াত।
সফেদ ডানার জিব্রাইল,

কোথায় ছুটেছো?
নিয়ে যাও, নিয়ে যাও
তাঁহারই প্রশংসার নাম
কোটি-কোটি তন্দুর,
সহস্র সিদ্ধ চাল
সিন্ধু লবণ খচা
রক্তের, মাংশের, মানুষের, মানুষীর অনন্ত তস্বী :
জীবনের খোয়াবের অফুরান ফরিয়াদ!