কক্সবাজার পৌরসভা নির্বাচনের দেড় বছর পরও দায়িত্ব পাচ্ছেন না নির্বাচিত মেয়র-কাউন্সিলররা

সাগর পাড়ের পাখি
Published : 2 August 2012, 06:36 PM
Updated : 2 August 2012, 06:36 PM

নির্বাচিত হওয়ার দেড় বছর পরও দায়িত্ব নিতে পারছেন না কক্সবাজার পৌরসভার নির্বাচিত মেয়র-কাউন্সিলররা। নানা অজুহাতে মামলা করে তাদের শপথ ঠেকিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১১ বছর আগের নির্বাচিত পৌর পরিষদ দিয়েই চলছে কক্সবাজার পৌরসভা। এতে পৌরসভার স্বাভাবিক কার্যক্রম ভেঙ্গে পড়ার পাশাপাশি পৌরবাসী, বিশেষ করে বর্ধিত পৌর এলাকার বাসিন্দারা নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পৌরবাসীদের অভিযোগ, বর্তমানে পৌরসভার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যাপক লুটপাট চলছে!

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কক্সবাজার পৌরসভার নির্বাচিত পরিষদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায় ২০০৭ সালে। এরপর নির্বাচনের জন্য কয়েক দফায় তফসিল ঘোষণা করা হলেও উচ্চ আদালতে মামলা করে ঠেকিয়ে দেয় একটি স্বার্থান্বেষি মহল। এভাবে বেশ কয়েকবার তফসিল ঘোষণা এবং মামলা করে ঠেকানোর পর অনেক চড়াই উৎরায় শেষে ২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি বহুল আকাঙ্খিত নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে একজন মেয়র, ১২ ওয়ার্ডের ১২ জন সাধারণ এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের আরো ৪ জন মহিলা কাউন্সিলর নির্বাচন করেন কক্সবাজার পৌরবাসী।
কিন্তু ওই নির্বাচনেরও প্রায় দেড় বছর পার হলেও নির্বাচিত পরিষদ এখনও দায়িত্বভার গ্রহণ করতে পারেননি। এতে প্রায় ১১ বছর আগের নির্বাচিত পরিষদ দিয়ে এখনও চলছে কক্সবাজার পৌরসভা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমান পৌর পরিষদ নির্বাচিত হয় ২০০২ সালের ১৫ জুন। এই পরিষদের মেয়াদ প্রায় ৫ বছর আগেই অতিবাহিত হয়ে যায়। তারও প্রায় ৬ বছর পর পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নতুন উদ্যমে পৌরবাসি তাদের 'প্রিয়' মেয়র ও কাউন্সিলরদের নির্বাচিত করেন।

সূত্র মতে, মামলা 'চক্রান্তে' পরে নবনির্বাচিত মেয়র কাউন্সিলরা এখনও শপথ নিতে না পারার সুযোগে নির্দিষ্ট মেয়াদের দ্বিগুণেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় রয়ে গেছেন আগের পৌর পরিষদ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্টরা ও এলাকাবাসী জানান, বর্তমানে পৌরসভার উন্নয়ন কার্যক্রমে ব্যাপক 'পুকুর চুরি'র অভিযোগ উঠছে। অন্যদিকে পৌরবাসী বিশেষ করে বর্ধিত পৌর এলাকার লোকজন নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ১১ বছর আগের নির্বাচিত পরিষদ এখনও ক্ষমতায় থাকায় পৌরসভার স্বাভাবিক কার্যক্রমও প্রায় ভেঙ্গে পড়েছে। একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে চলেছে কক্সবাজার পৌরসভা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন নির্বাচনে পরাজিত পক্ষই প্রতিহিংসামূলকভাবে মামলা করে নির্বাচিতদের শপথ ঠেকিয়ে দিয়েছেন। এতে নির্বাচিত নতুন পরিষদ দেড় বছরেও দায়িত্ব নিতে পারেননি।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, নতুন নির্বাচিত পরিষদের বেশিরভাগই বিরোধী দল সমর্থক হওয়ায় শপথ ঠেকিয়ে দেওয়ার এই ঘটনায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসাও কাজ করছে। মামলাবাজরা সরকারের উচ্চ মহলের সহযোগিতা পাচ্ছে।

এ ব্যাপারে কক্সবাজার পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত কাউন্সিলর এসআইএম আকতার কামাল সাংবাদিকদের বলেন, 'নির্বাচনের দেড় বছর পরও দায়িত্ব নিতে না পেরে আমরা হতাশ। শুধু আমরা নয়, পুরো পৌরবাসিই হতাশ।'

তিনি মনে করেন, যারা দীর্ঘদিন ধরে পৌরসভার আকাঙ্খাকে দমিয়ে রাখছে, তারা কেবলই ঘৃণা কুড়াচ্ছে।

সংরক্ষিত ১, ২ ও ৩ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলার হুমাইরা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, 'নির্বাচনের এক বছরেও সরকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ করাতে পারছে না। অথচ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে।'

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা সাংবাদিকদের বলেন, 'পৌরবাসীর আশা ছিল নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন পরিষদ নতুন উদ্যমে পৌরসভার উন্নয়ন কাজ করবে। কিন্তু আইনি অস্ত্রে দীর্ঘ সময় ধরে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে 'জনরায়'।'

তিনিও মনে করেন, 'যারা নির্বাচিত পরিষদের শপথ ঠেকিয়ে রাখছে, তারা গণতন্ত্র ও জনগণের বিরুদ্ধে কাজ করছে।'

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, কক্সবাজার সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি প্রফেসর এম এ বারী সাংবাদিকদের বলেন, শপথ ঠেকিয়ে রাখা শুধু অগণতান্ত্রিক নয়, মানবাধিকারেরও লংঘন।'

একাধিক নবনির্বাচিত কাউন্সিলার অভিযোগ করেছেন, 'পুরনো ও পরাজিত কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধি পৌরসভায় লুটপাটের উদ্দেশ্যে মামলা করে শপথ ঠেকিয়ে রেখেছেন। আর এতে সহযোগিতা করছে সরকারের একটি অংশ।'

কক্সবাজার পৌরসভার নবনির্বাচিত মেয়র সরওয়ার কামাল বলেন, 'নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অধিকাংশই বিরোধী দল সমর্থক হওয়ায় সরকারের আইন মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় কুচক্রি মহল প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে শপথ ঠেকিয়ে রেখেছে।'

তবে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দিলে দ্রুত শপথ গ্রহণ করানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

কক্সবাজার সদর-রামু আসনের সংসদ সদস্য লুৎফুর রহমান কাজল সাংবাদিকদের বলেন, 'কক্সবাজার পৌরসভার শপথ অনুষ্ঠান এক বছরেও সম্পন্ন করাতে না পারা গণতন্ত্রের প্রতি এই সরকারের অশ্রদ্ধার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। এতেই বুঝা যায় আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। তারা এক দলীয় বাকশালে বিশ্বাস করে।'

তিনি অবিলম্বে নতুন পৌর পরিষদকে শপথ পড়িয়ে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার দাবি জানান।

উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি কক্সবাজার পৌরসভার বহুল আকাঙ্খিত নির্বাচনে চারদলীয় জোট সমর্থক প্রার্থী সরওয়ার কামাল মেয়র নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থী মুজিবুর রহমান নিকটতম প্রতিদ্বন্ধি এবং আওয়ামী লীগ নেতা রাশেদুল ইসলাম তৃতীয় স্থান লাভ করেন।

এছাড়াও কাউন্সিলার পদে ১নং ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থিত আকতার কামাল, ২নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থক মিজানুর রহমান, ৩নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থক মাহবুবুর রহমান (পূনঃ নির্বাচিত), ৪নং ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থক সিরাজুল হক (পূনঃ নির্বাচিত), ৫নং ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থক সালামত উল্লাহ বাবুল, ৬নং ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থক ওমর ছিদ্দিক লালু, ৭নং ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থক আশরাফুল হুদা ছিদ্দিকী জামসেদ (পূনঃ নির্বাচিত), ৮নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থক রাজবিহারী দাশ (পূনঃ নির্বাচিত), ৯নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থক হেলাল উদ্দিন কবির, ১০নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থক সাইফুদ্দিন খালেদ, ১১নং ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থক রফিকুল ইসলাম (পূনঃ নির্বাচিত) ও ১২নং ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থক জিসান উদ্দিন জিসান এবং সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ১, ২ ও ৩নং ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থক হুমাইরা বেগম, ৪, ৫ ও ৬নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ চম্পা উদ্দিন (পূনঃ নির্বাচিত), ৭, ৮ ও ৯নং বিএনপি সমর্থক মনজুমন নাহার মনজু এবং ১০, ১১ ও ১২নং ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থক কোহিনূর ইসলাম নির্বাচিত হন।