পথের কুকুরকে খেতে দেন দিনমজুর ফরিদা

নওশাদ আনসারী
Published : 20 Sept 2021, 11:54 AM
Updated : 20 Sept 2021, 11:54 AM

গল্পটি সৈয়দপুরের নিঃস্ব এক নারীর। যার কেউ নেই, থাকেন একা। দিনমজুরির উপার্জনের টাকা খরচ করে প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ৩০টি কুকুর-বিড়ালকে খাইয়ে আসছেন। এই প্রাণীপ্রেমের কারণে পাড়ার মানুষ তাকে নাম দিয়েছে বিলাইদাদী।

ফরিদা বেগম (৫৮)। সৈয়দপুর হাতিখানা মহল্লায় রেললাইনের ধারে জরাজীর্ণ একটি বাসায় ভাড়ায় থাকেন। সকাল থেকে বিভিন্ন হোটেলে করেন দিনমজুরি। স্বামী ইসমাইল মারা গিয়েছে সেই ৩০ বছর আগে। স্বামী মারা যাবার কয়েক বছর পর দুই ছোট ছেলের মধ্যে একটি ছেলে মারা যায়; আরেকটি যায় হারিয়ে। তখন থেকেই নিঃস্ব হয়ে চলার দিন শুরু ফরিদা বেগমের। তবে এখন তিনি নিঃস্ব নন, কুকুর-বিড়ালদের নিয়ে তার রয়েছে মমতার পরিবার।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর  রাত সাড়ে ১১টায় শহরের ক্যান্টনমেন্ট সড়কে দেখা মেলে ফরিদা বেওয়ার। তাকে চারপাশে  ঘিরে আছে কয়েকটি কুকুর। দূর থেকে সেই মায়ের ছায়া দেখে কিংবা কণ্ঠ শুনে ছুটে আসছে অন্য কুকুরগুলোও। হণ্যে হয়ে ছুটে আসা কুকুরেরা নতজানু হয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে সেই মায়ের গলায়। একে একে খাবার খাইয়ে কুকুরগুলোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন তিনি। এক অপূর্ব ভালোবাসার মেলবন্ধন দেখা গেল সেই মা আর কুকুরের মাঝে।

রান্না করে আনা খাবার এক এক করে সব কুকুরের সামনে কাগজ রেখে খাইয়ে দিলেন ফরিদা বেগম। এমন দৃশ্য পশ্চিমের দেশগুলোতে বিরল না হলেও আমাদের সৈয়দপুরে ছিল অকল্পনীয়।


রাত ১১টার পর তাকে প্রতিদিন এভাবে দেখা যায় কয়েক ব্যাগ ভর্তি রান্না করা খাবার নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন পথের কুকুরকে খাওয়াতে। আর এই ধারা চলছে গত ২০ বছর থেকে।

কয়েক মাস আগের কথা; প্রতিদিনের মত রান্না করে খাবার নিয়ে রাতে বেরিয়েছিলেন ফরিদা বেগম। বাস টার্মিনালে দলবেঁধে থাকা কুকুরগুলোকে খাওয়াচ্ছিলেন তিনি। তখন সাতটি কুকুরের মধ্যে উপস্থিত ছিলো ছয়টি কুকুর। পরের দিন আবার গেলেন খাবার নিয়ে, কিন্তু সেই একটি কুকুর কম। খোঁজাখোঁজি করলেন অনেক। আশপাশের লোকজন থেকে জানা গেল, চলন্ত ট্রাকের নিচে পড়ে একটি কুকুর মারা গিয়েছে। তখন ফরিদা বেগম সেখানেই কান্নাকাটি করে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন। থানা পর্যন্ত গিয়েছিলেন সেই ট্রাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে।

এসব কথা বললেন ফরিদা বেগমের সাথে হোটেলে কাজ করা শাহিন (৩২)।


আশরাফ হোটেলের মালিক আশরাফ বলেন,  "বহু বছর থেকে সে আমার হোটেলে কাজ করে আসছে। সবজি কাটা, ডাল বাটা সহ অন্যান্য কাজ করে দেন তিনি। প্রতিদিন তাকে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা দেওয়া হয়।

"কিন্তু প্রতিদিনিই তিনি সেই টাকা দিয়ে রাতে মাছ, তরকারি-চাল কিনে বাসায় রান্না করে রাতে বেরিয়ে যান বেওয়ারিশ কুকুরদের খাওয়াতে। তিনি কোনো টাকায় জমা রাখেন না। সব এই বেওয়ারিশ কুকুরগুলোকে খাওয়াতেই ব্যয় করে দেন। উনার ঝুপড়িতেও চার-পাঁচটি বিড়াল সব সময় থাকে। তার নিজের কোনো বাড়ি নেই। কোনো বয়স্ক কিংবা বিধবা ভাতা পান না তিনি। এই মজুরির টাকা দিয়েই তিনি ওই বেওয়ারিশ কুকুরগুলোকে আগলে রেখেছেন।"

কথা হলো ফরিদা বেগমের সাথেও।

তিনি বললেন, আপন বলতে বর্তমানে তার কেউ নেই এখন। এই কুকুর-বিড়ালগুলোকে সাথে নিয়েই পার হয়ে যাচ্ছে বাকি দিনগুলো।

"এদের পেট ভরতে বেশির ভাগ সময় ব্যয় হয়। দিনের বেশি ভাগ সময় বিভিন্ন হোটেলে কাজ করি। সন্ধ্যায় যখন মজুরি পাই তখন সে টাকা দিয়ে চলে যাই বাজার করতে। বাজার করে বাসায় রান্না করি। আবার রাতে বেরিয়ে পড়ি কুকুরদের খাওয়াতে। কিছু টাকা রাখি বাড়ি ভাড়া দিতে হয়। স্বামী-ছেলে-মেয়ে কেউ নেই।"

এভাবে নিজের হোক বা না হোক রান্না করে কুকুরের জন্য ঠিকই খাওয়ার ব্যবস্থা করেন তিনি প্রতিদিন।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সারদেশে জারি করা বিধিনিষেধে বেশিভাগ রেস্তোরাঁ, বেকারি বন্ধ থাকায় খাবার পাচ্ছিল না এসব বেওয়ারিশ কুকুরগুলো। অথচ এই কুকুরগুলোই উচ্ছিষ্ট খেয়ে শহরকে পরিষ্কার রাখে। তাই মানুষের পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় প্রাণীকূল রক্ষা করাও জরুরি। এমন চিন্তা থেকেই তিনি প্রতিদিনি এসব কুকুরগুলোর জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা করে আসছেন।

একটু আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, "সরকার সবাইকে বাড়ি দিচ্ছে, যদি একটা বাড়ি আমাকেও দিত।"

উপার্জনের টাকা কুকুরকে খাওয়াতে খরচ করে ফেললেও তা নিয়ে আফসোস করেন না ফরিদা।

তিনি বললেন,  "এই প্রাণীগুলোর পেট ভরলেই মন ভরে আমার।"