ও মানে একটা সাংঘাতিক, সিংহের বাচ্চার মতো

লীনু বিল্লাহ
Published : 24 Jan 2012, 06:14 AM
Updated : 6 July 2020, 06:15 PM

আমার সঙ্গে এন্ড্রু কিশোরের পরিচয় ১৯৭৯-৮০ সালের দিকে। আমরা দুই জনই ছিলাম। প্রথম দর্শনেই আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমিও ‍ওকে জড়িয়ে ধরলাম। এরপর থেকে ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব যে শুরু হল, তা ছিল সব সময়। আমাদের দেখা কিন্তু কম হতো।

কোনো কোনো সময় স্টুডিওতে প্রচুর আড্ডা মারতাম আমরা । ওর গান কি বলবো! অসাধারণ গানের কণ্ঠ। এটাই ওর অন্যন্যতা।

এরকম গানের কণ্ঠ আর বাংলাদেশে আসবে না; অন্তত ফিল্মের ক্ষেত্রে। এটা গড গিফটেড।

গানের ভক্তও আমি। তার গানটা আমি সব সময় গাই– হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস…।

ওর সঙ্গে অনেক স্মৃতি। এরমধ্যে দুয়েকটা অকেশনে ওকে নিয়ে আমি চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম। সেখানে আমরা খুব মজা করেছি। ও গাইল, আমরা গাইলাম।

সেখানে হানিফ সংকেত ছিল, অনেকে ছিল। আইয়ুব বাচ্চু ছিল, তখন কিন্তু আইয়ুব বাচ্চু এতো নাম করে নি।

দশ বছর আগে এন্ড্রু কিশোরসহ আমরা গেলাম বগুড়াতে। সেখানেও বেশ মজা হয়েছিল। এখনকার অনেকে ছিল সেখানে।

বাইরের অনুষ্ঠান করা হতো আমরা বেশ। মাঝে মাঝে ওদেরকে নেওয়া হতো।

গত বছর হঠাৎ বেশ অসুস্থ হয়ে গেলো এন্ড্রু কিশোর। তখন সাভারে ওকে দেখতে গেলাম। সেটাই আমার সঙ্গে তার শেষ দেখা।

তখন এন্ড্রুকে আমি জিজ্ঞেস করলাম- এন্ড্রু আপনি এতো শুকিয়ে গেলেন কেন? উত্তরে বললো- "না, না। আমার কিছু হয় নি। আমি ভালো আছি, ভালো আছি।"

এন্ড্রুর ছাত্রের মাধ্যমে আমি সব সময় খবর রাখতাম। ছাত্রের কাছে শুনতাম- ওর ২২ কেজির মতো ওজন কমে গেছে। কেয়ার করতে বলতাম। জানলাম, বিরাট অসুস্থ ও।

পরে আর দেখা হয় নি। সিঙ্গাপুরে গেল। ৯ সেপ্টেম্বর আমিও অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। আমারও ওপেন হার্ট সার্জারি হল। কিন্তু ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ হচ্ছে।

খোদার রহমতে আমি ভালো হয়ে গেলাম। এখন ভালো আছি আমি। প্রচুর গানও করছি।

এন্ড্রু তো অসুস্থ বেশ। মাঝখানে শুনলাম উন্নতি হচ্ছে। সিঙ্গাপুরেও গেল। চিকিৎসকরা ঢাকায় পাঠাল। এরই মধ্যে করোনাভাইরাস মহামারী শুরু হয়ে গেল। আসি আসি করে ঢাকা আসা হল না। তখনই খারাপ হয়ে গেল ওর শরীরও।

গত মাসে আমরা আতঙ্কিত হয়ে গেলাম ওকে নিয়ে। … আমি শুধু একদিন ওর সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলাম। ও বললো- ক্যান্সার আক্রান্ত হয়েছে। পরবর্তীতে ও আর ফোন ধরতো না।  অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। রাজশাহীতে চলে যাবে। ও জানতো…ও আর থাকবে না। এটা আমাদের সম-সাময়িককালের স্মৃতি।

প্রায় আমার বাসায় আসত ও। আমরা গান-বাজনা করতাম। রেকর্ডিং করতাম।

৪০-৪২ বছর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি কাঁপিয়ে বেড়িয়েছে এন্ড্রু। ওকে বিট করার মতো কেউই ছিল না। একমাত্র হাদী ভাই ছিল। হাদী ভাইয়ের ক্লাস ছিল অন্যরকম।

এন্ড্রু কিশোরের ক্লাস!  এন্ড্রু মানে সাংঘাতিক। একটা কথা বারবারই বলতে হয়- ওকে কিন্তু লোকে চিনত না। টেলিভিশনে আসতো না খুব বেশি একটা। এখন যেরকম প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানে, প্রত্যেকটা মিডিয়াতে সব শিল্পী গায়; এদিক দিয়ে ওকে কিন্তু কেউ খুব নিতে পারে নি।

সে ব্যাপারে খুব একটা চুজি ছিল ও। ফেইম আর নেইম এর ব্যাপারে অন্যরকম ছিল ও। মিডিয়াতে যাবো, আমাকে যেন পারিশ্রমিকটা ওরকম দেয়। ও মানে একটা সাংঘাতিক। সিংহের বাচ্চার মতো। যে জিনিসটা বাংলাদেশের অন্য কোনো শিল্পী করেনি। করতে পারবেও না।

গত বছর একটি টেলিভিশনে একটা প্রোগ্রাম করেছিল। ও সেই রকম পারিশ্রমিক নিয়েছিল। সেটা মাইলস্টোন হয়ে থাকবে। বড় প্রোগ্রাম করেছিলাম, বড় টাকা দিয়েছিল।

ওর এ পার্সোনালিটির জন্য আমি ওকে খুব পছন্দ করতাম।

যে রকম গাইত, সে রকম পার্সোনালিটিও ছিল।

এটা ও কেয়ার করতো সাংঘাতিকভাবে। ও বলতো- লিনু ভাই, আমি কিন্তু ভালো চাকরিও পেয়েছিলাম। গানের ক্যারিয়ারের আগে চাকরিতে ভালো পেতাম। গানের মাধ্যমে আমি ভালো করতে পারি; তাহলে চাকরির চেয়ে ১০/১৫ গুণ বেশি আয় করতে পারবো। ওটাই ওর টার্গেট ছিল।

কিন্তু দুঃখের বিষয়- ওর জীবনের যেসব সঞ্চয় ছিল পুরোটাই খরচ হয়ে গেল এ রোগটার জন্য। অনেক টাকা খরচা হয়ে গেছে।

আধুনিক বাংলা গানের জন্য হিট গানের জন্য কোটি কোটি দর্শক-শ্রোতা ওকে ভুলতে পারবে না। অসাধারণ শিল্পী। কেউ ওকে ভুলতে পারবে না। ভারতের বিখ্যাত শিল্পী রাহুল দেব বর্মণ ওর গান শুনে বলছিল, এন্ড্রু তুই চলে আয়। বোম্বে চলে আয়, এখানে এলে চিন্তাও করতে পারবি না। ও বলেছিল আমি যাব না।

এন্ড্রুর ক্যাটাগরির শিল্পী কিন্তু বোম্বেতে নেই। বাংলাদেশে তো নেই-ই।

ও যদি রাহুল দেব বর্মণের সঙ্গে ওই ব্যাপারে সম্পৃক্ত হতে পারতো তাহলে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশের মধ্যে এক নম্বর শিল্পী থাকতো এন্ড্রু; কিশোর কুমার মারা যাওয়ার পরে আর কি!

এন্ড্রুকে হারিয়ে এখন রাতে তো ঘুম হবে না।

তার সঙ্গে আমার বিরাট একটা সম্পর্ক ছিল।

সংগীতের দিক দিয়ে ও আমার থেকে দুইশ মাইল এগিয়ে ছিল। কিন্তু ও আমাকে ভীষণ সম্মান করতো। কারণ, বয়সে আমি একটু সিনিয়র। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ও আমাকে খুব পছন্দ করতো।

আজ থাক।

****

অনুলিখন: মঈনুল হক চৌধুরী