ক্ষুধা, যৌবন ও সোনালি স্বপ্নের এক জ্বলন্ত প্রিজম

ঝর্না রহমান
Published : 3 Nov 2013, 12:54 PM
Updated : 3 Nov 2013, 12:54 PM

কবি কামরুল হাসান কবিতায় একজন বহুকৌণিক শব্দকারিগর। আধুনিক রূপকল্পনার কার্পাশ চয়ন করে তিনি মগ্ন চৈতন্যের মাকু চালনা করেন উষ্ণ স্ফূরিত শব্দের বুনটে। টানা আর পড়েন–পড়েন আর টানার ভেতর দিয়ে কবিকল্পনার আকাশগঙ্গা থেকে ঢুকে পড়ে অসংখ্য নক্ষত্রপ্রসূত শব্দকলা। আধুনিক কবিতার তীব্র তীক্ষ্ণ টানটান অবয়বের ভেতর আদিম চাষার মত ধারালো খনক হাতে কবির সন্ধিৎসু চারণা। কামরুলের কলম নিপুণ খননে উত্তোলন করে আনে প্রত্ন নগরের কোষাগারে সংরক্ষিত রাজকীয় মুদ্রা থেকে শুরু করে কামারশালার ফসিল ভস্ম থেকে চিত্রিত মৃৎপাত্রের টুকরোর মতো শব্দ, শব্দচিত্র। এই সব শব্দধনুকে জ্যা যোজনা করে উত্তরাধুনিক প্রতিকল্পনার উড়ন্ত ঘুরন্ত দুরন্ত পাখিটির চোখে বিদ্ধ করেন অর্জুনীয় তীর।

রূপকল্পনা এবং প্রতিকল্পনার বহুকৌণিক চিত্রময়তার মধ্যে কবি কামরুল হাসান স্থাপন করেছেন তাঁর ঈশ্বরের নিজ গ্রহ কাব্যগ্রন্থটি। এ গ্রন্থের দেড় শতাধিক পঙ্ক্তির একটি দীর্ঘ কবিতা 'বাঘ ও হরিণী উপাখ্যান'। দৈর্ঘ্য এ কবিতার বিশেষত্ব নয়। বিশেষত্ব যোজিত হয়েছে এর কাব্যময়তায়। নির্মাণকলায়, বাস্তব আর পরাবাস্তবতার অদ্ভুত ঘোরময়তার ভেতরে রূপক আর চিত্রকল্প সংযোজনায়। ডোরাকাটা বাঘের জমকালো চিত্রের বর্ণবিভার কুহকী ছটায়, স্বর্ণাভ স্বপ্নের রূপকে চিত্রল হরিণীর উল্লম্ফনের নাটকীয়তায়, ঝাঁঝালো ভেষজের মতো উপমার মদির ঘ্রাণে, শিকারীর ধনুকের ছিলা থেকে টংকার তুলে বেরিয়ে আসা তীক্ষ্ণ তীব্র শব্দের অনুরণনে কবিতাটি চেতনায় এক অদ্ভুত শিহরন আর বশীকরণের আচ্ছন্নতা ঘনিয়ে তোলে।
কবিতায় কবি বাঘ আর হরিণকে চিরকালের খাদক আর খাদ্যের তুলনার বৃত্ত থেকে বের করে এনে বহুকৌণিক আলো ফেলে বহুমাত্রিক অর্থপ্রসূ নান্দনিকতায় স্থাপন করেছেন।

একটি ঘূর্ণায়মান আলোকময় প্রিজমের মতো 'বাঘ' আর 'হরিণ' বারবার রূপময়তা অর্থময়তা ভাব অনুভূতি আর স্বপ্নের বহুবর্ণিল বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে চলে। একক রঙ থেকে মিশ্র রঙে, ভাবনা থেকে বিশ্বাসে, বিশ্বাস থেকে দ্বন্দ্বময়তায়, বাস্তব থেকে স্বপ্নমগ্নতায়, তীব্র অনুভূতি থেকে অদ্ভুত ঘোরময়তায় চলে তার রূপান্তর আর পরিবর্তন। পলকাটা হীরের ওপর আলো পড়লে যেমন বারবার বদলে যায় রঙ আর রঙের সাংগঠনিক উদ্ভাস এ কবিতায়ও কবিকল্পনা বারবার বহুবর্ণিল ঘনকের মতো বিচিত্র রঙে বদলে গেছে। ধারণা বদলে গেছে বিশ্বাসে, বিশ্বাস বদলে গেছে বিস্ময়ে, বিস্ময় রূপান্তরিত হয়েছে স্বপ্নে আর স্বপ্ন ঢুকে গেছে রহস্যময়তায়।

বাঘ– দুরন্ত দুর্মদ প্রবল পরাক্রান্ত শক্তিময়তার প্রতীক। সে রাজা। পুরুষকারের শৌর্য তার চলনে গর্জনে বিক্রমে আক্রমে। ক্ষুধা তার অসীম। খাদ্য তার সব কিছু। মাংস-রূপ-সৌন্দর্য-আনুগত্য– সব। এ কবিতায় বাঘ এসেছে এক বহুবিস্তারী পরাক্রম আর শক্তির রূপকে। এই বাঘ একাধারে রিরংসাময় পুরুষ, পরাক্রমশালী শাসক, আর যৌবনাগ্রাসী প্রেমিক। বাঘের ক্ষুধা সর্বগ্রাসী। সর্বগ্রাসী ক্ষুধা হলেও যা তা খাদ্য তার মুখে রুচবে না। প্রাণীজগতের শ্রেষ্ঠ রূপকুমারী অপূর্ব সৌন্দর্যে চোখ ধাঁধানো বিদ্যুল্লতা হরিণী তার রসনাকে ভরিয়ে তোলে কাব্যময় আঘ্রাণে, মদির রসে।

হরিণীর পিছু পিছু ছুটে বেড়ানো বাঘ তার চারপাশে প্রজ্জ্বলিত করে দেয় চোখ ধাঁধানো বিক্রম। ক্ষুধার সাথে জ্বলে ওঠে ক্রোধ, জীগিষা, রিপুকম্পন। এ ক্রোধ শক্তিমানের। এ লিপ্সা পুরুষের। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসী ক্ষুধাও একই সাথে যুক্ত হয়ে জ্বলে ওঠে বাঘের ক্ষুধায়। চাই শ্রেষ্ঠ দখল। চাই তাকে, যাকে পাওয়া যাবে, খাওয়া যাবে, ছোঁয়া যাবে, থাবায় কবলিত করা যাবে, লীলাখেলায় চালিত করা যাবে, উদরস্থ করার আগে সিক্ত রসনায় রসগ্রহণের মুগ্ধ শীৎকারে পরিপার্শ্ব আন্দোলিত করা যাবে, তারপর আয়েশে আশ্লেষে আপাদমস্তক গ্রাস করা যাবে। তাকে চাই। সে এক স্বর্ণময়ী হরিণী। কবি কামরুল তাঁর কবিতায় এই হরিণীকে স্থাপন করেছেন সৌন্দর্য স্বপ্ন যৌবন সুধা আর মধুর বাসনার অনুপম প্রাণতরঙ্গের এক সম্মিলিত রূপকল্পনা হিসেবে।

লালসার কাছে এই হরিণী এক মদির মাংসের উদ্ভাস, পরাক্রান্তের কাছে ধাবমান বিজয়, ঈশ্বরের সাজানো বাগানে এক অপূর্ব রূপময়ী নারীর জেল্লা, আর প্রেমিক পুরুষের কাছে স্ফূরিত কম্পিত আলোকময় বর্ণময় এক স্বপ্ন। এ স্বপ্নের আছে এক জোড়া আশ্চর্য উড়াল পাখা। তাকে দেখা যায়, ধরা যায় না।

বাঘ ও হরিণী উপাখ্যান-এ কবি এই দুই জেল্লাময় গতিময় তীব্র সৌন্দর্যের প্রাণীকে পাঠকের দৃষ্টির সামনে নিয়ে আসেন একাধারে শক্তির প্রচণ্ডতায় আর স্বপ্নের রোমাঞ্চে। কিন্তু বাঘের শক্তি যখন নিঃশেষিত পরাক্রম যখন অস্তাচলগামী, বিক্রম যখন বার্ধক্যের বৃত্তে বসে হাঁপায় তখন ক্ষুধাই গ্রাস করে ফেলে তাকে। বয়সের ভারে পর্যুদস্ত, দুর্বল, বিগত যৌবন আর পরাহত বিক্রমে কাহিল ব্যাঘ্র মহাশয়ের গায়ে তখন সাধুর নামাবলি। ভূমি দাপিয়ে বন কাঁপিয়ে বেড়ানো প্রবল পরাক্রমশালী শক্তি তখন যৌবন-উদ্ভাসিত হরিণী দেখেও গাছের কোটরে গিয়ে মুখ লুকোয়। শক্তিহীন 'শক্তি'র এমনই একটি প্রতিচিত্র দিয়ে কবি শুরু করেন তাঁর কবিতা–

বয়স হলে বাঘের হরিণপ্রীতি খুব কমে যায়
বাঘ আর শিকারে কি সেভাবে তাকায়?
যেভাবে দেখতো যৌবনে হরিণীর চকচকে দেহ
হরিণীগাত্রের রেখা বাঘমনে জাগাতো বিদ্রোহ
এখন বয়সকালে বাঘ বসে কেবল ঝিমোয়
চারপাশে কত যে বর্ণ নিয়ে হরিণ সেঁধোয়
বাঘ আর পারে না তাকাতে
কমে গেছে জোর, থেমে গেছে থাবার বিক্রম
নখগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে
বাঘ আজ থাকে গাছে গাছে।

কিন্তু শক্তি উধাও হলেও ক্ষুধা উধাও হয় না। না পেটের ক্ষুধা না মনের না দেহের। বার্ধক্য জর্জরিত রিরংসা কবলিত পুরষের লোল জিহ্বা ঝুলে পড়ে। ঘরণীর দেহ আর তাকে আকর্ষণ করে না। আবার হরিণীতরুণীর নাগাল পাওয়াও দুঃসাধ্য।

দ্বিমুখী ক্ষুধার তেজে বাঘ আজ দ্বিধান্বিত খুব
বাঘিনী তার মেলে আছে বিগত যৌবন
হরিণীর ক্ষুরধার যৌবনের রূপ বাঘিনীরা কবে যে হারায়
হরিণ ও বাঘিনী মিলে হতে পারে অন্য এক প্রেমের বাথান
মাংস রিরংসার টানে শরীরে প্রাণাধিক টান।

পেটের ক্ষুধা এক বহুমাত্রিক রূপ নিয়ে এসে হাজির হয় আহার্য প্রেম আর যৌবনের ক্ষুধায় কাহিল বাঘের সাম্রাজ্যে। আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী! সে হরিণী মাংস থেকে পাল্টে যায় প্রেম আর কামে, ঝাঁঝালো যৌবন আর বহুরূপী বর্ণবিভাসে।
কবির বয়ান তুলে আনি —

আহার পাল্টে গেছে পৃথিবীর কত রূপ খাদ্যের বাহার
কত যে বিভ্রম ঘটে হরিণী ও বাঘের খামার
……………………………………….
হরিণীরা কত রূপে সাজে
বাঘ আজ বহুরূপী অলস বিভাসে
…………………………………
একান্ত ক্ষুধার কাছে পৃথিবীও কত গদ্যময়
আনকোরা পদ্যের গান হরিণীর জেগেছে নিশ্চয়!

ক্ষুধার গদ্য যখন আক্রান্ত করে দুর্বল শক্তিহীন বাঘকে, হরিণী তখন মহানন্দে 'পদ্যের গান' গাইতে পারে। তার পৃথিবী তো 'ক্ষুধার রাজ্য' নয়! সৌন্দর্যের বিভাস, প্রেম আর যৌবনে চিন্ময়ী নারীর পৃথিবীতে একদিন হয়তো সত্যিই এমন পদ্যের গানের সিম্ফনি জাগবে। আর তখন–

হরিণ সংগোপনে খেয়ে যায় মধু
কেননা বাঘের রূপচিত্রে প্রান্তর তড়িৎময়, উত্থানরহিত, ধু ধু!

'হরিণীর সাজ' এ কবিতায় কবির সৌন্দর্যভাবনার এক বহুবর্ণিল দীপ্তি নিয়ে বারবার হাজির হয়েছে। নারীর সৌন্দর্য, যৌবনের জৌলুস আর মাধুরী, তীব্র প্রেমের দ্যুতিময় বৈদ্যুতিক রূপের আধার হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে হরিণী-রূপকল্প।

হরিণী হয় না বুড়ি, হরিণীর অনন্ত যৌবন
যৌবনে ধরা পড়ে বাঘে
হরিণ ফুঁসতে থাকে রাগে, হরিণীর প্রবল যৌবন
গর্ব এই কতবার বাঘ এসে সঁপেছে হৃদয়
হরিণীর পিছু পিছু ধেয়ে গেছে বাঘের কনভয়

এই চিত্রের মধ্য দিয়ে আমাদের মনে পড়ে নাকি ট্রয়ের সেই যুদ্ধের কথা! হেলেনকে হৃদয় সমর্পণ করলেন যুবরাজ প্যারিস। বাঘের মতোই তো তার সৌন্দর্য আর ঐশ্বর্য! আর ম্যানিউলাসের ক্রোধ কি পরিণত হলো না স্বাধীনতা সম্ভ্রম আর আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধারের দুর্বার শপথে? হরিণীর অধিপতি হরিণই তখন শক্তিমত্ত বাঘ। 'বাঘের কনভয়' ধেয়ে যায় শত্রু শিবিরে। কত ভাবেই না ঘটে শক্তির রূপান্তর!

হরিণীর চেয়ে বাঘ সৌন্দর্যে কিছুমাত্র কম নয়। চোখ ধাঁধানো তীব্র সৌন্দর্যে বাঘ যেন মূর্তিমান যৌবন। কবির কলমে বাঘ আর হরিণী যৌবনের যুগলবন্দি চিত্রময়তায় ধরা পড়ে বারবার।

বাঘেরও চিত্রিত দেহ, বাঘেরও রূপ রয়েছে অতিশয়
তবু হরিণীর পিছু ধেয়ে বাঘের কমেনি সংশয়
যখন যৌবন ছিল হরিণীরা ফেলেছে তপ্তশ্বাস
বনাঞ্চলে বাঘ ছিল মূর্তিমান ত্রাস….

প্রকৃতির নিয়মে বাঘ বুড়ো হয়। বয়স এসে শেষবিন্দুতক খেয়ে নেয় পৌরুষের মদ। শূন্য পিপার মতো বিগতযৌবনদেহ পুরুষ তার অতীতের শৌর্যবীর্য রোমন্থন করে। কিন্তু বাঘরূপী পুরুষের পৃথিবী থেকে শক্তি ক্ষুধা আর যৌবনের ঝাঁঝালো প্রবল দীপ্তির তেজ শেষ হয় না। শেষ হয় না যৌবনদীপ্ত পুরুষের প্রতি নারীর আশ্লেষও। এক সোনলি স্বপ্নের মায়ায় আবিষ্ট হয়ে ওঠে হরিণী কিংবা নারীমন।

নাক্ষত্রিক রূপ নিয়ে কত বাঘ রয়ে গেছে দূর ছায়াপথে
তাদের ডোরার রেখা মিশে গেছে বৃক্ষজগতে
……………………………………………..
এখনো বাঘের মনে ঢুকে আছে হরিনীর সুপ্ত যৌবন
বাঘ এক ঘোরতর বন
আদিগন্ত ছড়ানো সবুজে চকচকে হরিণী রোদ্দুরে
বাঘ সোনালি স্বপ্ন নাকি বিভ্রম থরে-বিথরে।

কিন্তু যৌবন তো শুধু বাঘের মতো ঝাঁঝালো সোনালি মদ্যের ঘ্রাণ নয়, সে হরিণীর মতো এক উড়াল তাড়নাও বটে। সে এসে জাগিয়ে দিয়ে যায় দেহ, উদ্ভাসিত করে যায় সৌন্দর্য, তীব্র করে যায় ক্ষুধা আর কাম, আলোড়িত করে যায় স্বপ্ন। তারপরেই তাকে আর ধরা যায় না। তখন হরিণীও উড়ে যায়। বাঘও বিভ্রান্ত চোখে দেখে– রৌদ্রছায়ার ছাপচিত্রে রয়ে গেছে তার অতীতের শৌর্যদীপ্তি। 'আদিগন্ত ছড়ানো সবুজ'-এ 'চকচকে হরিণী রোদ্দুর'-এ যৌবনের এই অমোঘ নিয়তি কবির কলমে আঁকে মনোময় ছবি। সে ছবি এক অসাধারণ কাব্যসৌন্দর্যে ভরপুর।

কত হরিণ নেচেছে মন্দিরে কত বাঘ শুয়ে থেকে ঘাসে
দেখেছে আকাশগঙ্গায় হরিণীরা উড়ে যায় শুধু
দেখেছে যৌবনকাল উড়ে যায় ধুধু
দেখেছে অধীর গভীর ঋতু জেগে থাকে জাগর ডাঙায়
তাদেরই কিছু ছাপচিত্র রয়ে গেছে বাঘদের গায়।

জাগতিক বিলয়ের পরেও যৌবন যেন অবিনাশী থেকে যায়। নাক্ষত্রিক রূপ নিয়ে সেই অবিনাশী যৌবনদীপ্ত বাঘ অথবা ব্যাঘ্রোজ্জ্বল্র ক্ষমতাবান 'ভুসুকু-আহেরি' যেন মহালোকে ছড়িয়ে দেয় তাদের প্রাচীন শৌর্যের উদ্ভাস। মৃত্তিকাসংলগ্ন বনপ্রান্তর তখনও কেঁপে ওঠে। বাঘের ডোরার চিত্রে কবি এই অবিনাশী যৌবনকে ভজনা করেছেন কয়েকটি অবিনাশী শব্দেরই নৈবেদ্যে।

ঐ মহালোকে দলে দলে বাঘ আজ হচ্ছে জড়ো
তাদের ডোরার চিত্রে প্রান্তরের রূপ থরো থরো
তাদের শিকার সব প্রাণ পেয়ে কম্পমান দাঁড়ায়

ক্ষমতার দম্ভ শাসন ত্রাসন দখল আগ্রাসন এসব তো পৃথিবী থেকে কোনোকালে শেষ হবার কথা নয়। যুগপরম্পরায় তা চলতে থাকে। সেই প্রাচীনকাল থেকে সমৃদ্ধ জনপদের প্রতি, ঐশ্বর্যময় রাজ্যের প্রতি নিপতিত হয়েছে লুব্ধ দস্যু লুটেরার চোখ। হালাকুনাদিরচেঙ্গিসের যুগ গত হয়েছে, কিন্তু পৃথিবীর সমৃদ্ধ দেশের ওপর নতুন নামে নতুন রূপে নতুন কায়দায় হামলে পড়েছে লুব্ধ পরাশক্তি। তাই পরাশক্তির বিশ্বব্যাপী ক্ষমতাচিত্রকে কবি দেখেন ফটোকপিয়ারে মুদ্রিত হতে। এই কপি ছড়িয়ে পড়বে আরও আরও পরাশক্তির ক্ষমতাবলয়ে।

আজ জঙ্গলের ফটোকপিয়ারে মুদ্রিত হতে থাকে
বাঘের যৌবনচিত্র, বাঘের বিক্রম
জাদুঘরে বাঘ প্রদর্শনীর পড়ে গেছে ধুম
……………………………………..
হরিণী পৃথিবী ঘিরে বাঘদের ভয়মত্ত ঝাঁপ

এ কবিতা যেন কবির বহুস্তরী ভাবনার নকশাবোনা ভাঁজখোলা কার্পেট। এক একটি ভাঁজ খুলে গেলে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে নতুন ছবি। নতুন রঙ। তাই দেখা যায়, বাঘের রূপকল্পে কবি একদিকে মদির যৌবনকে স্থাপন করেছেন আমেঘসমুদ্রের অসীমতায়, আবার তাকে নিয়ে গেছেন আন্তর্জাতিকতার সুবিস্তৃত প্রেক্ষাপটে, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন নৃতাত্বিক বৈশিষ্ট্যে নারীর যৌবন চিত্রিত হতে থাকে মোহমুগ্ধতায়–

যখন বাঘেরা উড়ে চলে মেঘের তলদেশে
হরিণী সুধার খোঁজে চুর হয়ে যায় ব্রহ্মদেশে।
বালির সৈকতে যায়, উঠে পড়ে জাভার পর্বতে
কেন না মৈনাক গিরি হারিকিরি মালয় সাগরে
সূর্যস্নানে গাত্রখোলা হরিণীরা রোদের চাবুক
সুনির্মল ছদ্মবেশে চিত্রময় হরিণও ভাবুক।

আবার কবি তাকে নিয়ে আসেন স্বভূমে, একেবারে হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায় এমন সীমায়িত পরিসরে। হয়তো এই বাঘের ভেতরে কবি প্রত্যক্ষ করেন নিজেরই এক সংযত আগুন।

হরিণী চিত্রিত ভারি বর্ণময় স্বাদ
বর্ষার বাংলাদেশে হরিণীরা করুণ নিষাদ
কান্নার দেশে বাঘদের নিপাট লুকানো খাদ।
……………………………………………
বাঘ এক পৌরাণিক প্রভু
হরিণীরা দিয়েছে উড়াল।

এই উড়ন্ত দুরন্ত দিগন্তপ্রসারী যৌবনকে ঘিরে মানুষের প্রেম। প্রেমকে ঘিরে স্বপ্ন। যৌবন যখন দেহে জাগায় ক্ষুধা হরিণীপ্রেম তখন 'বাঘমনে' মাংসের উদ্ভাসে জাগায় বিদ্রোহ। চাই। তাকে চাই। আবার যৌবন যখন মনের ভেতরে জাগিয়ে তোলে হরিণীবনের সোনালি স্বপ্ন– সেই স্বপ্ন সোনার হরিণীর মতই চঞ্চল, অধরা।

বাঘ তো বনপ্রান্তরে লতাকুঞ্জের জটিলতায় ঝোপঝাড়ের কুহেলিকায় ঝলকে উঠতে দেখে স্বপ্নহরিণীর দেহের আভাস, তারপর তাকে যেই পেতে চাওয়া, তার পেছনে ছুটে যাওয়া সমস্ত প্রেমকামক্ষুধা আর আশ্লেষ নিয়ে, স্বপ্ন তখন ধাবমান। তীব্র গতিতে উড়ে যায় আকাশে। কামনার আলোর ছটা শুধু জেগে থাকে বাঘের যৌবনমদির চোখে। প্রেমকামক্ষুধার সুতীব্র বাসনা তখন বাঘবন্দী। স্বপ্ন থেকে যায় অধরা। ক্ষুধা আর প্রেমের ঘূর্ণায়মান প্রবৃত্তির বৃত্তে কবি এই অধরা স্বপ্নকে একটি চতুর উড়ালতরঙ্গে খেলিয়ে নিয়ে গেছেন। বারবার এই অধরা স্বপ্ন এসেছে উড়ন্ত চিত্রকল্পনায়। স্বপ্ন কখনো উড়ে যায় হরিণীর স্বর্ণাভ দ্যুতিচিত্রে, কখনো বাঘের তীব্র ধারালো বর্ণরেখায়।

কবিতা থেকে কয়েকটি চয়নের ভেতর দিয়ে আমাদের চিত্তও এক অরূপ উড়ালশকটে পাড়ি দিয়ে আসতে পারে সেই স্বপ্নজগৎ!
* হরিণী চপলা পায়ে দৌড়ে গেছে ক্ষেত্র নক্ষত্র জগৎ
বাঘ ছোটে ম্রিয়মাণ ক্ষয়মান ধুলোর সম্বত।
* হরিণী উড়িয়া গেছে ঊর্ধ্বাকাশে একদল পরী
* দেখেছে আকাশগঙ্গায় হরিণীরা উড়ে যায় শুধু।
* তাদের ডোরার রূপে ভিন দেশে ্উড়ে আসে বাঘ ও হরিণ
* ঐ যে দিয়েছে লাফ হরিণী উড়াল
* বাঘ এক পৌরাণিক প্রভু, হরিণীরা দিয়েছে উড়াল।

হরিণীর এই উড়ালযাত্রার ভেতর দিয়ে কামরুল আমাদের মনের ভেতর স্বপ্নের এক রহস্যময় জাদুবিভাস তৈরি করেছেন। রূপকথার জগতের মতো এক ধরনের বিভ্রমের ভেতরে স্থান করে নেয় আমাদের স্বপ্নপিয়াসী মন।

কিন্তু স্বপ্ন তো স্বপ্নই। সে অপ্রাপণীয়। কিন্তু তার জন্য থাকে দুরন্ত প্রবল আকাক্সক্ষা। তাকে ধরার জন্য হাত বাড়ায় মানুষ। আর মায়া হরিণীর মতো এই স্বপ্নের পরী তার জাদুর পাখাজোড়া খুলে কেবলই উড়ে যায়। কামরুলের হরিণীরা তাই বারবার উড়ে যায়। এই হরিণী অধরা।

তবে অধরা হলেও কখনো ক্ষমতাবানের স্বপ্ন থাকে হাতের খুব কাছে। মনে হয় স্বপ্নের জন্য সাধনা নয়– দরকার শুধু তাকে চতুর ক্ষিপ্রতায় দখল করে নিজের করে তোলা। জাগর প্রবৃত্তি আর অধরা স্বপ্নের বিপ্রতীপ কেন্দ্রে পাওয়া-না-পাওয়ার এই বাঘ-হরিণ খেলাটিকে কবি অসাধরণ একটি চিত্রকল্পে জীবন্ত করে তুলেছেন।

রাতের অন্ধকারে কাম ক্ষুধা আর স্বপ্নস্বরূপা হরিণীকে পাওয়ার বাসনায় কুঞ্জে চলে আসে বাঘ। যেখানে ঝরাফুলপাতার আড়ালে মুখ লুকিয়ে শুয়ে আছে হরিণী। বাঘের মুহূর্তের বিভ্রম। হরিণীর মুহূর্তের অসতর্কতা। বাঘ ঝাঁপিয়ে পড়ে হরিণীর ওপর। হরিণী লাফিয়ে ওঠে শূন্যে।

প্রভাতে সন্ত খুব রাত্রি হলো বাঘের অধ্যায়
রাত্রির যামে কুঞ্জে কুঞ্জে হরিণ লুকায়
কেবল নধর নিতম্বখানি খুলে রাখে ভুলে
যখন লুকানো মুখ বাঁশপাতা ফুলে
………………………………..
হরিণীর অসতর্কতা বাঘের সম্বল
ঐ যে দিয়েছে লাফ হরিণী উড়াল
ঐ যে দিয়েছে লাফ বাঘের ভয়াল
কোন চিত্রে ধরা পড়ে কোন ক্ষুধা প্রবল ধবল।

বাঘ ও হরিণী উপাখ্যান কবিতায় কবি বারবার এমন বহু চিত্র এঁকে গেছেন যেখানে স্বপ্ন আর যৌবনের পাখায় চেপে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভোগের 'প্রবল ক্ষুধা', ঘূর্ণি তোলে উপভোগের বহুবর্ণিল কামবাসনা, আবার জেল্লাদার বাঘের বর্ণময় প্রেমের তীব্র ঝাঁঝালো রঙের ওপর অদ্ভুত রোমাঞ্চকর স্বপ্নের ধবল ওড়না উড়িয়ে 'ধবল ক্ষুধা' নিয়ে নক্ষত্রলোকে উড়াল দেয় সোনালি হরিণ।

তারপরেও সবকিছুর শেষে কবি প্রণয়েরই জয়গান গেয়েছেন। আকাশগঙ্গা আর নক্ষত্রলোকে স্বপ্নের হরিণী যতই উড়াল দিক, বাঘের জ্বলন্ত দুরন্ত প্রেমের কাছে তাকে ফিরে আসতেই হয়। প্রবল প্রেমের সুতীব্র টানকে কবি উপেক্ষার কুয়াশায় মিলিয়ে যেতে দেন না। তাই নানা ভাবে নানা ছলে শক্তিমান বাঘও হরিণীকে কাছে পেতে চায়।

বিপণির শান্ত ভিড়ে, ব্যগ্র ব্যাঘ্র সারি সারি
বাঘ গিয়েছে ছুটে হরিণীর ছায়াময় বাড়ি
বাঘ দেখেছে তুলে হরিণীর চিত্রময় শাড়ি
বাঘেরা উন্মাতাল, হরিণীর প্রাণপণ পাড়ি।

আর হরিণীও উড়ালখেলা শেষে ফিরে আসে প্রভুরই কাছে।

সত্যি হলো হরিণীরা বাঘের প্রণয়
বাঘ যে হরিণী ঘ্রাণে কত প্রাণময়
………………………………….
হরিণীরা মত্ত বায়ুবেগে এসে পড়ে বাঘের প্রাসাদে

কিন্তু আকাঙ্থিষত স্বপ্নরূপা হরিণীরা শেষ পর্যন্ত যখন ধরা দিতে চায় ততক্ষণে অধরা স্বপ্নের তৃষ্ণায় বাঘও ব্যাকুল হয়ে চলে গেছে অন্য কোথাও।
আর বাঘেরা দলে দলে ছেড়ে গেছে স্বর্ণ সিংহাসন
হরিণীর জন্য তার কেঁদেছে প্রাণপণ।

কামরুল যেন বাঘ আর হরিণীকে নিয়ে জাদুকরের মতো এক খেলা খেলেছেন এই কবিতায়। তাতে মুহুর্মুহু বদলে যায় বাঘ হরিণের অবয়ব। বারবার পাল্টে যায় রঙ। বাস্তবতা বদলে যায় স্বপ্নময়তায়, ক্ষুধা বদলে যায় প্রেমে, রিরংসা বদলে যায় যৌবনাবেগে। এ কবিতা যেন ক্ষুধা যৌবন আর স্বপ্নের এক আশ্চর্য প্রিজম যা থেকে কেবলই রহস্যের ঘোরলাগা রঙের বিচ্ছুরণ ঘটতে থাকে।

এমন কি দীর্ঘ এই কবিতার শেষে এসে যে মুহূর্তে আমরা সিদ্ধান্ত করে উঠি পুরুষতন্ত্র আর রাজতন্ত্র তো জয়ী হওয়ার জন্যই! কবিও পাঠককে অনেক আশ্চর্য উড়াল ভ্রমণ করিয়ে এনে শেষ পর্যন্ত পৌরাণিক প্রভু বাঘের প্রাসাদেই নিয়ে আসেন স্বপ্নময়ী হরিণীকে! কিন্তু শেষেরও শেষে আছে সেই জ্বলন্ত প্রিজমের ঘুরে যাওয়া। কারণ তিনি উচ্চারণ করেন–

হরিণী জেনেছে তার পিছু নেয়া বাঘ নয় অন্য কোনো ভয়
বাঘও জেনেছে ঐ সমুখে ছোটে হরিণী নয় অন্য কোনো জয়