পীরদের গল্প (সিদ্ধিরগঞ্জ) – ১

আরিফ হোসেন সাঈদ
Published : 18 Feb 2013, 05:29 PM
Updated : 18 Feb 2013, 05:29 PM

সিদ্ধিরগঞ্জের একটি ছোট এরিয়াতেই রয়েছে অন্তত ১২ টি পীরের খানকা (আস্তানা)। ১২ টি পীরের অনুসারীরাও এখানে পীরের কৃপায় পীরের পদবী লাভ করেছেন। এই খানকাগুলোকে পীরের মূল খানকা বা আস্তানার শাখা বলা যাতে পারে। প্রতিটি খানকার একটি সাথে অন্যটির দ্বন্দ্ব রয়েছে। একেকটি খানকায় একেকটি তরীকা মেনে চলে। তারা মূল ইসলাম ধর্মের অনুসারী নয়। তারা তাদের পীরের নির্দেশ মত ধর্ম পালন করেন।

সিদ্ধিরগঞ্জের পীরদের খানকাগুলো হল:
১. ভাণ্ডার শরীফ
২. চরমোনাই
৩. টেকের হাট
৪. দেওয়ানবাগ
৫. সর্ষিনা
৬. উজানি শাহ্
৭. জৈনপুরী
৮. আট্টুশি
৯. চন্দ্রপুরী
১০. বেলতলী
১১. দাউদকান্দি খানদানি দরবার শরীফ
১২. শম্ভুগঞ্জি
১৩. এনায়েতপুরী
১৪. নারায়ণগঞ্জের বাহাদুর শাহ্
১৫. কাদেরিয়া তরীকা
ইত্যাদি।

চিটাগাং রোড সংলগ্ন ওয়াপদা বটতলা এলাকায় কাদেরিয়া তরিকার অনুসারী পীর বোরহানুদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি তার অতীত জীবন সম্বন্ধে। তার ভক্তদের মাধ্যমে জানতে পারি তিনি বর পীর (আব্দুর কাদির জিলানী) এর শক্তি প্রাপ্ত। বিভিন্ন জন তাঁর কাছে যান বিভিন্ন সমস্যার আধ্যাত্মিক সমাধানের আশায়। তিনি ডিএনডি লেকের তলদেশে পানি প্রত্যাহার করে সেখানে অবৈধভাবে খানকা শরীফ স্থাপন করেছেন। সেখানেই তিনি বসবাস করেন। তাঁর আয়ের উৎস ভক্তদের সাহায্য।

যুগ যুগ ধরে এই পরজীবীগুলো কিছু অশিক্ষিত, সরল মানুষের ধর্মীয় অজ্ঞতাকে পুঁজি করে বেড়ে উঠেছে। আজ জানাব কাদেরিয়া তরীকায় বিশ্বাসী এমনি এক পরজীবীর গল্প।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশ দিয়ে (চিটাগাং রোড পর্যন্ত) যে ডিএনডি লেকটি বয়ে গেছে তা আবার একটি কালভার্টের মাধ্যমে চিটাগাং রোড টু নারায়ণগঞ্জ রোড বরাবর ডিএনডি লেকের সাথে যুক্ত হয়েছে। সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে প্রশাসনের সহায়তায় বা উদাসীনতায় সেই কালভার্টটির পানি চলাচলের জায়গাটি পরিকল্পিত ভাবে ময়লা ফেলে ভরাট করে ফেলা হয়েছে। সেখানে বর্তমানে কাদেরিয়া তরীকার অনুসারী পীর বোরহানুদ্দিন এর খানকা শরীফ রয়েছে। জানা গেছে আজ থেকে ২২/২৩ বছর আগে বোরহানুদ্দিনের মা-বাবা এই এলাকায় জীবিকার সন্ধানে আসেন। ওয়াপদা কলোনি সংলগ্ন বটতলার ডিএনডির পাড়ে তার বাবার তেলের দোকান ছিল। সেই থেকে এই জায়গাটি তাদের দখলে আসে। এই সরকারি জায়গার কি ব্যবস্থা তারা করেছেন জানতে চাইলে পীর বোরহানুদ্দিন বলেন তার বাবা ২২/২৩ বছর আগে এইখানে তেলের দোকানদারি করত। তিনি এখানে আসেন ১৪ বছর বয়সে ১৯৮৯ সালের দিকে। ১০ বছর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তেলের দোকান ভেঙ্গে দেয়। তেলের দোকান ভেঙ্গে দেয়ার পর তার সাধনা একটু ঘনীভূত হয়ে আসলে তিনি এই জায়গায় খানকা শরীফ দিয়ে বসে পড়েন।


লেকের তলদেশে পানি প্রত্যাহার ও ভরাট করে নির্মাণ করা পীর বোরহানুদ্দিনের খানকা ও বাড়ি


খানকার ভেতরের ছবি

তার কাছ থেকে জানা যায় গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অবৈধ উচ্ছেদের সময় এখানে তার অবৈধ ভাবে নির্মিত মসজিদটি সহ তার আখড়া সরকার ভেঙ্গে দেয়। পরে তা পুনর্নির্মাণ করা হয়।
তার পুরো নাম হাজী বোরহানুদ্দিন শাহ্। গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার বরাইল গ্রামে। বড় হয়েছেন নানার বাড়িতে। তার নানার বাড়ি নবীনগর উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামে। তিনি কৃষ্ণনগর আব্দুল জব্বার উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন কিন্তু লেখাপড়া করা হয়নি। তিনি দুই সন্তানের পিতা। বিয়ে করেছেন একটি। তিনি ১ বার ২০০৪ সালে হজ্ব করেছেন।

তিনি জানান ১৪ বছর বয়সে এই এলাকায় আসার পর তিনি ৪/৫ বছর তাবলীগ জামাতে কাটিয়েছেন। ১/২ বছর কাটিয়েছেন মাজারে। তারপর হজ্ব করে আজমির শরিফ যান। তারপর থেকে তিনি তার খানকায় আছেন। তিনি জানান এই খানকাটি তার পীরের নামে তিনি এখনও নিজের নামে কোন খানকা দেননি। তিনি জানান আগে প্রতি বছর গ্রামের বাড়ি যেতেন মাহফিল করার উদ্দেশ্যে এখন আর যান না। আগে ২/৩ বছর পর পর ভক্তের বাড়ি যেতেন তবে গত ৫ বছরে আর কোথাও যাননি।

মানুষকে পথ প্রদর্শন করার এই আধ্যাত্মিক ক্ষমতা কোথায় পেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, নবীনগরের পীর ইউসুফ শাহ্'র কাছ থেকে আর বাকিটা সাধনার ফলে আজ এই অবস্থা। এই মুহূর্তে তিনি সাধনা করছেন।

তিনি জানান বছরে দুবার তার খানকায় ওয়াজ-মাহফিল-জিকির হয়। আর প্রতি বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক মাহফিল হয়। প্রতি বছর চৈত্র মাসের ২০, ২১, ২২ তারিখ আর শ্রাবণ মাসের ৫ তারিখে মাহফিল বসে।

তার এই কাজ করতে কোন সমস্যা হয় কিনা জানতে চাইলে অন্যান্য অনেক কিছুর সাথে তিনি সরকারি ১২ টি ডিপার্টমেন্টের কথা বলেন।

কোন বাধা, আক্রমণ বা উৎপাতের শিকার হয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, "এইডা অক্করে সর্বসময়"। নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, "নাম বলা যাবে না। কেরে নাম বলা যাইব না, এই এলাকায় কে নেতা, নারায়ণগঞ্জের ভেতর কে মন্ত্রী, কে এমপি, কে কমিশনার-চেয়ারম্যান আপনেরা সব জানেন"।

তার খানকায় যে পতাকাটি উড়ছে তার সম্বন্ধে জানতে চাইলে বলেন, এই পতাকাটি ইসলাম প্রচারের শুরু থেকেই। ইসলামের চারটি তরিকা আছে এর চারটি পতাকা আছে। কেউ লাগায় লাল, কেউ সবুজ, কেউ হলুদ আবার কেউ সাদা। তিনি জানান, কাদেরিয়া তরিকা অনুযায়ী তার পতাকাটি সবুজ। পতাকায় চারটি তারার সম্বন্ধে জানতে চাইলে বলেন, চারটি তরীকার জন্য চারটি তারা। এর কোন সঠিক অর্থ নেই। যার যার মনের ব্যাপার। এর কোন একুরেট অর্থ নাই।

তিনি জানান, বাংলাদেশে অনেক বেশি পীর। দশ জনের দশ জন ভক্ত। এতে তিনি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।

এক সময় তিনি বলেন, আমার শত্রু বাইরের কেউ না। এই এলাকার ভেতরেই ১৬ টি কওমি মাদ্রাসা আছে। ১২ টি পীরের খানকা আছে। ১২+১৬=২৮ জনই তার বিপক্ষে। তিনি জানান, কওমি মাদ্রাসা আর পীর মুর্শিদ হল সাপে-বেজির মত। তিনি বলেন, "১২ ডা পীরের খানকা আমার আশেপাশে আর তার মাঝে আমি। তাইলে কতডা সমস্যায় আছি আমি"। তিনি আরও বলেন, "সবার লগে লড়াই করতাছি আমি। স্থানীয় শীর্ষস্থানীয় ৯৮ ভাগ লোক আমার বিরুদ্ধে। বাকি ২ ভাগ মুখে মুখে আমার পক্ষে অন্তরে বিপক্ষে"।

তিনি বলেন, "RAB ১১ যখন এইখানে আইছে তারপর সেনা ভবন থাইকা (!), প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থাইকা (!), এইখানে চেক পোষ্ট বসাইছে। এখনও চেকের ভেতরেই আছে।"
তিনি বড় পীরের শক্তি পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, "এইটার কোন দলিল নাই। এইটা মৌখিক বিশ্বাস। অন্তরের ব্যাপার। … তুমি নিজে বোঝ না! এরকম একটা জায়গার মধ্যে থাকা এমন একটা লোকের নির্দেশনা না পাইলে এমন একটা জায়গার মধ্যে ২৪ ঘণ্টা থাকা। ১২ ডা ডিপার্টমেন্টের লোকেরা সবসময় তোমার পেছনে লাইগা রইছে …। পুলিশ এইখানে চেক পোষ্ট দিছে। হিরাঝিল এলাকায় থানার থাইকা দুই জন ডিউটি করতাছে। RAB তো ২৪ ঘন্টা A টিপ, B টিপ, C টিপ করতাছে।

আমাদের সম্মুখেই একজন ভক্ত এসে জানালেন পীর সাহেবের দোয়ায় তার পরিবারের সকল সমস্যা দূর হয়েছে। সবাই ভাল আছে। পীর সাহেব লোকটির আনা কিছু কলাতে ফুঁ দিয়ে বললেন, এই কলাগুলো খাওয়ালে সব সমাধান হয়ে যাবে।

কখন সবাইকে পথ দেখানো শুরু করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে আসার পর ৪/৫ বছর একলা ঘরে বসে সাধনা করেছেন। তারপর থেকে শুরু করেছেন।

কাদেরিয়া তরীকার মূল লক্ষ্য কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এইটা জানতে চাইলেই পারা যায় না। আগে ঢুকে জানতে হয়, বুঝতে হয়, শিখতে হয়। শিক্ষিত মানুষেরা পারে কম। মূর্খ মানুষরা ভাল পারে। শিক্ষিতরা লেখাপড়ার অহংকারে কারও কাছে নিচু হইতে পারে না।

তিনি জানান, আল্লাহ-রসূল তাকে পৃথিবীর সব জ্ঞানই দিয়েছেন।

আরিফ হোসেন সাঈদ,
২২ এপ্রিল ১২