এইমাত্র পাওয়া সৌদিতে বাংলাদেশিদের দুঃসংবাদ

আরিফ হোসেন সাঈদ
Published : 8 March 2012, 02:11 PM
Updated : 8 March 2012, 02:11 PM

সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হওয়ায় ১৯৭৬ সাল থেকে সৌদি আরব বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানি শুরু করে এবং সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সৌদি আরবে একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জনশক্তি বা শ্রমিকের সংখ্যাই সর্বোচ্চ। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর সৌদি আরবে গড়ে প্রায় দু'লাখ জনশক্তি রফতানি হয়। সৌদি আরবের বিভিন্ন শহরে বর্তমানে বৈধ ২৬ লাখসহ ৪০ লাখ বাংলাদেশী বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশীদের শ্রমবাজারের ৮০ শতাংশই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক। এর ৩৬ শতাংশ সৌদি আরবে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৭৬ সাল থেকে গত বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সৌদি আরবে গেছেন ২৫ লাখ ৮০ হাজার ১৯৮ জন বাংলাদেশী। ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয় সৌদি আরবে। তবে এ চিত্র পাল্টে যায় ২০০৭ সালের মাঝামাঝি সময়। হঠাৎ করেই বাংলাদেশের নাগরিকদের কাজের জন্য নতুন ভিসা, আকামা নবায়ন ও পরিবর্তন বন্ধ করে দেয় সৌদি কর্তৃপক্ষ। এরপর চালুর আশ্বাস পাওয়া গেলেও চরম কূটনৈতিক ব্যর্থতার কারণে তা আর হয়নি। বরং আকামা (ওয়ার্ক পারমিট) পরিবর্তন জটিলতার কারণে সৌদি আরব থেকে প্রতি মাসেই হাজার হাজার শ্রমিক ফেরত আসছে অব্যাহতভাবে। জানা গেছে, দেশটিতে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত অর্ধেক প্রবাসী বাংলাদেশীই এখন অবৈধ। কারণ, বাংলাদেশীদের ওয়ার্ক পারমিট নবায়ন বন্ধ রয়েছে কয়েক বছর ধরে। গত ১৫ বছর ধরে সৌদি প্রবাসে থাকে এমন একজন জানায়, ২০০৭ সালের পর হতে বাংলাদেশীদের আকামা পরিবর্তনের সুযোগ বন্ধ থাকায় সৌদি আবরে বাংলাদেশী শ্রমিক আসা কমে গেছে। ২০০৭ সাল থেকে সৌদি আরব বলতে গেলে বাংলাদেশের ভিসা বন্ধই করে দিয়েছে এবং এক স্পনসর থেকে অন্য স্পনসরের কাছে বদলিও বন্ধ করে রেখেছে। মদিনায় গত এক বছর ধরে অবৈধভাবে কাজ করছেন বঙ্গবন্ধু পরিষদ মদিনা শাখার সভাপতি ইদ্রিস আলী। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা আমাদের এ চরম ভোগান্তির কারণ। তিনি জানান, তার মতো আরও লাখ লাখ বাংলাদেশী চরম অনিশ্চয়তা ও শঙ্কার মধ্যে এখানে দিন কাটাচ্ছেন। জানা গেছে, বিদেশিদের জন্য সৌদি আরবে আকামার মেয়াদ থাকে ৩ থেকে ৫ বছর। এর মধ্যেই আকামা নবায়ন বা পরিবর্তনের সুযোগ আছে। তবে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইনসহ অন্য সব দেশের জন্যই আকামা নবায়ন বা পরিবর্তনের দরজা খোলা রয়েছে। ওইসব দেশের নাগরিকদের কোনো ভোগান্তিও নেই। আকামা (ওয়ার্কপারমিট) পরিবর্তন জটিলতার কারণে সৌদি আরব থেকে প্রায় ১০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশীকে ছয় মাসের মধ্যে দেশে ফিরে যেতে হবে। একই সঙ্গে অবৈধ হয়ে যাওয়ায় এসব বাংলাদেশীর জেল-জরিমানা ও পুলিশি নির্যাতন শুরু হয়েছে। সৌদি আরবের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, দেশটিতে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত অর্ধেক প্রবাসী বাংলাদেশীই এখন অবৈধ। কারণ গত প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে বাংলাদেশীদের ওয়ার্কপারমিট নবায়ন বন্ধ রয়েছে। সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশীদের ফেরত না পাঠিয়ে নতুনভাবে আরো কর্মী নেয়ার আহবান খালেদা জিয়ার। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সৌদি আরবে জনশক্তি রফতানি বন্ধ হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত তা সমাধানে অগ্রগতি নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সৌদি আরব সফরকালে সৌদি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকের পর আকামা পরিবর্তন ও নবায়ন জটিলতা দূর হওয়ার কথা ঘোষণা করে ছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোনো প্রতিফলন লক্ষনীয় হয়নি। সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশীরা আশংকা করছেন যে নতুন করে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি সৌদি আরবে যাওয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারে এবং সেই সঙ্গে বর্তমানে যারা রয়েছে তাদেরও পড়তে হতে পারে সমস্যায়। গত মাসে (৬ আগষ্ট ২০১১) পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দিপু মনি সৌদি আরব সফর করে এ বিষয়ে তেমন কোনো উলেল্গখযোগ্য সাড়া পাননি বলে জানা গেছে। তিনি স্থানীয় সাংবাদিকদের এ সংক্রান্ত সব প্রশ্ন এড়িয়ে যান বলেও জেদ্দাস্থ বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির সভাপতি রুমি সাঈদ জানান। সৌদি আরব সফর শেষে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন জানিয়েছেন, বাংলাদেশী প্রবাসীদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে। এ কারণে সৌদি সরকার বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ বন্ধ রেখেছে। একই সঙ্গে সৌদিতে থাকা প্রবাসীদের আকামার (চাকরির অনুমতিপত্র) মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। অপরাধ প্রবণতা না কমলে সৌদি আরব বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। শনিবার সৌদি আরব সফর শেষে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি একথা জানান (৪ মার্চ, ২০১২)। প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীসহ ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল গত ২২ ফেব্রুয়ারি সৌদি আরব সফরে গিয়েছিলেন। ৭ মার্চ, ঢাকায় সৌদি দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারী খালাফ আল আলী নিহত হওয়ার খবর আল জাজিরাসহ সৌদি আরবের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারের পর মঙ্গল ও বুধবার সৌদিতে বাংলাদেশী অধ্যুষিত রাজধানী রিয়াদের বতহা, জেদ্দার কিলো আলবাতাসা, গোলাইল, মাছনা, মক্কার মিছফলাহ্, নাক্কাছাসহ বেশ কয়েকটি স্থানে সৌদি যুবকদের হামলায় টেকনাফের সৌদি প্রবাসীরা আক্রান্ত হয়েছে বলে প্রবাসীদের পরিবার-স্বজনদের সূত্রে জানা গেছে। গত দু'দিনে সৌদি যুবকদের হামলায় অন্তত: ২৫ জন আহত ও ১০টির মত টেকনাফ প্রবাসীদের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর ও লুটপাট হয়েছে বলেও মোবাইল ফোনযোগে প্রবাসীরা তাদের আত্মীয়-স্বজনদের জানায়। এ ঘটনার পর থেকে সৌদি আরবে অবস্থানরত টেকনাফ প্রবাসীসহ বাংলাদেশীরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকার খবরে টেকনাফের হোয়াইক্যং, হ্নীলা, সদর, সাবরাং, বাহারছরা ও সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের প্রবাসীদের আত্মীয়-স্বজনদের ঘরে ঘরে কান্নার রোল পড়ে গেছে (৭ মার্চ, ২০১২)। ঢাকায় সৌদি কূটনীতিক খুনের পর সৌদি আরবের বিভিন্ন শহরে অবস্থানকারি হাজার হাজার প্রবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের করাচি শহরে দু'জন সৌদি কূটনীতিক খুনের পর পাকিস্তানের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কে যে ফাটল ধরেছে তা খুব শিগগিরই ঠিক হবার নয়। বহু দেনদরবারের পর গত কয়েকমাসে তা ঠিকও হয়নি। ঢাকায় সৌদি কূটনীতিক খুনের ঘটনায়ও এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে অনেকেই। তবে সৌদি আরবে কর্মজীবী বাংলাদেশীদের মধ্যে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে শুধু তা-ই নয়। এ সংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশ অবৈধ কর্মজীবীরা এখন সন্ধিহান যেকোন সময় আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ অভিযান শুরু করে কী-না। বর্তমানে জেদ্দায় অবস্থানরত গেল্গাবাল ইকোনমিস্ট ফোরামের সভাপতি এনায়েত করিম অভিযোগ করেন, সৌদি আরবে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার দেশের ভাব-মর্যাদা উন্নয়নে কোনো রকম উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার। তিনি আরও জানান, সৌদি আরবে ভারতের একটি নিজস্ব পত্রিকা রয়েছে। তাছাড়া ভারতের প্রায় সবক'টি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা সৌদি আরবের স্টলে পাওয়া যাচ্ছে। এতে অতি সহজেই ভারত তাদের নিজেদের ইমেজ তৈরি এবং বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণায় এগিয়ে যাচ্ছে। এর মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে সৌদি আরবে বাংলাদেশের বিশাল শ্রমবাজার দখল করা। আর এতে বাড়তি সুযোগ পাচ্ছে ভারতীয় শ্রমিকরা। সৌদি আরবের রিয়াদ শহরে এক মিসরীয় নাগরিককে হত্যার অভিযোগে ১১ বাংলাদেশীকে গ্রেফতার করা হয়। সৌদি আরবের বিচার বিভাগ ১১ বাংলাদেশীর স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তাদের অভিযুক্ত করে এবং অভিযুক্তদের ৮ জনকে সম্প্রতি সৌদি আরবের নিজস্ব বিচার প্রক্রিয়ায় প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। অপর ৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। বর্তমানে বাঙালিদের ছোট অপরাধকেও বড় করে দেখছে সৌদিরা। অপরাধের জন্য শাস্তির কঠোরতাও বৃদ্ধি করেছে। এ ছাড়া সৌদি আবর থেকে প্রকাশিত পাকিস্তান ও ভারতের কিছু পত্রিকা নিয়মিত বাংলাদেশী শ্রমিকদের নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ ছেপে যাচ্ছে।
এইমাত্র এক সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশীর কাছ থেকে জানা গেল সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের দুরবস্থার কথা। গত ৫ মার্চ তারিখে বাংলাদেশে এক সৌদি কূটনীতিক হত্যা নিয়ে সেখানে খুবই উত্তেজনা বিরাজ করছে। সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের উপর প্রকাশ্যে অত্যাচারের খবর পাওয়া যাচ্ছে। জানা যায় বাংলাদেশীদের দেখা মাত্র তারা পুলিশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তাদের আকামা বৈধ হওয়া সত্ত্বেও এর দুর্বলতা থাকায় পুলিশ তা কেড়ে নিচ্ছে। এবং প্রকাশ্যে কাপড় খুলে তার দিয়ে প্রহার করা হচ্ছে। শহরে এ অত্যাচার প্রকট আকার ধারণ করছে। তাদের জেল জুলুমের শিকার হতে হচ্ছে। এবং নতুন করে বাংলাদেশীদের ধরপাকড় অভিযান শুরু হয়েছে। বাংলাদেশীদের অত্যাচারের পর তাদের দেশে ফিরে আসতে বাধ্য করা হচ্ছে। (i) আরিফ হোসেন সাঈদ, ০৩/০৮/১২, নারায়ণগঞ্জ।
সূত্রঃ
গোলাম ফারুক দুলাল, http://bd24live.com
আমার দেশ, ১১ ডিসেম্বর ২০১১,
Times Bengali. ৭ মার্চ ২০১২,
দৈনিক জনকন্ঠ, ৪ মার্চ ২০১২,
Bangladesh Barta, http://bumgk.com. ৬ আগষ্ট ২০১১,
টেকনাফ নিউজ ডট কম, ১৭ জানুয়ারি ২০১২
(i), উমর ফারুক, সৌদি আরব, ফোনালাপ থেকে সংগৃহীত।