ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ

আরিফ হোসেন সাঈদ
Published : 24 May 2012, 07:42 PM
Updated : 24 May 2012, 07:42 PM

অশান্ত ছেলেটি কখনও বটের ছায়ায় বসে বাঁশি বাজিয়েছেন, কখনও বা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাতার কেটেছেন। কিন্তু তাঁর মনটি কখনও শান্ত হয়নি। মাথায় এক ঝাঁক চুল ছিল। সেই মহান পুরুষ একটি কথা কাউকে বলে যায়নি। তাঁর প্রিয় বন্ধুকেও না। সে আমাদের ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ কাজী নজরুল ইসলাম।

বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল ছিলেন অবিভক্ত বাংলার সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রের এক মহান পুরুষ ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। আধুনিক বাংলা গানের এই 'বুলবুল' ইতিহাসে 'বিদ্রোহী কবি' নামে পরিচিত। রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ মুক্ত কবিতা রচনায় তিনি ছিলেন অগ্রভাগে। কবিতা সৃষ্টিতে এই অনন্য প্রতিভার জন্যই 'ত্রিশোত্তর আধুনিক কবিতা' সৃষ্টির পথ সহজ হয়েছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নজরুলের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক মিটিং, মিছিল, সভা ও সেমিনার ইত্যাদিতে যোগ দিয়ে নজরুল তাঁর সাহিত্যকর্ম দিয়ে অবিভক্ত বাংলার পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, মৌলবাদ ও দেশি-বিদেশি শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সংগ্রাম করতেন। তাই ব্রিটিশ সরকার তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ ও পত্রিকা নিষিদ্ধ করে তাকে কারাগারে প্রেরণ করে। নজরুলের কারাবাসের সময় আদালতে উপস্থাপিত তাঁর 'রাজবন্দীর জবানবন্দী' ও একটানা ৪০ দিন উপবাস করে তিনি ব্রিটিশ সরকারের জেল ও জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। এই অনন্য ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে সাহিত্যে নোবেল জয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে গ্রন্থ উৎসর্গ করেন।

নজরুল তাঁর কাব্যে এমন সব শব্দ বিষয় ব্যবহার করেছেন যা এর আগে কেউ ব্যবহার করেননি, এক্ষেত্রে নজরুলই ছিলেন প্রথম। প্রচলিত বাংলা ছন্দরীতি ছাপিয়ে বহু সংস্কৃত ও আরবি ছন্দ দিয়ে নজরুল তাঁর কবিতা ও গানকে অলংকৃত করেছেন। তাঁর কবিতায় যেমন সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যাধি ঠাই পেয়েছে তেমনি ঠাই পেয়েছে সমকালীন, দূর ও নিকট ইতিহাস, তেমনি এসেছে স্বদেশ ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব। তাঁর কাব্য সৃষ্টিতে হিন্দু মুসলমানের মিশ্র ঐতিহ্যের পরিচর্যা করেছেন। মানবসভ্যতার মৌলিক সমস্যার প্রতিও ছিল সচেতন ও সাহসী দৃষ্টি।

বাংলা সঙ্গীতের প্রায় সবকটি ধারায় চর্চা, বিচরণ ও নিজের মধ্যে ধারণ করতেন নজরুল। সঙ্গীতে তাঁর ভালবাসা ও মৌলিক অবদান বাংলা লোকসঙ্গীতকে উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী মার্গসঙ্গীতের সঙ্গে মিলন ঘটায়। এছাড়া বাংলা গানকে উত্তর ভারতীয় রাগসঙ্গীতের দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করেন নজরুল।

নজরুল সঙ্গীতকে বলা হয় বাংলা গানের অনুবিশ্ব এবং উত্তর ভারতের রাগসঙ্গীতের বাংলা সংস্করণ। বাণী ও সুরের বৈচিত্র্য নজরুলের গানকে আধুনিক বাংলা গানের মর্যাদায় বসিয়েছে।

কাজী নজরুল ইসলাম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ (২৪ মে ১৮৯৯) সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কাজী ফকির আহমদ ছিলেন মসজিদের ইমাম ও মাজারের খাদেম। সবাই নজরুলকে 'দুখু মিয়া' নামেই ডাকত। ১৯০৮ সালে তাঁর পিতা মৃত্যুবরণ করলে শুরু হয় দুখু মিয়ার জীবন যুদ্ধ। পরিবারের ভরণপোষণের জন্য মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ নেন এবং হাজী পালোয়ানের মাযারের সেবকের কাজ নেন। দুখু মিয়া গ্রামের মকতব থেকে নিম্ন প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এভাবে শৈশবেই কোরআন পাঠ, নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন যা পরবর্তী জীবনে তাঁর গান কবিতা সহ তাঁর সৃষ্টিতে ব্যাপক ছায়া ফেলে।

তারপর নজরুল পশ্চিম বাংলার বর্ধমান বীরভূম অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের সমাহার লোকনাট্য লেটোদলে যোগ দেন। লোকসংস্কৃতির লেটোদলে বালক দুখু অভিনয়ের পাশাপাশি পালাগান রচনা করতেন। লেটোদলেই বালক নজরুলের শিল্পী ও কবি প্রতিভার প্রকাশও ঘটে। তাৎক্ষণিক ভাবে কবিতা ও গান রচনার কৌশল কবি লেটো ও কবিগানের দলেই আয়ত্ত করেন। লেটো দল থেকে হিন্দু পুরাণের সঙ্গে নজরুলের পরিচয় ঘটে। এ সময় কিশোর নজরুল লেটোদলের জন্য চাষার সঙ, শকুনিবধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ, কবি কালিদাস, বিদ্যাভূতুম, রাজপুত্রের সঙ, বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ, মেঘনাদ বধ প্রভৃতি।

১৯১০ সালে নজরুল পুনরায় ছাত্রজীবনে ফিরে আসে, ভর্তি হন রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজ স্কুলে। পরে কবি আসেন মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে (বর্তমান নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন) যেখানে দুখু কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের সান্নিধ্যে আসেন। কুমুদরঞ্জন মল্লিক সে স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু অভাবের ছোবলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীর পর দুখুর লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়। মাথরুন স্কুল ছেড়ে নজরুল মাত্র ১১ বছর বয়সে বাসুদেবের কবিদলে যোগ দেন। তারপর এক খ্রিষ্টান রেলওয়ে গার্ডের ভৃত্যের কাজ নেন অবশেষে আসানসোলের এক রুটির দোকানে। এভাবে শ্রমিক নজরুল বাল্যজীবনেই জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হন।

চায়ের দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লার চোখে পড়েন অসম্ভব প্রতিভাধর এই কিশোর। তাঁর ইচ্ছেতেই ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে দরিরামপুর স্কুলে ভর্তি হন নজরুল। ১৯১৫ সালে নিজ গ্রামে ফিরে এসে পুনরায় রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজ স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। ১৯১৭ সালের শেষদিকে প্রিটেস্ট পরীক্ষার সময় নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তাঁর ছাত্র জীবনের শেষ সময়ে নজরুল সিয়ারসোল রাজ স্কুলের চারজন শিক্ষক উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী ভাবধারার নিবারণচন্দ্র ঘটক, ফারসি সাহিত্যের হাফিজ নুরুন্নবী এবং নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারা ভীষণ প্রভাবিত হন।

১৯১৭ সালের শেষদিকে থেকে ১৯২০ সালের মার্চ- এপ্রিল পর্যন্ত নজরুল সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীতে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সাধারণ সৈনিক থেকে ব্যাটেলিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার হয়েছিলেন। রেজিমেন্টের পাঞ্জাবি মৌলবির কাছে নজরুল ফারসি ভাষা শিখেন। সময় পেলে সঙ্গীতানুরাগী সহ সৈনিকদের সাথে দেশি-বিদেশি বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গান বাজনায় মেতে উঠতেন। সৈনিক জীবনে নজরুল মূলত করাচী সেনানিবাসেই তাঁর সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। এ সময় কলকাতায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে প্রথম গদ্যরচনা 'বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী' যা সওগাত পত্রিকায় মে ১৯১৯ সালে প্রকাশিত হয়, প্রথম প্রকাশিত কবিতা 'মুক্তি' যা বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় জুলাই ১৯১৯ সালে প্রকাশিত হয়। এছাড়া আরও উল্লেখযোগ্য গল্প 'হেনা', 'ব্যথার দান', 'মেহের নেগার' ও 'ঘুমের ঘোরে' এবং উল্লেখযোগ্য কবিতা, 'আশায়', 'কবিতা সমাধি' প্রভৃতি। করাচী সেনানিবাসে থেকেও নজরুল কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা যেমন: প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ভারতী, মানসী, মর্ম্মবাণী, সবুজপত্র, সওগাত ও বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। নজরুলের নিকট রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র ও ফারসি কবি হাফিজের কিছু গ্রন্থ ছিল।

প্রথম মহাবিশ্ব যুদ্ধ শেষে ১৯২০ সালের মার্চ মাসে নজরুল কলকাতায় ফিরে এসে তাঁর সাংবাদিক ও সাহিত্যিক জীবন শুরু করেন। কলকাতায় এসে প্রথমে ৩২নং কলেজ স্ট্রীটের বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফফর আহমেদের সঙ্গে উঠেন। শুরুতেই বিভিন্ন পত্রিকা যেমন, মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর সদ্য রচিত উপন্যাস 'বাঁধন হারা' ও কবিতা 'বোধন', 'শাত ইল আরব', 'বাদল প্রাতের শরাব', 'আগমনী', 'খেয়া পারের তরুণী', 'কোরবানী', 'মোহররম', 'ফাতেহা ই দোয়াজদম' প্রভৃতি প্রকাশিত হলে সাহিত্য জগতে তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করেন। বাংলা সাহিত্যের ক্ষমতাধর প্রতিভা হিসেবে সাহিত্যানুরাগীদের মাঝে তাঁকে নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সেসময় কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মোসলেম ভারত পত্রিকায় একটি চিঠি লিখে নজরুলের 'খেয়া পারের তরুণী' ও 'বাদল প্রাতের শরাব' কবিতা দুটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন এবং বাংলা সাহিত্য জগতে তাঁকে স্বাগত জানান। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে সেসময়ের মোজাম্মেল হক, আফজালুল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সহ প্রখ্যাত মুসলিম সাহিত্যিকবৃন্দের সঙ্গে নজরুলের বন্ধুত্ব হয়। সেসময় কলকাতার জমজমাট দুটি সাহিত্যিক আসর 'গজেনদার আড্ডা' ও 'ভারতীয় আড্ডা'য় নজরুল যেতেন সেখানে 'অতুলপ্রসাদ সেন', 'দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর', 'অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর', 'সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত', 'চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়', 'ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ' 'প্রেমাঙ্কুর আতর্থী', 'শিশির ভাদুড়ী', 'হেমেন্দ্রকুমার রায়', 'শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়', 'নির্মলেন্দু লাহিড়ী', 'ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়' সহ বাংলার প্রমুখ শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত ও নাট্যজগতের দিকপালদের পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হন। নজরুল ১৯২১ সালের অক্টোবরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে সাক্ষাৎ করেন। তারপর তাদের মধ্যে যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা বাড়ে যা ১৯৪১ সাল পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল।

১৯২০ সালের ১২ই জুলাই অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশবিরোধী গণজাগরণের জন্য শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হকের সম্পাদনা ও মালিকানায় নবযুগ নামে একটি সন্ধ্যাকালীন দৈনিক বের হলে নজরুল এর যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে তাঁর সাংবাদিক জীবন শুরু করেন। ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠা পত্রিকাটিতে নজরুলের 'মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে?' প্রবন্ধটি প্রকাশ হলে একই বছর আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে পত্রিকাটির জামানতের ১,০০০ টাকা বাজেয়াপ্ত করে পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়া হয় এবং নজরুল পুলিশের দৃষ্টিতে পড়েন। নজরুল নবযুগ পত্রিকায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লিখতেন, পাশাপাশি মুজফফর আহমদের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা সমিতিতে যেতেন। এ সময় নজরুল বিভিন্ন ঘরোয়া আসর ও অনুষ্ঠানের যোগ দিতেন এবং সঙ্গীত ও সংস্কৃতিচর্চা করতেন। এ সময় নজরুলের কিছু কবিতা যেমন, 'হয়তো তোমার পাব দেখা', 'ওরে এ কোন্ স্নেহ সুরধুনী'তে ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গীতজ্ঞ মোহিনী সেনগুপ্তা সুর দিয়ে তা স্বরলিপিসহ পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন যেসময় নজরুল নিজে গান লিখে সুর করতে শুরু করেননি। নজরুলের লিখা গান 'বাজাও প্রভু বাজাও ঘন' সওগাত পত্রিকায় ১৩২৭ সনের বৈশাখ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়।

(চলবে)

তথ্যসূত্রঃ বাংলাপিডিয়া, রফিকুল ইসলাম, আলি নওয়াজ