বিডিনিউজে হামলার প্রতিবাদে ব্লগাররা রাজপথে

আরিফ হোসেন সাঈদ
Published : 30 May 2012, 04:00 AM
Updated : 30 May 2012, 04:00 AM

২৮ মে ২০১২, সোমবার, মহাখালীর আমতলী এলাকায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কার্যালয়ে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো ২৯ মে ২০১২, মঙ্গলবার, সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশের আহ্বান করেন। এতে যোগ দিয়ে সাংবাদিকদের উপর ও পুলিশের হামলা সহ সকল সাংবাদিক হত্যার বিচারের দাবিতে সাংবাদিকদের সাথে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে অংশ নেন বাংলা ভাষার ব্লগাররা।

পূর্ব ঘোষিত সময় অনুযায়ী মঙ্গলবার সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে ব্লগার ও সাংবাদিকরা জড়ো হন প্রেসক্লাব এলাকায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্লগার ও সাংবাদিকদের স্লোগানে কেঁপে উঠে জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকা। ব্লগাররা ব্যানার নিয়ে জড়ো হয়ে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বিক্ষোভ স্লোগান দিতে থাকেন। 'বিডিনিউজে হামলাকারীর – বিচার চাই, বিচার চাই' 'সাগর-রুনি মরল কেন – প্রশাসন জবাব চাই' 'আমার ভাই আহত কেন – প্রশাসন জবাব চাই', 'সন্ত্রাসীদের কাল হাত – ভেঙ্গে দাও গুড়িয়ে দাও' 'সাংবাদিকের ভায় নাই – রাজপথ খালি নাই'

তারপর বিক্ষোভ ও স্লোগান রূপ নেয় মিছিলে। সাংবাদিকদের সাথে ব্লগাররা প্রশাসনের কাছে জবাব চেয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে।

সমাবেশে এক বক্তা বলেন 'গত সাতদিন যাবৎ আমরা সাংবাদিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে মিছিল মিটিং ও মানব বন্ধন করছি। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এবং সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের সাথে কোন যোগাযোগ করেননি।'

সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, 'সাংবাদিকদের উপর পুলিশ বাহিনী অত্যাচার নির্যাতন ও জুলুম করে, উপনিবেশিক আমলের এই পুলিশের আচরণ পরিবর্তন করা সরকারেরই দায়িত্ব।'

ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আখতারুজ্জামান লাবলু সাংবাদিক নির্যাতন বন্ধে আগামীতে আরো কঠোর কর্মসূচিতে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে পাশে থাকার আহ্বান জানান।

ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নুর উদ্দিন আহমেদ নুরু বলেন, 'আপনারা লক্ষ্য করেছেন গত কয়েক দিন আগে যেসব পুলিশ সদস্যরা সাংবাদিকদের উপর হামলা চালিয়েছিল তাদেরই একজন এখনও থানায় চাকরি করছেন। আমরা তাঁর শাস্তি দাবি করছি। আপনারা দেখেছেন গতকাল বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি সংবাদ সংস্থায় সন্ত্রাসীরা যেভাবে হামলা করেছে দেখে মনে হয় যেন গরু জবাই করেছে। সাংবাদিক উপর নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।'

সমাবেশে আরেক বক্তা বলেন, 'আমরা এগুলো কি দেখছি। আমরা দেখতে চাই আমরা সাংবাদিক সমাজ নিরাপদে যেন দায়িত্ব পালন করতে পারি।'

তিনি সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, 'আপনারা আপনাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করুন। যেন সরকার বাধ্য হয়।'

আরেক বক্তা বলেন, 'আপনারা জানেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের কথা দিয়েছিলেন পেশাগত দায়িত্ব পালন কালে আর কোন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হবেন না। কিন্তু তারপরও একের পর এক সাংবাদিক নির্যাতিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন সাংবাদিকদের টার্গেট করে এ হত্যা, নির্যাতন চালানো হচ্ছে।'

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা বলেন, 'আজকের এই কর্মসূচিটি হওয়ার কথা ছিল যারা আমাদের সাংবাদিক ভাইদের পিটিয়েছে, লাথি মেরেছে তাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমরা দেখলাম গত রাতে একদল সন্ত্রাসী লাঠিসোঁটা, ধারালো অস্ত্র নিয়ে বিডিনিউজ'এ হামলা চালিয়েছে। নির্বিচারে সাংবাদিকদের কুপিয়েছে। কিন্তু এমনটি হওয়ার কথা নয়। একটি গণতান্ত্রিক দেশে, একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশে গণমাধ্যম কর্মীরা নিরবিচ্ছিন্নভাবে তাদের কাজ করবে, দায়িত্ব পালন করবে এমনটিই হওয়ার কথা। কিন্তু আজকে সাংবাদিকদের উপর একের পর এক হামলা আসছে। নির্যাতিত সাংবাদিকদের তালিকা আজ অনেক লম্বা। আমরা সাংবাদিক নির্যাতন বন্ধের দাবিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেখা করেছিলাম। দেখা করেছিলাম সাগর-রুনির হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু আজ সাংবাদিকরা শুধু নির্যাতনের মুখেই নয়, ধারালো অস্ত্রের মুখে পড়েছে। গণতান্ত্রিক পরিবেশে এই ধারাবাহিকতা চলতে পারে না যাতে গণতন্ত্র ব্যাহত হয়। কারা এই নির্যাতন করছে, কাদের ছত্রছায়ায় এই নির্যাতন হচ্ছে। তাদের সকলকে গ্রেফতার করতে হবে।'

দৈনিক প্রথম আলোর চীফ রিপোর্টার শরিফুজ্জামান পিন্টু বলেন, 'আমার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ৯৯ সালের কথা যখন হুমায়ুন কবির বালু, মানিক সাহা মারা যাওয়ার পর খুলনার সাংবাদিকরা একটি স্লোগান দিয়েছিলেন, বিচার পাই না তাই চাই না। ঠিক এমনি একটি অবস্থা আজকে চলে এসেছে। কোন ঘটনারই বিচার হচ্ছে না। সামসুর রহমান, হুমায়ুন কবির বালু, খোকন কোন ঘটনারই কোন বিচার হয়নি। যে শহরে সাংবাদিক হত্যার বিচার হয়না সে শহরে সাংবাদিক নির্যাতনের কোন সুষ্ঠু বিচার হবে সেটা বিশ্বাস করা যায় না। প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন ভাবে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। প্রথম আলোর সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা যেতে না যেতেই বিডিনিউজে যে ঘটনাটি ঘটেছে এবং আজ পত্রপত্রিকায় যে রক্তাক্ত ছবি। এসব আমাদের বুঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে সাংবাদিক মারলে কিছু হয়না।'

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুস শহীদ বলেন, 'আমরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করি আমরা কোন রাজনৈতিক কর্মী নই। তারপরও রাজপথই যেন আমাদের ঠিকানা হয়ে পড়েছে। একটার পর একটা ঘটনা হামলা, হত্যা, নির্যাতন, হুমকি এমনভাবে ঘটছে যেন একটা ঘটিয়ে আরেকটা আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সাগর-রুনির হত্যার বিচারের প্রত্যাশা পূরণের আগেই দেখেন একটা পর একটা কতগুলো ঘটনা ঘটে গেল। সাংবাদিকদের উপর যেন নির্যাতন যজ্ঞ চলছে। এর যেন কোন প্রতিকার নেই। আর তাই একজন পুলিশও কর্মকর্তা বলতে পারেন সাংবাদিক পেটালে কিছু হয়না, এজন্য তিনি পেটান। এজন্য তারা প্রথম আলোর সাংবাদিকদের পেটান আর কাল বিডিনিউজে হামলা করেন। কারণ তারা জানেন সাংবাদিক পেটালে কিছু হয়না। কিন্তু আমাদের প্রশাসনে যারা আছেন যারা আমাদের রাজনৈতিক শক্তি আছেন তাদের দায়দায়িত্ব কি। সাংবাদিক পেটালে কিছু হয় এমন একটা লজিক তারা তৈরি করবেন কি। ৭ই এপ্রিল আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেখা করেছিলাম। সেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুনির্দিষ্ট ভাবে বলেছেন, সাগর-রুনি হত্যার বিচার খুব শীঘ্রই হবে। কিন্তু তা হয়নি।'

সভায় এক বক্তা বলেন, 'একের পর এক ঘটনা চলছে এর কোন প্রতিকার আমরা পাই না। প্রতিকার না পেলে কি হয়। দেখুন আমরা অনেকগুলো কর্মসূচি পালন করেছি। আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্থা বাংলাদেশে সাংবাদিক নিগ্রহের ব্যাপারে কথা বলেছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। সাংবাদিক নির্যাতন এখন সাড়া দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিচার হয়না আর বিচার হয়না বলেই এটি ক্রমশ বাড়ছে। আমাদের ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেছে। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে একসময় গণমাধ্যম আর স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না।'

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি রুহুল আমিন গাজি বলেন, 'বিডিনিউজ'এ সন্ত্রাসী হামলার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। অবিলম্বে তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের কথা দিয়েছিলেন সাগর-রুনি হত্যার বিচার হবে এবং আর কোন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হবেন না, অন্তত পুলিশের হাতে। আমরা দেখছি একের পর এক সাংবাদিক নির্যাতিত হচ্ছে পুলিশের হাতে। পুলিশ যেভাবে প্রথম আলোর সাংবাদিকদের উপর নির্যাতন করেছে তাঁর কোন তুলনা হয়না। তাদের থানায় নিয়ে যাবার সময় তারা পানি চেয়েছিল। তাদের পানিও দেয়া হয়নি। সাংবাদিক নির্যাতন যদি বন্ধ না হয় তবে সাড়া বাংলাদেশ জুড়ে প্রতিবাদ করতে বাধ্য হব। সাংবাদিকদের উপর নির্যাতন, হামলা, মামলা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।'

ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, 'আমাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। ব্যক্তিগত নয় পেশাগত নিরাপত্তা চাই। পুলিশ যদি আক্রান্ত হয় রাষ্ট্র পুলিশের পাশে এসে দাঁড়ায়। পুলিশের নিরাপত্তার জন্য সরকার পাশে এসে দাঁড়ায়। তাহলে আমরা রাষ্ট্রের কাছে সহযোগিতা পাব না কেন। আমরা লেখনী ও রাজপথে প্রতিবাদের মাধ্যমে এর প্রতিবাদ করব। পুলিশের হাতে অস্ত্র আর আমাদের হাতে রয়েছে কলম। পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে আমরা কলম ব্যবহার করব।'

এ সময় ব্লগার ও সাংবাদিকবৃন্দ নানা প্রতিবাদী লেখা সম্বলিত প্ল্যাকার্ড বহন করেন, 'BD NEWS অফিসে হামলার বিচার কর', 'BDNEWS24.COM অফিসে হামলা ও সাংবাদিক আহতের ঘটনার বিচার কর', 'তিন সাংবাদিক নির্যাতনকারী পুলিশের বিচার চাই', 'নির্যাতনকারী পুলিশের শাস্তি চাই', 'সাগর-রুনি সহ সকল সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের বিচার কর', 'আর কত সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হবে?', 'সাংবাদিক নির্যাতনকারী পুলিশের শাস্তি দিতে হবে', 'সাংবাদিক নির্যাতনের বিচার চাই'।

আরিফ হোসেন সাঈদ, ২৯ মে ২০১২