সহস্র ও দুই রাত্রি

আসাদুজজেমান
Published : 21 Oct 2012, 10:39 PM
Updated : 21 Oct 2012, 10:39 PM

আকর্ষণীয় রজনীর নিদারুণ বিকৃতি

রাত্রি নেমেছে শরতের আকাশে, যে আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে কাশফুলের মত মেঘ। রাত্রি নেমেছে সে শরতের মেঘেও।
এভাবেই সহস্র কাল ধরে রাত্রি নামছে শরৎ এবং বর্ষায়। আরব এবং বাংলায়।
তবে বিশেষ কারণেই বিশেষায়িত হয় একে থেকে অন্য।
তাইতো বর্ষার আকাশ থেকে সুন্দর শরতের আকাশ, বাংলার রজনীর থেকে আকর্ষণীয় আরব্য রজনী।
যে আকর্ষণেই ছোটবেলায় প্রতীক্ষায় থাকতাম সে রাতের জন্য যে রাতে টিভিতে আলিফ লায়লা প্রচারিত হতো। ছোটবেলায় শোনা সে সুর এখনো আমার কানে বাজে-

"আলেফ লায়লা, আলেফ লায়লা, ওয়া লায়লা, শোনো সব নতুন কাহিনী, মন ভরে যায় যার বাণী, কতযুগ পেড়িয়ে গেছে, সময় তবু রয়ে গেছে…….."

যদিও সময় রয়ে যায়নি। বরং যুগ পেরেনোর সাথে সাথে সময়ও পেড়িয়ে গেছে, অনেক কিছুই বিকৃত হয়ে গেছে। বিকৃত হয়েছে এটি নামেও!
আশ্চর্য মনে হলেও, উপন্যাসটি আলেফ লায়লা ওয়া লায়লা নয় বরং আলেফ লায়লা ওয়া লায়লানে। সহস্র ও এক রাত্রি নয় বরং সহস্র ও দুই রাত্রি।
আমি ভাবছিলাম আমরা না হয় অসভ্য, আমরা নিজস্ব প্রয়োজনে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটাই। আমরা বিকৃতি করি মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা! বিকৃত করি স্বাধীনতার ঘোষকের নাম! এটা আমাদের অসভ্যতা!
কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব, তারা তো সভ্য। তারা কেন বিকৃত করলো বিশ্ব সাহিত্যের এ অমূল্য সম্পদ?

লোমহর্ষক বঙ্গীয় রজনী

আরবের হেরেমখানায় মদ পানরত বাদশা, আর মৃত্যু ভয়ে গল্পরত বেগম, সকালেই যার গর্দান যাবে- এমন রাত অনেক আগেই ফুরিয়েছে….। এখনকার রাত, আলো আধারী কোন এক নাইট ক্লাবের রাত! যেখানে সারাব আছে, সাবাবও আছে, শুধু গল্প নেই …… গল্পের প্রয়োজনও নেই। এখনতো আইটেম সংয়ের যুগ!
তবে কল্পনাপ্রবণ মনের দুর্নিবার আকর্ষণে আমি ঢুকে পড়েছি বঙ্গীয় রজনীর এক হেরেমখানায়, যেখানে বাদশাকে গল্প শোনাচ্ছে তার বেগম- যে গল্প আলি বাবা আর চল্লিশ চোরের, চিচিং ফাক বলে গুপ্তধন সন্ধানের গল্প নয়। বরং এ গল্প হলমার্কের সোনালী ব্যাংক ফাক করে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের গল্প। যে গল্প দস্যু জিংগালু জংলার জঙ্গিপনার নয় বরং এ গল্প শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসপনার গল্প। আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ ছাপিয়ে যে গল্প পরমাশ্চর্য প্রদীপের ছোয়ায় শেয়ার বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়ার গল্প! এভাবেই চলবে সহস্র কাল ধরে! প্রতি রাতেই নতুন নতুন গল্প………….কুইক রেন্টালে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়ার গল্প! যুদ্ধাপরাধী দস্যুদের বিচার বানচাল করার ষড়যন্ত্র! ধর্মের দোহাইয়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মন্দির, বাড়ি পোড়ানো অধর্মের গল্প!
আমি ভাবছিলাম, আরব্য রজনী আকর্ষণীয় তবে বঙ্গীয় রজনী অনেক বেশী লোমহর্ষক।

অবিক্রিত জনগনের হাসি!

বঙ্গীয় রজনীর প্রতিটি রাতে উঠে আসে জনগনের দুঃখ, বেদনার কাহিনী। যারা প্রবল উৎসাহে পরিবর্তনের জন্য ভোট দেয় এবং বারবার হতাশ হয়! পরিবর্তনের জন্য দেয়া দুই-তৃতীয়াংশ কিংবা তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা যেখানে পরিপূর্ণ ব্যর্থতায় পরিণত হয়। তাইতো বঙ্গীয় রজনীর কাহিনী হতাশার কাহিনী, যেখানে কষ্ট আছে-হাসি নেই! যেখানে আক্ষেপ নিয়ে বিবেক গেয়ে চলে- আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম…..।
আর তাইতো হাসতে ভুলে যাওয়া জনগনের জন্য আজ রাতে বঙ্গীয় বেগম তার বাদশাকে শোনাচ্ছেন আলেফ লায়লা ওয়া লায়লানের সর্বশেষ গল্প জাহাকুল আবদ।
যদিও এ গল্প আমাদের প্রথম শুনিয়েছিলেন, ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান। আলেফ লায়লা ওয়া লায়লানের আসল পান্ডুলিপি থেকে তিনি 'ক্রীতদাসের হাসি' নামে অনুবাদ করেন জাহাকুল আবদ।

এ গল্পে পরাক্রমশালী বাদশা হারুনুর রশীদ রাতের ব্যবধানে হাবশী গোলাম তাতারিকে আমিরে পরিণত করেছিলেন এবং বাদী মেহেরজানকে বেগম বানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন একজন ক্রীতদাসের হাসি কিনতে। গল্পের শেষে গোলাম তাতারী হারুনুর রশীদকে বলেছিল-
"শোন, হারুনুর রশীদ। দীরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস গোলাম কেনা চলে। বান্দী কেনা সম্ভব। কিন্তু- কিন্তু-ক্রীতদাসের হাসি না…………."

গল্পে ছেদ পড়ল বঙ্গীয় বাদশার অট্টহাসিতে………..

বাদশাঃ বেগম …… সরাব খাচ্ছি আমি, আর সরাবি হয়ে উঠছো তুমি?

বেগমঃ আপনি বড্ড দুর্বোধ্য! ভাবকে আরো প্রসারিত করুন জাহাপনা!

বাদশাঃ বঙ্গীয় রজনীতে তুমি শোনাচ্ছো, আরব্য কাহিনী! এ কেমন তামাশা?

বেগমঃ এ তামাশা জনগনের ভাগ্য এবং ভবিষ্যতের সাথে তামাশা …. কখনো কখনো আরব্য রজনী একাকার হয় বঙ্গীয় রজনীতে! আরব সাগরের পানি মেশে ভারত মহাসাগরে।

বাদশাঃ আমার বিরক্তিতে তলোয়ার আর তোমার গর্দানের মাঝে হেয়ালী করো না বেগম!

বেগমঃ গোস্তাকী মাফ জাহাপনা, শওকত ওসমান 'ক্রীতদাসের হাসি' লিখেছিলেন ১৯৬৩ সালে আইয়ুব খানের সামরিক স্বৈরতন্ত্রের যুগে। স্বৈরাচারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ধরা বাজিতে তিনি জিতেছিলেন। সে বছরই ক্রীতদাসের হাসি পেয়েছিল শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের পুরষ্কার! এ হাসি শুধু হাবশি গোলাম তাতারির হাসি নয়, এ হাসি ছিলো এ দেশের প্রতিটি নিপীড়িত মানুষের মুক্তি আকাঙ্খার। যারা বলছিলো-

আইয়ুব খান, অস্ত্রের জোরে শাসন ক্ষমতা দখল করা যায়, কিন্তু জনগনের মুখে হাসি ফোটানো যায় না।

বাদশাঃ হুম, কিন্তু এখনতো দেশটা স্বাধীন হয়েছে, স্বৈরশাসনও বিদায় নিয়েছে। যদিও বিশ্ববেহায়া এক স্বৈরাচার ক্ষমতাসীনদের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে, তবুও দেশে গণতন্ত্রই চলছে। এখন এ গল্পের প্রাসঙ্গিকতা কি?

বেগমঃ প্রাসঙ্গিকতা জনগনের হাসিতে জাহাপনা! তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মহাজোট সরকার আজ ধরাকে সরাজ্ঞান করছে। যেমন করেছিলো চারদলীয় জোট সরকার এবং তাদের পতনও হয়েছিলো। এ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠদের জন্যই এটা প্রাসঙ্গিক। তারা জেনে যাক-

সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে সরকার গঠন করা যায়। মানি লোককে সিঁধেল চোর বলে, হাটের খালু বলে হেয় করা যায়, কিন্তু জনগনের মুখে হাসি ফোটানো যায় না!

চারপাশে সুনসান নিরবতা নেমে এসেছে। বাদশা শান্ত ও সমহিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন- তাহলে জনগনের মুখে হাসি ফোটানো যায় কিভাবে?

মসজিদ থেকে ভেসে আসছে ফজরের আযান। গল্প আজকের মত শেষ। আবার আগামী রাতে শুরু হবে নতুন গল্প। ভোরের স্নিগ্ধতায় তবুও বেগম বলে চলছে- জনগনের হাসি সে তো হেকিমী দাওয়াই। বিভিন্ন অনুপাতে মেশাতে হয় হাসির উপকরণ। বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, সমাজে সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষাঙ্গনে সরকারী ছাত্র সংগঠন নিয়ন্ত্রণ, সেবাখাতে উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি…ইত্যাদি…ইত্যাদি…..এ সবকিছুর অনুপাতে, কার্যকর শাসনব্যবস্থাই জনগনের মুখে হাসি ফোটাতে পারে। তবে, জনগনের মুখে হাসি ফোটানো যায়, কিন্তু জনগনের হাসি কেনা যায় না।

সহস্র ও দুই রাত্রি

মহাজোট সরকারের প্রায় চার বছর চলে গেছে। চলে গেছে ১৩৮৯ দিন বা ১৩৮৯ রাত কিংবা চলে গেছে সহস্র রাত!
এ সহস্র রাতের ভীড়ে কিছু কিছু রাত ছিলো আরব্য রজনীর ভয়ঙ্কর রাত থেকেও ভয়ঙ্কর। কিছুদিন আগেই রামু সহ কয়েকটি বৌদ্ধপল্লীর সেই নৃশংস রাতের আধার এখনো কাটেনি, ক্ষত এখনো শুকায় নি। যে ক্ষত কলংকিত করেছে এদেশের সম্প্রীতির বন্ধন, সন্দেহ বাড়িয়েছে ধর্ম থেকে ধর্মে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানেরা। অপরাধবোধে ভুগছে মুসলিমেরা।
এমন আস্থাহীনতার মাঝেই এসেছে শারদীয় উৎসব, আসছে ঈদুল আযহা।
পাশাপাশি দুই ধর্মের প্রধান এ দুই ধর্মীয় উৎসব নির্বিঘ্নে উদযাপন নিশ্চই সম্প্রীতির বন্ধন জোড়ালো করবে। আস্থা তৈরী করবে একের সঙ্গে অপরের।
তাই সহস্র রাত অতিক্রম করা সরকারকে নিষ্কন্টক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে উৎসবের এ দুই রজনীর। এখন এ দুই রাতই হতে পারে আরব্য রজনীর সেই সহস্র রাতের দুই রাত। যে দুই রাত সাম্প্রদায়িক কলংকে ঢেকে দিতে পারে সম্প্রীতির প্রলেপ।