যে জলের ভাষা আছে!!!

আসাদুজজেমান
Published : 15 Sept 2011, 06:51 PM
Updated : 15 Sept 2011, 06:51 PM

কোথায় যেন পড়েছিলাম, এক লেখক তার বই নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ এক মেয়ের সাথে ধাক্কা লেগে তার বইগুলো পড়ে যায়। মেয়েটি বইগুলো তুলে দেবার সময় খেয়াল করলো, লেখক তার সামনে দাড়ানো ব্যাক্তিটিই। মেয়েটি বললো- আপনার বই! আপনি লেখক?
হ্যাঁ, লেখক জবাব দিলো।
মেয়েটি লেখকের পা ছুঁয়ে সালাম করে বললো- "আমার বাবাও একজন লেখক ছিলেন।
একসময় টিভি বলতে যখন ছিলো শুধুই বিটিভি! মনে আছে, কোথাও কেউ নেই, অয়োময়, সংসপ্তক নাটক গুলো দেখার জন্য সেকি আকুতি! সপ্তাহ ধরে বসে থাকতাম নাটক দেখার অপেক্ষায়! আজ টিভি বেড়েছে, দিন রাত মিলিয়ে অসংখ্য নাটক প্রতিদিন প্রচার হয় কিন্তু নাটকের প্রতি সেই আকুতি আজ আর নেই! কারন একসময় নাটক কম ছিলো কিন্তু নাটক ছিলো, অথচ আজ নাটকের প্রচার বেড়েছে কিন্তু নাটক খুঁজে পাওয়া যায় না! শুধুই বানিজ্য…বানিজ্য…। আজ পরিমানের কাছে মার খেয়ে যাচ্ছে মান! আর এখানেই শিল্পের অপমান!

আমরা সবকিছুই পরিমাপ করছি পরিমানে….সবকিছুই বেড়েছে…বাড়ছে…নাটক বেড়েছে, লেখক-লেখা দুই'ই বেড়েছে, জনসংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে জমিতে ধানের উৎপাদন, বেড়েছে মুরগীর ডিমের সাইজ! কবি বেড়েছে, দেশে নাকি এখন কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশী!

আমি ভাবছিলাম, সেই মেয়েটি আজ কোন লেখক দেখলে কি করতো? আধুনিক যুগের মেয়ে বলেতো তার নেট ইউজ করার কথা! সে যদি কোন ব্লগে ঢুকে এর বিভিন্ন লেখা এবং কমেন্ট গুলো পড়তো তখন কি ভাবতো?

হয়তো ভাবতো, লেখক…হা..হা..আমার বাবাও একজন লেখক ছিলেন। যিনি স্বার্থের নয় বরং মানবিক বোধের দাসত্ব করতেন। নিজ লেখা সম্পর্ক এমন মতামত, মন্তব্য তিনি পাননি। তিনি নিজেই ছিলেন তার লেখার প্রথম হয়তো একমাত্র পাঠক! কখনো কখনো লুকিয়ে তার ট্রাংক খুলে যখন লেখাগুলো গোপনে পড়েছি, আমি ভাবতে শিখেছি। কিন্তু আজ আমি একি পড়ছি? লেখা যেখানে শুধুই লেখক হবার বাসনায়! যেখানে দাসত্ব চলে স্বার্থের, লড়াই চলে নিজ মতাদর্শ প্রচারের!

সে রাতেই হয়তো মেয়েটি বাবাকে লিখতে বসতো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি-

প্রিয় বাবা,
আদর নিও। জানিনা ঐ দূর নক্ষত্রের মাঝে লুকিয়ে কেমন আছ? যখন তোমায় বড্ড বেশী মনে পড়ে, তখন আকাশের তারার মাঝে তোমায় খুজিঁ, তোমার লেখা গুলো পড়ি। যে লেখাগুলো প্রকাশ হয়নি বলে তোমার কত দূঃখ ছিলো। জানো বাবা, আজ সময় এতো এগিয়েছে, কোন লেখা ঘরে বসেই প্রকাশ করা যায়, মুহূর্তর মধ্যেই পাঠক পড়ে মন্তব্য জানায়! এ সময় লেখা প্রকাশের জন্য তোমার ক্ষয়ে যাওয়া সেন্ডেলের কথা ভাবতেই আমার বুক ভেঙ্গে কান্না আসে……।

জানো বাবা, এখন লেখা মানেই লেখক হবার প্রতিযোগীতা, লেখা মানেই মুজিব-জিয়ার মতাদর্শ প্রচার, লেখা মানেই শহীদের রক্তের কালীতে রাজাকার বন্দনা, লেখা মানেই ভারত-পাকিস্তান অক্রিক্রেটিয় পক্ষ উল্লাস!

জানো বাবা, এসব লেখার পাঠক প্রতিক্রিয়াও বেশ বিচিত্র! হয় সস্তা প্রসংশা নয়তো বিশ্রীগালি, বামপন্থি, রামপন্থি, রাজাকারের বাচ্চা, ভারতের দালাল, পাকিস্তানের কুত্তা!!! তুমিই বলো বাবা, মত প্রকাশের স্বাধীনতায় কি নগ্ন আঘাত। এরা কেন বোঝে না, বামপন্থি, রামপন্থি কিম্বা ইসলামপন্থি, এটাও একটি পথ, এটাও একটি মত।

লেখকদের ব্যপারগুলোও বেশ অদ্ভুত, অনেকেই দেখি অল্পতেই অভিমানে ব্লগ ছেড়ে দিতে চায়! মনে পড়ে বাবা, ছোটবেলায় যখন তোমার ওপর রাগ করে ভাত খেতাম না, তুমি বলতে আমার ওপর রাগ করেছিস কর, ভাতের ওপর কেন? ভাতের ওপর কি রাগ করতে আছে! আচ্ছা বাবা, লেখার(ব্লগের) ওপর কি রাগ করা যায়?

আবার অনেকেই ব্লগে ভিন্নমতালম্বী ছাড়া করতে চায়, তাড়াতে চায়। তুমিই বলো, এটা কি ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো নয়? মুসলিম অধ্যাসিত দেশে হিন্দুরা হবে নির্যাতিত, দেশ ছাড়া! তেমনি হিন্দুস্হানে মুসলিমেরা! তারা কেন বোঝে না, "ধর্ম যার যার, দেশ সবার" কথাটির মতো "মত যার যার, ব্লগ সবার"

কিন্তু বাবা, এতো কিছুর পরও এমন অনেক লেখক আছেন, যাদের লেখা পড়লে আমার মাথা নত হয়ে আসে, পা ছুঁয়ে সালাম করতে ইচ্ছে করে কারন তুমি লেখক ছিলে…..।

এরপর হয়তো মেয়েটির লেখা আর এগোতো না, তার চোখ দিয়ে ঝড়ে পড়তো নোনা জল। এ সেই জল, সৃষ্টির আদিতে যে জল পৃথিবীকে সিক্ত করেছিলো, অংকুরিত করেছিলো বীজ, রশদ জুগিয়েছিলো মহীরূহের।