৬১ হাজার এ+ বনাম ৮০-১০০

এ আর খান
Published : 28 July 2012, 05:32 AM
Updated : 28 July 2012, 05:32 AM

২০১২ সালের এস.এস.সি. এবং এইচ.এস.সি. ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ভাই-বোনদের প্রাণঢালা অভিনন্দন জানিয়ে শুরু করছি। এটা কোন কোচিং সেন্টার বা কলেজ বা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ব্যানারে গাছে বা ইলেক্ট্রিক পোলের গায়ে ঝুলে থাকা অভিনন্দন নয়। এটা বড় ভাই হিসেবে জানানো নিখাদ অভিনন্দন। এই নিখাদ অভিনন্দন জানানোর পেছনে একটু উদ্দেশ্য আছে বৈকি! আমি এই ফলাফল নিয়ে কিছু অপ্রিয় কথা বলতে যাচ্ছি। কিন্তু কথাগুলো কতটা সত্য বা ঠিক অথবা কতটা মিথ্যা বা ভুল তা বিচার বিবেচনা করার মত বয়স এবং বুদ্ধি আমার এ সমস্ত ছোট ভাই-বোনদের আছে বলেই আমার বিশ্বাস। তবে অবস্থার বিচারে আমি বেশী কথা বলব উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা শিক্ষার্থীদের নিয়ে। আর আমার তীরটা শিক্ষা বোর্ড ও নীতি নির্ধারকদের দিকে।

গত বছরগুলোর তুলনায় এ বছর পাশের হার, এ+ পাওয়া পরীক্ষার্থীদের সংখ্যা, ১০০% পাশ করা স্কুল-কলেজের সংখ্যা ইত্যাদি বেড়েছে; সেই সাথে বেড়েছে উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি হওয়া নিয়ে শংকাও। কিন্তু শিক্ষার মানও বেড়েছে, এই কথাটা কি ঠিক? যেহেতু এটার কোন সুস্পষ্ট মানদন্ড নেই তাই বিষয়ে কোন তর্কে আমি যাব না। শিক্ষকদের নম্বর প্রদানে উদারতাকে আমাদের শিক্ষামন্ত্রী যদি শিক্ষার মান বৃদ্ধির চিহ্ন মনে করেন তবে পূর্বে যারা রবি ঠাকুরের ৫ লাইন কবিতার ৩ পাতা ব্যাখ্যা লিখেও ১০ এ ৫ পেতেন তারা কোন শিক্ষাই অর্জন করেন নি। যাক সে কথা, স্কুল-কলেজগুলোর Ranking কোন সিস্টেমে করা হয় তাও বুঝলাম না। এখন কি তবে একজন শিক্ষার্থীকে নটরডেম/ঢাকা কলেজ/ভিকারুন্নিসা নূন কলেজ এবং একই সাথে রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হলে সে কি তবে নটরডেম/ঢাকা কলেজ/ভিকারুন্নিসা নূন কলেজ এর ডাক উপেক্ষা করতে পারবে? আমি জানি না, আমার শিক্ষার্থী ভাই-বোনরাই ভালো বলতে পারবে।কারণ, Ranking এ কিন্তু নটরডেম/ঢাকা কলেজ/ভিকারুন্নিসা নূন কলেজের নাম রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের পেছনে!

যাক, আমার আজকের লেখার মূল প্রসঙ্গে আসি। উচ্চ মাধ্যমিকে এবার এ+ পেয়েছে ৬১০০০ এরও বেশী পরীক্ষার্থী। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক পর্যায়ে আসন রয়েছে সাকুল্যে ৪০ হাজারের কিছু বেশী। উচ্চ শিক্ষায় অনিশ্চয়তা কতটা এবং এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মানসিকতা কেমন তা কি আমরা কেউ ভেবেছি কখনো? সর্বোচ্চ পর্যায়ের একটা ফলাফল এতটা সহজলভ্য হয়ে গেছে যে এ+ পেয়েছি বললেও কেউ চোখ ঘুরিয়ে তাকাবে না। এই অভিজ্ঞতা আমার ছোট ভাই-বোনদের এরই মধ্যে হয়ে গেছে আশা করি। অথচ আগে কেউ স্ট্যান্ড করেছে বা ২০০১-০২ সালের দিকে কেউ এ+ পেয়েছে শুনলে মানুষের মধ্যে একটা অলোড়ন সৃষ্টি হত। কথাটা ঈর্ষা করে নয়, বলছি এজন্য যে তখন এরকম সর্বোচ্চ ফলাফল এতটা সহজলভ্য ছিল না। তার অনেক কারণও ছিল। শিক্ষকদের মানসিকতায় বিরাট ঘাটতি ছিল সেসময়। বাংলা বা ইংরেজী লিটারেচার লিখে কেউ ৮০% নম্বর পাবে এটা বিশ্বাস করারই লোক ছিল না! এখন শিক্ষকদের এই মানসিকতা বদলেছে কিন্তু বিশ্বাস থেকে নয়, বদলেছে বদলে যাওয়া প্রশ্নের ধরণের কারণে। আর সর্বোচ্চ ফলাফল সহজলভ্য হওয়ার পেছনে শিক্ষার্থীদের পরিশ্রমের পাশাপাশি আছে "গ্রেডিং প্রবলেম"।

অন্য কোন গ্রেডিং নিয়ে কথা বলব না, শুধুমাত্র ৮০-১০০ নম্বর পেলেই এ+ পাওয়া যায়- এই জায়গাতেই আমার যত আপত্তি। শিক্ষার মান বাড়তে বা কমতে পারে, শিক্ষকদের মানসিকতা বদলাতে পারে, লেখাপড়ার টেকনিক বদলাতে পারে; কিন্তু এই একটা ব্যাপার এখনো বদলায়নি বলেই আমার বিশ্বাস, ৮০ পাওয়া আর ১০০ পাওয়া অবশ্যই এবং অবশ্যই একই কথা নয়। আমার শিক্ষার্থী ভাই-বোনরাও আমার সাথে এই বিষয়ে দ্বিমত করবে না আশা করি। এমনকি পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বা গণিতের মত বিষয়গুলোতেও ৭৫ নম্বরের তত্ত্বীয় পরীক্ষায় ৭০ এর উপর নম্বর পেতে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিতে হয়েছে সবাইকে। এমনকি ৯০ এর পর প্রত্যকটি নম্বরের জন্য যুদ্ধ করতে হয়েছে, শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে ৯৯ আর ১০০ পাওয়াও এক কথা নয়। সেখানে ৮০ নম্বর পাওয়া একজন পরীক্ষার্থী কি করে ৯০/৯৯ পাওয়া একজন পরীক্ষার্থীর সমমানের হয়? ৯০+ নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা নিয়ে যে স্বপ্ন দেখে, যোগ্যতা কম থাকা সত্ত্বেও ৮০ নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থীও একই স্বপ্ন দেখে এবং শেষে স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় পোড়ে। কারণ, আমাদের গ্রেডিং সিস্টেম তাকে বা তার অভিভাবককে বুঝতে দেয় না সে আসলে কোন অবস্থানে আছে।

একই কথা মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও বলব। এ+ পাওয়া শিক্ষার্থী মাত্রই স্বপ্ন দেখে নামজাদা কলেজগুলোতে ভর্তি হওয়ার। এখন ৮০ নম্বর পাওয়া এ+ শিক্ষার্থী, ৯০ নম্বর পাওয়া এ+ শিক্ষার্থীর জায়গায় যেতে না পেরে যদি গড়পড়তা মানের কলেজে ভর্তি হয় তবে তার মনটাই মরে যায়। কারণ আমাদের গ্রেডিং সিস্টেম তাকে দেখিয়েছে তুমিও এ+, তোমার স্কুলে যে তোমার চেয়ে বেশি নম্বর পেত সেও এ+, দু'জনই সমান। তাই এই ব্যাপারটা সে মেনে নিতে পারে না। অথচ সে যদি ফলাফল পাওয়ার সাথে সাথেই জানত তার অবস্থানটা আসলে কি তাহলে এই ধাক্কাটা সামলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সে মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়ে যেত। সেজন্য আরেকটা বিষয়ের অবতারনা করব, তা হল কলেজগুলোতে ভর্তি পরীক্ষা পুনরায় চালু করা। তাহলেও পরীক্ষার্থী নিজের মানদন্ডটা নিজেই আরো ভালো বুঝতে পারবে। তবে, কোচিং বাণিজ্য যেন আবার মাথাচাড়া দিয়ে না ওঠে সেটাও নিয়ন্ত্রন করতে হবে।

সর্বোপরি, আমার এত কথা বলার মূল উদ্দেশ্য অত্যন্ত সরল। সেটা হল, ৮০-১০০ এর মাঝে আরো একটি গ্রেড প্রবর্তন করা অথবা সমগ্র ফলাফলটাকে পাস-ফেল বা এ/এ+ ভিত্তিতে না করে প্রাপ্য নম্বর শতকরা (পার্সেন্ট) আকারে প্রকাশ করা। তাহলে যে কেউ বলতে পারবে আমি ৯৫% নম্বর পেয়ে পাশ করেছি। অথবা কেউ এ+ পেয়েছে বললে আমরা বুঝব সে কমপক্ষে ৯০% নম্বর পেয়েছে। এতে সর্বোচ্চ ফলাফলের একটা দাম থাকে, পরীক্ষার্থীদের যোগ্যতার সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চিত হয়।