মৃত্যুর হোটেল

আশরাফুল আলম
Published : 20 Nov 2016, 09:39 PM
Updated : 20 Nov 2016, 09:39 PM

মৃত্যুর হোটেল, যেখানে আপনি আপনার জীবনের শেষ দিনগুলো পার করবেন মৃত্যুর পথ চেয়ে । হিন্দু ধর্মালম্বীদের তীর্থস্থান ভারতের বেনারসে এই হোটেলের নাম মুক্তি হোটেল । মৃত্যু নিয়ে সাধারণত আমরা জীবদ্দশায় খুব একটা চিন্তা করি না যতটা না আমরা জীবনের শেষ ভাগে চিন্তা করি । মানে আপনি যখন নিশ্চিত হন আপনার মৃত্যু সন্নিকটে কেবল তখনি আপনি মৃত্যু নিয়ে চিন্তায় পরে যান । ভাবুন একবার একটা হোটেল যেখানে সবাই প্রতিদিন নিজের মৃত্যু কামনা করছে, তাদের ধারণা বেনারসের এই হোটেলে তাদের মৃত্যু হলে, আত্মা শান্তি পাবে । ব্যাপারটা কতটা আইন শুদ্ধ আমি জানি না, কিন্তু ধর্মীয় দিক থেকে এর গুরুত্ব হয়তো অনেক । নিজের আত্মার মুক্তির জন্য অনেক পয়সা খরচ করে আপনি হয়তো এই হোটেলে থাকতে পারেন, কিন্তু মৃত্যুর পর আপনার আত্মা আসলে শান্তি পাবে কিনা তা কেবল আপনি মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই জানতে পারবেন ।

মৃত্যু নিয়ে বিভিন্ন্ ধর্মের বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে, মুসলিম ধর্ম মতে , মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আমাদের পরকালের জীবন শুরু হয়, কৃতকর্মের ফল ভোগের দিন শুরু হয় আর হিন্দু, বৌদ্ধ, এই সব ধর্ম মতে মৃত্যুই শেষ না, এর পর পুনঃজন্ম হয় আত্মার । মৃত্যু পরবর্তী ফলাফল যাই হোক, আপনার শরীর যে আর থাকছে না এইটা আপনি নিশ্চিৎ থাকতে পারেন । আর বাকি রইলো আত্মা । যে আত্মা সম্পর্কে আপনার ধারণা খুবই কম । বেনারসের এই মুক্তি হোটেলটির মতো আরো অনেক ধরণের উপায় আছে যেখানে আপনি নিজের মৃত্যুর পর আত্মার জন্য একটা ব্যবস্থা করে যেতে পারবেন ।

লন্ডনের একটা কোম্পানি এখন আপনার শরীর ও মনকে আপনার মৃত্যুর পর বরফ  করে সংরক্ষণ  করার মতো লোভনীয় অফার দিচ্ছে । CRYOGENICS প্রক্রিয়ার  মাধ্যমে আপনার মৃত্যুর পর আপনার শরীর থেকে সব রক্ত বের করে আপনার শরীরকে একটা বরফ শীতল টিউব ভর্তি করে রেখে দেয়া হবে আজীবন। অনেকটা মমির মতো করে। গত সপ্তাহে ব্রিটিশ এক স্কুল ছাত্রী, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, আর এই মেয়েটির দেহ বর্তমানে cryogenics institute -এ একটা টিউব এর মধ্যে সংরক্ষিত । এভাবে সারাজীবন সংরক্ষণ করবে এই কোম্পানি। cryogenics institute আপনার এই দেহ সংরক্ষণ করবে ততদিন পর্যন্ত যতদিন এই পৃথিবীতে এমন কোন কিছু আবিষ্কার হবে না যেটা আপানার নিথর দেহকে আবার পুনরুজ্জীবিত করতে পারে। নিতান্তই অবাস্তব এবং কল্পনা প্রসূত এই ব্যবসাটি বেশ জমে উঠেছে এখন ইংল্যান্ড এ । নানা আইনি জটিলতা পেরিয়ে  cryogenics institute বর্তমানে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান । আপনি চাইলে আজি বুকিং দিয়ে রাখতে পারেন, তবে এর জন্য অনেক পয়সা গুনতে হবে আপনাকে । ব্রিটিশ স্কুল ছাত্রীটিকে ৩৭০০০ পাউন্ড গুণতে হয়েছিল নিজের দেহ ও মনকে সংরক্ষণ করতে  ।

এই একই মৃত্যু ভয়ে প্রাচীন মিশরের ফারাহাও রা নিজেদের দেহকে মমি করে রাখতো । আজ এতো বছর পর এসেও আমরা সেই একই পথে যাচ্ছি । এক দল যেখানে মৃত্যু ভয়ে নিজের আত্মার মুক্তির জন্য হোটেলে বসে মৃত্যু কামনা করে আর একদল নিজের দেহ, মগজ সব কিছু পরবর্তী প্রজন্মের জন্য জমা করে রাখছে, এই আশা করে হয়তো কেও না কেও একদিন তাকে মুক্তি দিবে ।

ভাববার বিষয় হচ্ছে, যে আত্মার শান্তির জন্য এতো কিছু, সেই আত্মা আসলে কী? আধুনিক যুগে, DIGITAL PHILOSOPHY নামের একটা বিষয় পৃথিবীর বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যায়লয়ে পড়ানো হচ্ছে । যার মূল বিষয় হচ্ছে ডিজিটাল আত্মা নিয়ে গবেষণা। এদের মতে আত্মা হচ্ছে অনেকটা কম্পিউটার এর মেমরি ডিস্ক এর মতো, আর এক্ষেত্রে আমাদের শরীর হচ্ছে কম্পিউটার, আর মগজ হচ্ছে CPU আর আত্মা হচ্ছে DNA কোডিং, যা প্রতিনিয়ত আমাদের শরীরে আমাদের আচার- আচরণ স্বভাব -চরিত্র এই সবের কোডিং করে স্টোর করছে আমাদের DNA তে । এই ডিএনএ এই বংশ পরাক্রমে আমাদের ছেলে মেয়েদের মাদ্ধমে বেঁচে থাকে ।

যেভাবেই আপনি মৃত্যু বা আত্মার সংঘা দেন না কেন, আপনি কিছুই প্রমান করতে পারবেন না । ধারণা ছাড়া এই মুহূর্তে আমাদের কাছে কিছুই নেই । বেনারসের, মুক্তি হোটেল বা cryogenics institute এরা কেউ -ই কি আপনার আত্মার শুদ্ধির গ্যারেন্টি দিতে পারবে? মনে হয় না । তবে এটুকু বোঝা যায়, আপনি অনেক ভয় পাচ্ছেন আপনার মৃত্যু নিয়ে । যে ভয় আপনাকে প্রচন্ড বাস্তব এক মানুষ থেকে অবাস্তব সব চিন্তা করতে বাধ্য করে । যদি তাই হয়, এই অবাস্তব চিন্তা চেতনা থেকে বের হয়ে আসার কি উপায় নেই ? মনে হয় নেই, কারণ ৮০ বা ৯০ বছরের মৃত্যু পথযাত্রী সকল বৃদ্ধের একই রকম ইচ্ছে আকাঙ্খা , বাসনা হয় । আমার আপনার ক্ষেত্রেও তাই হবে ।অত্যন্ত নরম সুরে, কোমল ভাবে অসহায়ের মতো, মেনে নিতে হবে মৃত্যুকে ।

বেঁচে থাক আপনার DNA আপনার সন্তানদের মাঝে । দেখা যাক কি হয় । দেখা হবে পরজন্মে অথবা  প্রজন্মে ।