‘স্টার্টআপ’ এর শুরু কোথায়?

আশরাফুল আলম
Published : 2 Dec 2016, 04:49 AM
Updated : 2 Dec 2016, 04:49 AM

হালযুগের ফ্যাশন "স্টার্টআপ"। অন্তত আমার কাছে। ফেইসবুক, ইউটিউব বা লিংকড ইন এর কথা ভেবে তরুণরা নিজেদের ল্যাপটপে যে স্বপ্ন বুনে তার নাম স্টার্টআপ। অন্তত বাংলাদেশের কাছে।

আমাদের দেশে স্টার্টআপ সংস্কৃতির শুরু খুব বেশি দিনের না। আধুনিক ছেলেপেলেরা নিজেদের অদম্য ইচ্ছে শক্তিকে ডিজিটাল রূপ দিবে এটাই স্বাভাবিক। আর এই ডিজিটাল ফরম্যাটে স্বপ্ন পূরণের নাম স্টার্টআপ। জুকানবার্গ যদি লেখাপড়া না করে ফেইসবুক বানাতে পারে, আমাদের দেশের ছেলেপেলেরা কি দোষ করেছে? অবশ্যই পারবে। না পারার কিছু নেই। আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু সম্যসা হচ্ছে আসলে কি পারতে হবে সেটাই সবার অজানা।

গুগল বা ইউটিউবে খুঁজলে আপনি দেখবেন ঢাকা শহরের আনাচে কানাচে গড়ে উঠছে এই "স্টার্টআপ" স্বপ্ন। আর সত্যি কথা বলতে কি অসাধারণ এই স্বপ্নের কারিগররা। বাইরের যে কোনো দেশের সাথে পাল্লা দেবার ক্ষমতা রাখে আমাদের এই স্টার্টআপ জেনারেশন। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এই তরুণরা যেমন মেধাবী তেমনই বাস্তববাদী। আর এদের ব্যাবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিও একেবারে অন্যরকম।

কিনতু এই স্টার্টআপ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কি? প্রথমেই আসি নেতিবাচক দিক নিয়ে। কারণ এতে ইতিবাচক দিকটা আপনি পড়বেন কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন আর হয়তো আপনার মূল্যবান কিছু সময় বাঁচবে। চিরচায়িত বাঙালি স্বভাবের অংশ হিসাবে আমরা স্টার্টআপ এর কথা বলতেই একগাদা সফল স্টার্টআপ তারকার উদাহরণ টেনে আনি। জুকারবার্গ, স্টিভ জবস আরো কতো কে। কিন্তু একবারও ভাবি না এদের কারো জন্মই আমাদের দেশে না। জন্মানোর দেশটা যে কতো বড় ব্যাপার এই স্টার্টআপের জন্য তা হয়তো জানলেও মানতে চাই না আমরা। যে দেশে জন্মেছি সেখানে জন্মানোর পর পরই বাবা মা ঠিক করে দেয় আমরা কে কি হবো। আর বড় হতে হতে এই পরিকল্পনার দায়িত্ব পায় আমার আপনার বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড। এবং সজ্ঞানে কোন বাবা- মা বা বন্ধু -বান্ধবী আপনার এই স্টার্টআপ এর গল্প মেনে নেবে আমার মনে হয় না।

আমাদের দেশে লেখাপড়া করার অন্তিম ফল হলো একটা ভালো চাকরী বা পেশায় ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার এরকম কিছু। আপনি বাসায় সবার সাথে ঝগড়া করে তাবলীগের চিল্লায় চলে যেতে পারবেন। কিন্তু নিজের স্টার্টআপের আইডিয়া কাওকে বুঝাতে পারবেন না। তবে আপনি যদি প্রচণ্ড বড়োলোকের ঘরে জন্ম নেন তাহলে ভিন্ন কথা। বর্তমানে আমাদের দেশে স্টার্টআপ জেনারেশন বলতে যাদের বলছি এরা সবাই স্বচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়ে। আর আমার ধারণা সমস্যা এখানেই।

কারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা যেমন তাদের স্টার্টআপ আইডিয়া সহজে পরিবারের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে না। ঠিক তেমনি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে-মেয়েদের স্টার্টআপ আইডিয়া বাস্তবায়নের ধৈর্য বা কষ্ট করার মানসিকতা নেই। জুকারবার্গ বা স্টিভ জবসের গল্প বলতে ভালো লাগে। কিন্তু নিজের স্টার্টআপের জন্য এই পর্যন্ত দেশে কেও পড়াশুনা ছেড়ে দিয়েছে এরকম আমার জানা নেই। নিজের প্রতি আর নিজের আইডিয়ার প্রতি বিশ্বাস থাকলে কেও না কেও দেশের কোন না কোন প্রান্ত থেকে সবকিছু ছেড়ে আইডিয়া বাস্তবায়নে লেগে পড়তো।

এখানেই পার্থক্য জন্মগত পরিবেশের। আমার আপনার সারাটা জীবন চলে যায় ভাবতে ভাবতে। আর যাদের গল্প বলছেন তারা সারাটা জীবন দিয়ে দিতে পারে নিজের একটা ইচ্ছে পূরণে।

স্বপ্নের অসঙ্গতি চরম আমাদের মাঝে। বেশির ভাগ স্টার্টআপ হলো অনলাইন ভিত্তিক বা ওয়েব বেসড্ কিছু একটা। এর কারণ আমাদের তরুণরা স্টার্টআপ বলতে এটাই বুঝে। আপনি যদি আমেরিকার দিকে তাকান দেখবেন এদের বেশির ভাগ স্টার্টআপ পণ্য নির্ভর। প্রতিদিন এরা নতুন কিছু না কিছু বানাচ্ছে। অদ্ভুত অদ্ভুত সব আবিষ্কার। আর এইসব পণ্য মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে সারা আমেরিকা জুড়ে। যোগ হচ্ছে নতুন স্টার্টআপের গল্প। আমাদের তরুণরা এইসব পণ্য নির্ভর স্টার্টআপের গল্প জানে না। কারণ আমেরিকার সীমানা পেরিয়ে এই সফল গল্পগুলো আমাদের দেশ পর্যন্ত যাবার আগেই চায়না থেকে একই পণ্যের নকল কপি পেয়ে যাই আমরা। স্টার্টআপ পণ্যের গল্প হয়ে যায় চাইনিজ নকল ভার্সন। তবে আইফোনের মতো কিছু ব্র্যান্ড আমেরিকার সীমানা পেরিয়ে আমাদের কাছে পৌঁছে। আর আমরা এই একটি গল্প নিয়েই নিজেদের স্বপ্ন বোনা শুরু করি।

উপরের ছবির হুভার ক্যামেরা ড্রোনটি হালের আমেরিকান স্টার্টআপ। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন এর হুবহু নকল শিগ্রই আসবে চায়না থেকে অথবা এখনো আছে এর চায়না ভার্সন। এরমানে এই নয়া আমেরিকান স্টার্টআপ ব্যবসা করবে না। বরং একটা ড্রোন ক্যামেরা ৬০০ ডলার আর মাত্র মাস খানেক ব্যবসা করে মিলিয়ন ডলার কমাবে এই স্টার্টআপ। এরপর চায়না নকল বানালেও কিছু যায় আসে না।

ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই। গন্ডগ্রামের ছেলে হামিদ। স্কুল শেষ করতে পারেনি। কাজ করতো একটা ফটোকপির দোকানে। শেষবার যখন দেখা হয়েছিল তখন বলেছিলো কি যেন মসা মারার একটা যন্ত্র আবিষ্কার করেছে সে। আপনার মতো আমিও বেশ বিরক্ত হয়েছিলাম। আজ ৫ বছর পর দেখলাম সেই ছেলে তার মশা মারার যন্ত্র পেটেন্ট করিয়েছে আর প্রায় ১ লক্ষ্য পিচ বিক্রি করেছে সরকারি হাসপাতাল গুলোতে। পণ্যের নাম হাস্যকর ভাবে "হামিদ মস্কিটো কিলার" আর নিজের ফেইসবুক আইডি "ইনভেন্টর হামিদ" ব্যাপারটা খুবই হাস্যকর। মানে চিরচায়িত স্টার্টআপ কালচারের সাথে যায় না। কিন্তু আপনি এই মুহূর্তে আমাকে যদি ফান্ড বা ইনভেস্ট করতে বলেন আমি হামিদকেই বেছে নেবো। কারণ হামিদ এই পর্যন্ত সফল।

এরকম অনেক হামিদ আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আছে এদের পড়াশুনার অভাব সাথে নিজেকে সঠিক ভাবে উপস্থাপনের অভাব। কিন্তু স্টার্টআপের জন্য যে আইডিয়া দরকার তা কিন্তু এদের আছে এবং অনেক ভালো ভাবেই। বুঝতেই পারছেন সমস্যা কোথায়? ঢাকার বারিধারায় বা গুলশানের স্টার্টআপ জেনারেশন আর গন্ডগ্রামের এই সব হামিদদের স্টার্টআপ আইডিয়া কি আপনি একসাথে করতে পারবেন? খুব সম্ভব না। কারণ এটা মূল্যবোধের প্রশ্ন।

স্টার্টআপের ওয়েবসাইট গুলো যদি টেকনাফের জেলেদের কাছে চাইনিজ জাল বিক্রি করতো অথবা এইসব জেলেদের মাছ গুলো অনলাইন বিক্রি করে দিতো। কেমন হতো ব্যাপারটা? কিন্তু একটা স্টার্টআপ ওয়েবসাইট যখন আমার কাছে এমন একটা পণ্য বিক্রি করতে চায় যেটা আমি অনেক সস্তায় আরো অনেক আগে ব্যবহার করে ফেলেছি। তখন এই স্টার্টআপের কোন মূল্য থাকে না।

ঠিক এই ভুল ধারণার কারণে উবার ট্যাক্সির বাংলাদেশে এই রকম বাজে ভাবে শুরু হলো। কারণ আমেরিকাতে সফল ভেবেই আমাদের দেশের স্টার্টআপ জেনারেশন উঠে পড়ে লাগলো উবার নিয়ে। একবার চিন্তা করলো না পরিবেশ নিয়ে।

সরকারী বা বেসরকারী ভাবে আমাদের দেশে স্টার্টআপ ফান্ডিং বা আর্থিক সহায়তা বেশ চোখে পড়ার মতো। সরকারের আই সি টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে আছে স্টার্টআপ এর জন্য আলাদা সুযোগ-সুবিধা। টেলিকম কোম্পানি গ্রামীনফোন, রবি এরা সবাই নিজেদের ব্রান্ডের মাধ্যমে সহযোগিতা করছে এই সব তরুণ উদ্যোক্তাদের। কিন্তু সরকারিভাবে একবার যদি এইসব তরুণদের পরিবারকে বলা হতো আপনার ছেলের পাশে আমরা আছি। তাহলে হয়তো আরো অবাক দ্রুত আমাদের স্টার্টআপ ধারণের বিস্তৃতি হতো।

আমেরিকাতে একটা ছেলে স্কুল পালালেও ব্যাবসায়িক ভাবে সফল হতে পারে। কারণ তার বেড়ে উঠার যে পরিবেশ তা আমাদের দেশের যে কোন ব্যবসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ভালো। এই রকম পরিবেশে বেড়ে উঠলে খুব একটা স্কুলে যাবার প্রয়োজন পরে না। যে আঙ্গিকে নিজেদের ভাবছে আজকের স্টার্টআপ জেনারেশন তা যাচাই করে নেয়া ভালো। কারণ শুধু একটা ওয়েবসাইট দিয়ে নিজেকে সফল করার দিন এখন আর নেই। কিছু একটা আমাকে দিন যেটা আমি কিনতে পারি আর আমার নিজের জন্য ব্যবহার করতে পারি। আমি কিনলে তবেই আপনার স্টার্টআপ সফল হবে।