‘শ্রাবণ’ মেঘের দিনে

আশরাফুল আলম
Published : 28 Dec 2016, 04:00 PM
Updated : 28 Dec 2016, 04:00 PM

গুগলে পেংগুইন পাবলিশার্স এর নাম সার্চ দিলে পেংগুইন পাবলিশার্স এর লোগো ভেসে উঠে । আর শ্রাবণ পাবলিশার্স সার্চ দিলে হুমায়ুন আহমেদের বই এর মলাট ভেসে উঠে । জাতি লেখককে চেনে প্রকাশককে না । সুতরাং প্রকাশক মারা গেলেও কেউ জানবে না । কিন্তু লেখককে মরতে দেয়া যাবে না । অবাক উল্টো রথে আমরা । সে যাই হোক । চাইলেই উল্টো রথ আপনি সোজা করতে পারবেন না । ব্যাপারটা ধর্মীয় অনুভূতির । চলুক উল্টো । আপনি আপনার মুখ ঘুরিয়ে নিলেই তো হয় ।

বাংলা একাডেমি শ্রাবণ প্রকাশনীকে দুই বছরের জন্য বই মেলায় নিষিদ্ধ করেছে । তুলকালাম হচ্ছে এই নিয়ে ফেইসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে । পক্ষে-বিপক্ষে না গিয়ে আলোচনা করা যাক, এখন এই অবস্থায় ওই প্রকাশনী সংস্থার করণীয় কী? প্রত্যেকটা জিনিসের কিছু না কিছু মাহাত্ম থাকে । বই মেলায় নিষিদ্ধ থাকা অবস্থায় কি এই প্রকাশনী  টিকে থাকতে পারে? পারলে কিভাবে?

প্রথমেই আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে আমরা যত বেশি এই বিষয়ে কথা বলবো তত কঠিন হবে শ্রাবণ প্রকাশনীর পক্ষে বাংলা একাডেমির সাথে আপোষ করতে। আরো বুঝতে হবে বাংলা একাডেমি একটা সরকারি সংস্থা । আর একবার কোন সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি হলে তা পাল্টানো অনেকটা অসম্ভব । আমাদের আবেগি মন না বুঝলেও বইয়ের ব্যবসা করতে হলে এটুকু বুঝতে হবেই । সুতারং শ্রাবণ প্রকাশনীকে এই মুহূর্তে নিজেদের জন্য অল্টারনেটিভ পথ খুঁজে নিতে হবে।

প্রকাশনী সংস্থাগুলোর প্রধান বেচাবিক্রি হয় একুশে বই মেলায়। যেহেতু বই মেলায় ঢোকা প্রায় বন্ধ। শ্রাবণ প্রকাশনী এই মুহূর্তের জন্য চাইলেই এর সবগুলো বইয়ের ডিজিটাল সংস্করণ বাজারে ছাড়তে পারে । ভাবছেন প্রলাপ? আসলে একটু অংক কষলে দেখবেন খুব একটা ক্ষতি হবে না শ্রাবণ প্রকাশনীর । কাগজের বই প্রকাশের অপারেটিং খরচ বাদ দিয়ে নিট মুনাফা কত থাকে তা বিবেচ্য বিষয় । কারণ বাংলা একাডেমিকে পুরো মাসের ভাড়া দিয়ে আসলে কি পরিমান নিট মুনাফা প্রকাশকরা পান তা আমার জানা নেই । আমরা শুধু ক্ষুদ্র ভাবে বিক্রির অংকটা দেখি । প্রকাশকের খরচ আমরা দেখি না । প্রকাশনার খরচ কমিয়ে আনলে আর অনলাইন সাবস্ক্রিপশন এর জন্য অল্প কিছু টাকা নিলে খুব একটা ক্ষতি হয়তো হবে না । অন্তত মন্দের ভালো তো হবে । মাঝখান থেকে শ্রাবণ প্রকাশনী ডিজিটাল প্লাটফর্মে প্রবেশ করে যেতে পারবে ।

এখন প্রশ্ন হলো কে বা কারা শ্রাবণ প্রকাশনীর বই অনলাইনে টাকা দিয়ে পড়বে? যে পরিমান পাঠক এই মুহূর্তে শ্রাবণ প্রকাশনীর জন্য অনলাইনে জান দিয়ে দিচ্ছে তারাও যদি পড়ে তাহলেও এই প্রকাশনী টিকে যাবে অনলাইনে । যাই হোক, টাকাপয়সা খরচের ব্যাপার আসলে কতজন থাকে সেটাই দেখার বিষয় । এরপর শ্রাবণ প্রকাশনী চাইলে কাগজের বই অনলাইনে বিক্রি করতে পারে । রকমারি বা অন্য অনলাইন সাইটে খুব একটা খারাপ বিক্রি হয় না । এর জন্য যা করতে হবে তা হচ্ছে শ্রাবণ প্রকাশনীর প্রচার বা ব্র্যান্ডিং । খুব সম্ভবত এই জিনিসটি এখনো কোন প্রকাশনা সংস্থা করে না আমাদের দেশে । এখন সময় এসেছে ব্র্যান্ডিং করার ।

আজকে শ্রাবণ প্রকাশনীকে ঘাড় ধরে বের করে দেয়া হলো বাংলা একাডেমি থেকে । অথচ এই প্রকাশনার  জন্য চিৎকার করার লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না । কারণ এতদিন প্রকাশনী আসলে লেখকের বই বিক্রি এতদিন। সবাই লেখককে চিনে । প্রকাশনীর নাম কেউ জানে না । ভাবুন, একবার আমেরিকাতে পেঙ্গুইন পাবলিশার্স এর কথা । এখানে মানুষ পেঙ্গুইনের বই কিনে । এরা লেখককে চেনার প্রয়োজন বোধ করে না । কারণ পেঙ্গুইন একটা ব্র্যান্ড । সুতরাং একটু নিজের ব্র্যান্ড নিয়ে ভাবুন। দেখবেন চাইলেই কেউ ঘাড় ধাক্কা দিতে পারবে না ।

যে পরিমান সহানুভূতি শ্রাবণ প্রকাশনী পাচ্ছে এখন মানুষের কাছ থেকে একে যদি কাজে লাগাতে পারে তবে ভিন্ন ভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে এই প্রকাশনী সংস্থাটি । লেখকরা সটকে পড়বে এটাই স্বাভাবিক । দেশে লেখকের অভাব নেই । যদি প্রকাশনী সংস্থা নিজে ব্রান্ড হয় তাহলে যে কোন লেখকের বই মুড়ির মতো বিক্রি হবে । জন্ম হবে নতুন লেখকের ।

শ্রাবণ প্রকাশনীকে বই মেলার ভিতরে নিষিদ্ধ করা হয়েছে । বাইরে তো না । এই প্রকাশনী তো চাইলে মোবাইল বাস লাইব্রেরির মাধ্যমে রাস্তায় বিক্রি করতে পারে । এ জন্য ঢাকা মেট্রোপোলিটন পুলিশ থেকে অনুমতি নিলেই হয় । অনেকটা বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের মোবাইল বাসগুলোর মতো । মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়বে শ্রাবণ প্রকাশনীর বই কেনার জন্য । কারণ নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আমাদের আকর্ষণ এমনিতেই বেশি থাকে ।

এরকম আরো হাজারটা পথ শ্রাবণ প্রকাশনী বেছে নিতে পারেন । কিন্তু যদি ভাবা হয় কাগজের বই ছাড়া একটি প্রকাশনী বাঁচবে না, তবে ভুল ভাবছেন । নিষিদ্ধতার এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে । কারণ এই 'নিষিদ্ধতা' নিয়ে খুব একটা বেশি কিছু করার নেই । বরং এটাই সময় একটা পরিবর্তনের ।  হয়তো শ্রাবণ প্রকাশনীই দেশের প্রথম ডিজিটাল পাবলিশার্স হয়ে উঠতে পারে । যদি তাই হয় তবেে এই ডিজিটাল সরকারই শ্রাবণ প্রকাশনীকে সাদর সম্ভাষণ জানাবে নিঃস্বন্দেহে!