ফেসবুক স্ট্যাটাস ও মনের ফাইন টিউনিং

আশরাফুল আলম
Published : 14 May 2017, 04:50 PM
Updated : 14 May 2017, 04:50 PM

পুরুষ মানুষের ভেউ ভেউ করে কান্না করাটা মানায় না । না মানালেও এই রকম হিচঁকে কান্নার অভিজ্ঞতা আমার আছে । টানা দুই সপ্তাহ ধরে কেঁদেছি । খাওয়া দাওয়া নেই । রান্না বান্না নেই । খুব খিদে লাগলে পাশের ম্যাকডোনাল্ড থেকে কিনে খেতাম । বুজতেই পারছেন যেহেতু ম্যাকডোনাল্ড আছে গল্পে, গল্প বিদেশী । কিন্তু বিদেশে এই দেশি কান্নার কারণ বেশ বিদেশি ধাঁচের । আমেরিকার ইলেকশনের সময় স্ত্রী আর দুই কন্যা দেশ থেকে ফেরার পথে ইমিগ্র্যাশন এর জেরার মুখে আবার দেশে ফেরত যেতে বাধ্য হয় । এমতবস্থায় দুই সপ্তাহ মরা কান্না তেমন কোনো বিষয় নয় । কিন্তু ব্যাপারটা হলো এই কান্না থামানোর উপায় । আমেরিকার মতো দেশে দুই দিনও এই বাংলা নাটক চালানো সম্ভব না । আমার অবস্থা দেখে আমার বাড়িওলা প্রায় প্রতিদিন এসে শান্তনা দিতেন । শান্তনা দিতেন আমার মন বসার জন্য না । শান্তনা দিতেন যাতে আমি পরের দিন কাজে যাই । উনি নিতান্তই চিন্তিত ছিলেন উনার বাসা ভাড়া নিয়ে । এই দেশে এইরকম মরা কান্নার কোন দাম নেই ।

কিন্তু স্ত্রী আর কন্যা শোক থেকে কিভাবে বের হয়ে আশা যায় আমি বুঝতে পারছিলাম না । একা বাসায় আরো বেশি খারাপ লাগতো । ধীরে ধীরে আমি সেরে উঠলাম । মনকে অনেক শক্ত করলাম । বাজার করলাম । রান্না বান্না করলাম । কাজে গেলাম । তবে নিজে নিজে মরা কান্না থেকে উঠে আশা অত সহজ ব্যাপার নয় । মনকে কঠিন করার জন্য আমি ইউটউব এর মন শক্ত করার ভিডিওগুলো দেখতাম । সে যাই হোক গত এক বছরে মন এতটাই শক্ত হয়েছে আমার এখন রীতিমতো ভয় লাগে। গেলো সপ্তাহে দেশে বেশ কিছু ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে কথা বলছিলাম এক বন্ধুর সাথে। হঠাৎ করেই বলে বসলাম আমি হলে কিভাবে ভাড়া করা কিলার বা খুনি দিয়ে ওই ধর্ষকদের খুন করিয়ে ফেলতাম পুলিশের কাছে না গিয়ে । কথার কথা নয়। কথাগুলো বলার বেশ কিছুক্ষন পর মনে হলো আমি যেন কেমন হয়ে গেছি। যেহেতু একা থাকি আমি আমার আচরণ পর্যবেক্ষণ করার কেউ নেই । আমি নিজেই আমার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করি ।

ছুটির দিনগুলোতে দেশের নাটক দেখে বোঝার চেষ্টা করি সমসাময়িক জীবন ধারা। হাজার বুঝবার চেষ্টা করলেও বুজতে পারছিলাম আমি বদলে যাচ্ছি অনেক । নাহলে মানুষ খুনের মতো একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার আমি এতো সহজে আর ঠাণ্ডা মাথায় কিভাবে প্ল্যান করে ফেললাম । সে যেই হোক ধর্ষক বা খুনি , আইনের মাধ্যমে তার বিচার হবে এটাই স্বাভাবিক । আর আমি যদি স্বাভাবিক হই তবে এটাই আমি ভাববো। বুঝতে পারছিলাম আমার নিজের মনকে আবার নরম করতে হবে । ব্যাপারটা মনের ফাইন টিউনিং । আমি সবসময় মন নরম করার জন্য কলকাতার আর্ট মুভি গুলো দেখি । মফস্বল ধাঁচের কলকাতার এই ছবিগুলো এতটাই নরম আর অবাস্তব যা আমার মনকে কিছুটা অবাস্তব ভাবে নরম করে তুলে ।বেশ কিছু ওই রকম নেকা ছবি দেখার পর মন কিছুটা দেশীয় হলো । ভাগ্গিশ দাদাদের এই ছবি গুলো ছিল নাইলে তো আমি সিরিয়াল কিলার হয়ে যেতাম । তবে মনকে আবার খুব বেশি নরমও করে ফেলা যাবে না । কারণ আমেরিকায় থাকতে হলে শক্ত মন লাগবে ।

সপ্তাহের কোন দিন কোন ধরণের ছবি না নাটক দেখবো তার একটা লিস্ট আছে আমার । টিভিতে এ লিস্ট সেট করা । টিভি ছাড়লেই সটাং করে পছন্দের নাটক না ছবিটা বের হয়ে পরে । যেমন ধরুন সোম বার থেকে শুক্র বার সব বিদেশী ছবি আর শনিবার রবিবার দেশীয় নাটক বা সিরিয়াল । কারণ বন্ধের এই দুটি দিনে আমি দেশে পরিবারের সাথে কথা বলি । সুক্ষ ভাবে বলতে গেলে আমার মনের আচরণ আসলে পুরোটাই নির্ভর করে আমার টিভি চ্যানেল এর উপর । যেমন ধরুন ভুল করে যদি কোনো সোমবার আমি বাংলা নাটক দেখে ফেলি ওই দিন আমার আবার কান্না পায় । কিন্তু কাজের এই দিনে মোটেই কান্নাকাটি করা যাবে না। সুতরাং বুঝতেই পারছেন আমার মনের ঘড়ি পুরোপুরি করন জোহরের ছবির সাথে উঠা নামা করে।

বিচারকের অস্বস্তির কথা আপনারা জানেন। কোন বিচার কাজে হঠাৎ করে বিচারক যদি অস্বস্তিতে পড়েন তাহলে উনি তখনি বিচার কার্য বন্ধ করে দেন । খুবই বাস্তবিক এই নিয়ম। মন না বসলে জোর করে তো আর মনকে বসানো যাবে না । ধরুন একদিন বিচারকের মনে হলো ফাঁসি দিয়ে দিতে আর পরের দিন যদি মনে হয় আগের দিনের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল তাহলেই বুজেন কি অবস্থা হবে । আমাদের সবার মনেরই একই অবস্থা । ফেসবুকের স্টেটাস গুলো নিয়ে আমার একটা অবসেরভেশন আছে । আমি খেয়াল করে দেখেছি শুক্রবার আমার ফ্রেন্ড লিস্ট এর প্রায় সবার মন নরম হয়ে যায় । নামাজ কলমা পরে । আল্লাহ খোদার নাম নেয় । রবিবার বেশির ভাগ পোস্ট রাস্তার জ্যাম নিয়ে । আর অন্য দিন গুলোতে যে কোনো একটা ইসু নিয়ে আন্দোলন মুখী আচরণ ।

খুব সামান্য মনে হলেও সোশ্যাল মিডিয়াতে আমাদের এই আচরণ অনেক বড় একটা ব্যাপার । সরকার বা নীতিনির্ধারক মহল বেশ ভালোভাবে সোশ্যাল মিডিয়ার এই আচরণ পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। আর যেহেতু সামনে ইলেকশন তাই জনগণের মত এর পক্ষে থাকার জন্য সরকার সোশ্যাল মিডিয়ার এই আচরণের পক্ষে থাকছে । আপাতত হলেও । কিন্তু সমস্যা হলো সপ্তাহের ভিন্ন ভিন্ন দিনে আমাদের ভিন্ন ভিন্ন আচরণ । যদি এই রকমই হয় তাহলে বুঝতে হবে সোশ্যাল মিডিয়াতে আমাদের আচরণ নির্ভর করে শীত-গ্রীষ্ম অথবা বর্ষার উপর। আকাশে একটু মেঘ করলেই আমরা আবেগি হয়ে উঠি। বেশির ভাগ আমরা ওই সময়টাতে রবি বাবুর মতো আচরণ করি । আরো মজার ব্যাপার হলো আমরা আমাদের ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ার স্টেটাস বেঞ্চমার্কিং করে থাকি । মানে হলো যে সব ঘটনা মেট্রো এরিয়াতে হয় ওই ঘটনা গুলো নিয়ে আমরা বেশ সোচ্চার । এর কারণ শব্দের ব্র্যান্ডিং । আমি বা আপনি যখন আমাদের স্টেটাস আপডেট দিয়ে থাকি তখন প্রতিটা শব্দ নিয়ে বেশ ভালো ভাবে চিন্তা করি । শব্দের মাঝে যদি লন্ডন বা নিউ ইয়র্ক থাকে তাহলে যেভাবে ব্র্যান্ডিং হবে নোয়াপাড়া বা কান্দির পার ঠিক ঐভাবে হয়তো আপনার স্ট্যাটাসের সাথে যায় না ।

অপরাধ বা অপরাধী সপ্তাহের দিনক্ষণ হিসেবে অপরাধ করে না । কোন অপরাধের জন্য আমাদের মনকে কিভাবে সেট করতে হবে তা নিতান্তই আমাদের নিজেদের মধ্যে। কঠিন মনের একজন আবেগী কথা বলবেন না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে উনি এই ব্যাপারটা এড়িয়ে যাবেন তাও ঠিক না । ধর্ষণের বা ধর্ষকদের বিরুদ্ধে স্টেটাস হয়তো আপনার সোশ্যাল ইমেজের সাথে যায় না । তাই বলে আপনি চুপ করে বসে থাকতে পারেন না। মানলাম আপনার মন অনেক শক্ত। অন্যদের মতো ফেসবুকে একটা স্টেটাস দিয়ে ঝড় তুলতে চান না আপনি।

যদি আপনি এই দুই ধরণের মানুষের কোনোটাতেই না পড়েন তবে বুঝতে হবে আপনি টিভি নাটক বা সিনেমা দেখেন না । আপনি খবরের কাগজ কম পড়েন । আর আপনার বেশির ভাগ সময় চাকরি বাকরি করে চলে। আমি এটুকু বলতে পারি এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মতো একটি দেশে আপনি অনেক বিপদের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। কারণ কাল আপনার বা আপনার পরিবারের সাথেও অনেক কিছু হয়ে যেতে পারে। এই দেশে এখন বিচার মানে জনমত বা নিজের যোগ্যতা। কোনোটাই যদি আপনার না থাকে তাহলে আসুন এখনই নাটক সিনেমা দেখা শুরু করি । লিস্ট করে ফেলি কোন নাটক দেখে কান্না পাচ্ছে আর কোন নাটক দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন। এরপর গড়ে তুলুন আপনার ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়া ইমেজ । বিশ্বাস করুন এটাই চলছে এখন। মন মানসিকতা ক্ষমতা ইমেজ শব্দগুলো জীবনের সাথে যুক্তকরে নিন। কাজে দিবে বিপদের সময়।

প্রচন্ড আবেগী হয়ে ফেসবুকে কিছু লেখার আগে একবার ভেবে নিন আপনার নিজের সাথে যায় কিনা ওই স্ট্যাটাস। কারণ অনেকেই দেখছে আপনাকে। হয়তো আপনার সন্তানরাও।