একটি ফ্যাক্স ও আমার স্যার এর কথা

আশরাফুল আলম
Published : 20 May 2017, 04:29 AM
Updated : 20 May 2017, 04:29 AM

আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধুরা আমাকে ফ্যাক্স নামে ডাকতো। এই নামের একটা মহাত্ম আছে বৈকি। প্রায় একযুগেরও বেশি আগে আমি যখন ভার্সিটিতে প্রথম সেমিস্টার এর ছাত্র তখন এক এলাহী কান্ড করে বসি। ভার্সিটি প্রশাসনকে না জানিয়ে আমি একটা ফ্যাক্স করে বসি আমেরিকার একটা ইউনিভার্সিটিতে আমার ক্রেডিট ট্রান্সফার এর জন্য।

সমস্যার শুরুটা হয় এই ফ্যাক্স নিয়ে। এই ফ্যাক্স এর জন্য আমাকে যে কি পরিমাণ যন্ত্রণাভোগ করতে হয়েছে তা আমি এখনো ভুলিনি। যন্ত্রণার কারণ আমার এক শিক্ষক সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ। যিনি বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক এর ভাইস চেয়ারম্যান আর আজকের সংবাদপত্রের শিরোনাম। আমার ফ্যাক্স এর কারণে আমেরিকার ওই ইউনিভার্সিটির এক অধ্যাপক উড়াল দিয়ে দেশে আসেন সগোচরে আমার ইউনিভার্সিটির সব কিছু দেখার জন্য আর আমার সাথে কথা বলার জন্য। ভদ্রলোকের আকস্মিক এই ভ্রমণে যেমন আমি ছিলাম অপ্রস্তুত তেমনি আমাদের ডিন বা পারভেজ স্যার ছিলেন হতভাগ। কারণ নিউ হ্যাম্পশায়ার নামের ওই ইউনিভার্সিটির সাথে আমাদের ক্রেডিট ট্রান্সফার এগ্রিমেন্ট ছিল। কিন্তু কোনও এক অদ্ভুত কারণে পারভেজ স্যার এতটাই খেপেছিলেন আমার উপর আমি ভয়ে আমেরিকার ওই অধ্যাপকের সাথে দেখা করিনি। সেদিন হয়তো আমার আমেরিকা আসার স্বপ্ন ভেস্তে গিয়েছিলো ভয়ে। কিন্তু আজ এই লেখাটি আমেরিকা থেকেই লিখতে পেরে আমি খুশি।

ব্যাপক ভাবে পরিচিত পারভেজ স্যার একধারে যেমন আলোচিত তেমনি সমালোচিত। উনার ব্যক্তিগত ইমেজ আর বিত্তশালীতা বেশ চোখে পড়ার মতো। বেশ প্রতাপ আর প্রভাবশালী আমার এই স্যার এর সামনে আমি তেমন একটা যেতাম না। খুব সম্ভবত আমি নয় কেওই যেতে চাইতো না। শিক্ষক হিসাবে উনি কেমন তা একজন ছাত্র হিসেবে আলোচনার বিষয় বস্তু হতে পারে না। তবে দেশের বেসরকারি একটি ব্যাংকের পরিচালক পদে থাকায় কিছু বলা যেতেই পারে। আমার জানা মতে আমাদের দেশে যে কোনো সরকারি উচ্চ পদের আসনে বসার আগে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা গুলোর চোখের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়। অফিসিয়াল রেকর্ড আর রাজনৈতিক পরিচয় সুনিশ্চিত হবার পরই কেবল একজন এমন পদের জন্য মনোনীত হতে পারেন। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এই ধরনের নিয়ম। সুতরাং এটা মেনে নেয়া যেতেই পারে। কিন্তু নির্ধারিত ব্যাক্তির মানসিক বা মনস্তাত্ত্বিক ধ্যান ধারণা কেমন এ নিয়ে কোনো সরকারেরই মাথা ব্যথা থাকে না। ঠিক যে কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো মানুষ আজকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।

স্যারের সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনেক মিল খুঁজে পাই আমি। প্রচন্ড বিত্তশালী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলে যা হয়। স্যার একদিন ক্লাসে বলেছিলেন উনি "ক" আর "ছ" বর্গীয় গালি টাকা দিয়ে মানুষ থেকে শিখেছিলেন। স্যার বেশ ব্যাপকভাবে এই দুই বর্গের গালি সমানে সবাইকে প্রয়োগ করতেন। যাই হোক এটা হতেই পারে। তখন তো আর ফেসবুকের যুগ ছিল না। যে কিছু হলেই সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে যাবে।

আমাদের দেশের বিশ্যবিদ্যালয় গুলোর বেশির ভাগ অধ্যাপক বাইরের দেশ থেকে পিএইচডি বা ওই মাপের ডিগ্রিপ্রাপ্ত। তবে এর ব্যতিক্রম যে হয় না তা কিন্তু না, হতেই পারে। কেবল পুঁথিগত শিক্ষা তো আর শিক্ষা নয়। অনেক সময় পারিবারিক আর্থিক ব্যাপারটাও লক্ষ্য রাখার মতো কিছু একটা হয়তো। সে যাই হোক স্যার এর সাথে বর্তমানে ফেসবুকে যোগাযোগ হয়। স্যার এখনো মাঝে মধ্যে নিউ ইয়র্ক আসলে কথা হয়। টিভিতে টকশো তে দেখি। ভালোই লাগে। বলতে পারি সবাইকে আমি ভদ্রলোককে চিনি। উনি আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন।

আজকের (১৯ মে) প্রথম আলো পরে বেশ খারাপ লাগলো। দুর্দান্ত প্রতাপের আমার এই শিক্ষককে নাকি ইসলামী ব্যাংক এর পরিচালক পদ থেকে সরে যেতে বলা হয়েছে। অথবা উনি নিজেই নাকি এই পদ ছেড়ে দেবেন এই রকম বলেছেন। যারা স্যার কে ব্যক্তিগত ভাবে জানেন তারা সবাই জানেন স্যার একটা পদে এর আগে সর্বোচ্চ কতদিন থেকেছেন। ডিজিএআই বা অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা গুলো উচ্চ পর্যায়ে ঠিক কি রিপোর্ট দিচ্ছেন আমার জানা নেই। প্রধানমন্ত্রীও নাকি বেশ নাখোশ স্যার এর উপর উনার অর্বাচীন কথা বার্তা নিয়ে। স্যার কি যেন কি উলটা-পাল্টা বলছেন প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে। কিন্তু আজ এতদিন বাদে সবার মনে হলো উনি উল্টা-পাল্টা বলছেন। আমার জানা মতে উনি কখনোই রাখঢাক করে কথা বলেন না। এটা উনার বিশেষ গুনের পর্যায়ে পরে।

একজন শিক্ষক হলেই যে উনি সব কিছু জানবেন তার কোন মানে নেই। একজন শিক্ষক হলেই যে উনি মানসিক ভাবে স্থির হবে তারও কোন গ্যারেন্টি নেই। পেশা আর ব্যক্তিগত আচরণের মাঝে যোগসাজন আছে। আমরা সেদিন তীব্র প্রতিবাদ করেছিলাম আমাদের এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি হওয়াতে আমরা পেরেছিলাম স্যার কে বিদায় জানাতে আমাদের ইউনিভার্সিটি থেকে। কিন্তু সরকার চাইলেই পারছেন না পিছু হটে আসতে। ইসলামী ব্যাংকের মহা পরিচালক আর পরিচালকের দ্বন্দ্বে হয়তো প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত এই আলোচনা এগিয়ে গেছে। পারতপক্ষে এই ধরনের ঘটনা হরহামেশা হচ্ছে আমাদের মাঝে। ব্যাংক বীমা বা ইউনিভার্সিটি এই ধরনের কর্পোরেট স্থানগুলোতে কি মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকতে পারে না? টাকা আর বাহুবলে অসুস্থ বিকারের লোকজন সমানে মিথ্যে বলে যাবে আর আমাদেরকে তা বিশ্বাস করতে হবে? কিছু কি বলাও যাবে না?

আজকে অনেক মনে পড়ছে আমার ফ্যাক্স এর কথা। ওই দিন আমি হয়তো ফ্যাক্স টা করে অনেক জটিলতা তৈরী করেছিলাম আমার জীবনে। আজকে আমার শিক্ষক ফেসবুকে স্টাটাস আপডেট দিয়ে একই পরিস্থিতির শিকার। ভাবতে খুব ভালো না লাগলেও খুব একটা যে খারাপ লাগছে তাও কিন্তু না।