চলচ্চিত্রের ব্যবসা ভাবনা ও আমরা

আশরাফুল আলম
Published : 25 Sept 2017, 05:50 AM
Updated : 25 Sept 2017, 05:50 AM

ছোটবেলায় টিভিতে শাড়ির বিজ্ঞাপন গুলো নিয়ে বেশ হাসাহাসি করতাম। কেমন যেন বাংলা সিনেমা স্টাইলের এই বিজ্ঞাপন গুলো পরিবার এর সাথে দেখা যেত না। বড় হয়ে বুঝতে পারলাম যারা ওই বিজ্ঞাপনগুলো বানাতেন তারা অসম্ভব মেধাবী এবং অনেকটা ফিলিপ কটলার ধাঁচের লোক ছিলেন। কারণ শাড়ির টার্গেট মার্কেট ঠিক যা পছন্দ করতো উনারা ঠিক তাই বিজ্ঞাপনে দেখাতেন। সুতরাং আমার ওই বিজ্ঞাপন পছন্দ না হবারই কথা। কারণ আমি শাড়ির পোটেনশিয়াল টার্গেট মার্কেট না।

আমাদের বাংলা সিনেমার অবস্থা অনেকটা শাড়ির বিজ্ঞাপনের মতো। যদিও আমি শাড়ি পড়ি না তাও আমি চাই শাড়ির বিজ্ঞাপনটা  টেলিকমের বিজ্ঞাপনের মতো হোক। আমাদের সবার বুঝতে হবে। আমরা সবাই শাড়ি নাও পরতে পারি, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সবার সমান অধিকার আছে বিজ্ঞাপন দেবার। আমাদের উচিত তথাকথিত বাংলা ছবিগুলো বানানো বন্ধ না করে নিজেদের জন্য বানানো তথাকথিত ভালো বাংলা ছবিগুলোর জন্য ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল তৈরি করা। কারণ শাড়ির আউটলেট আর টেলিকমের আউটলেট কিন্তু এক রকম হয় না। অথবা শাড়ির দোকানে মোবাইলের সিমও বিক্রি হয় না।

চলচ্চিত্র শিল্পের শুধু আমাদের দেশে নয় প্রায় সবখানেই বেশ কাহিল অবস্থা। হলিউড বা বলিউড অথবা ঢালিউড প্রায় সবখানেই এই শিল্পের বেহাল দশা। কোনো ভাবেই যেন দর্শকদের আর হলে টানা যাচ্ছে না। হলিউডের ছবিগুলো ক্ষতি পোষাতে নানা ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। থ্রি ডি বা আই ম্যাক্স নানান সব চেষ্টা। আসলে ডিজিটাল যুগের সাথে এই সিনেমা শিল্প খুব একটা পাল্লা দিয়ে নিজেদের হলগুলোকে আর ধরে রাখতে পারছে না। আসুন জানি কেন এই অবস্থা আর কিভাবে সম্ভব আবার "আবার তোরা মানুষ হ" এর মতো ছবি দিয়ে দর্শক মাতিয়া রাখা।

ছবি বানানো শুধু কোনো শখের বিষয় নয় । এটা অসম্ভব ব্যায়বহুল এক বাণিজ্যিক জগৎ। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে একজন প্রযোজক একটা ছবি তৈরী করেন। এরপর অন্যসব পণ্যের মতো এই ছবিটিকে আউটলেট বা হলে বিক্রি করেন। আর ক্রেতা বা দর্শকদের টিকিটের টাকা একসাথে মিলে হয় প্রযোজকের ছবিটি বানানোর সফল বা বিফল ইনভেস্টমেন্ট রিটার্ন। এটাই বাস্তব চলচিত্র শিল্পের ক্রেতা বিক্রেতার গল্প। আমরা সাধারণ দর্শকরা শুধু ছবিটাই দেখি। কিন্তু এর পেছনে যে বিশাল বাণিজ্যিক স্বার্থ আর একটা বিশাল ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক কাজ করে তা জানলেও এতো সহজে মানে চাই না। আমরা চাই ভালো ছবি। ভালো সিনেমা হল, ভালো পরিবেশ। কিন্তু একবার ভাবুন, প্রযোজকের লগ্নির টাকা না তুলতে পারলে কে এই বাণিজ্যিক ছবিগুলো বানাতে আগ্রহী হবে? আমি অন্তত না। আর আমার আপনাকে ভালো ছবি উপহার দেবার জন্য কোটি টাকা খরচ করে কেইবা নিজের লোকসান এর ঘানি টানবে? সুতরাং চলচ্চিত্রের প্রচণ্ড ব্যবসায়িক চ্যানেল গুলো সম্পর্কে যদি আমরা না জানি তাহলে এই ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কথা বলার মানে নেই।

যে ছবিগুলো আমরা হলে গিয়ে দেখি ওই হলের মালিক কিন্তু ছবিটা তৈরী করেন না। উনি একজন ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ করেন। উনি উনার সিনেমা হলে ছবিটা চালান আর টিকেটের লাভের টাকার একটা কমিশন উনি কেটে রাখেন। আপাত দৃষ্টিতে এটাই আমাদের দেশে এই জগতের ডিস্ট্রিবিউটরদের সংজ্ঞা।

এখন আমি যদি হলের মালিক হই তবে আমি আমার হলে কোন ছবি চালাবো তা অবশ্যই আমি নির্ধারণ করবো। দেশে এমন কোনো আইন নেই যেখানে বলা আছে একটা ছবি রিলিজ হলে সব সিনেমা হলেই চালাতে হবে। সুতরাং আমার যদি মনে হয় ছবি চলবে না তাহলে আমি আমার হলে ছবিটা চালাবো না। অথবা আমি আমার হল ভেঙ্গে সুপার মার্কেট করে ফেলবো। এতে আশা করি কারো কোনো সমস্যা হবার কথা না। আপাতত আমাদের দেশের চলচ্চিত্র শিল্প এই হল মালিক বা ডিস্ট্রিবিউটরদের সমস্যা নিয়ে বেশ কাহিল। কারণ একের পর এক হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যে কটা আছে সেগুলোর অবস্থা খুবই শোচনীয়।

এখন নিশ্চয়ই কিছুটা বুঝতে পাড়ার কথা কেন আমাদের চলচ্চিত্রের এই দুরবস্থা? কারণ আমি আপনি যে ছবি দেখতে চাই তা দেখাবে এমন হল নেই দেশে। আর যে সিনেমা হল গুলো আছে তাতে যে শ্রেণীর দর্শকরা যায় প্রযোজক পরিচালকরা তাদের রুচি অনুযায়ী ছবি বানান। এই ব্যবসাটা কিন্তু উনারা বেশ ভালোই বুঝেন। এখন আমি আপনি বলেই খালাস। কারণ স্বভাবগত ভাবে শুধু চলচ্চিত্র শিল্পের সবাইকে দোষ দেয়া ঠিক না। সবাই সবার লগ্নি করা টাকা লাভের আশায় লগ্নি করেন। আমি হলেও তাই করতাম।

এবার আসি সরকারের ভূমিকা নিয়ে। পৃথিবীর কোন দেশের সরকারই বাণিজ্যিক ছবির জন্য এতটা উঠে পরে লাগে না যতটা আমরা চাই বা আমাদের সরকার করছে। সরকার অন্য সব শিল্পের মতো চলচ্চিত্রের মান নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সেন্সর বোর্ড দিয়ে। কিন্তু সরকার নিজের টাকায় ছবি বানাবেন এটা আশা করাটা বেশ অমূলক। সম্প্রতি দেশের চালের সংকটের সময় যদি সরকার নিজে চাষ শুরু করে দিতো তবে কেমন লাগতো ব্যাপারটা? আসলে সরকার আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পকে যতটা করছে হলিউডেও এতটা করে না। যে কোনো পণ্যের মতো ছবি বা চলচ্চিত্র যারা বানান তাদের নিজেদের ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল বা আউটলেট নিজেদেরই তৈরী করে নিতে হবে। আমরা আশা করতে পারি না সরকার প্রতিটা শহরে স্কুল-কলেজ এর মতো করে সিনেমা হল বানিয়ে দিবে। আর আশা করাও উচিত না। কারণ এটা মৌলিক চাহিদার অংশ না।

তাহলে আস্তে আস্তে সব সিনেমা হল কি একসময় বন্ধ হয়ে যাবে? প্রযোজকরা আর ছবি বানাবেন না? হতে পারে। হলেও খুব একটা অবাক হবার মতো কিছু থাকবে না।

বলিউডের সিনেমার কথা সবার মনে থাকার কথা। একসময় জিতেন্দ্র শ্রীদেবীর নাচের দৃশ্য যদি এখনকার দর্শকদের দেখানো হয় তবে নির্ঘাত ভিমরি খাবে। কিন্তু ওই সময় ওই জুটি ছিল ব্যবসা সফল। এর কারণ ওই সময়কার বলিউডের টার্গেট মার্কেট ছিল ওই রকম। শুধু তাই নয় ছবির নায়ক নায়িকাদের স্থূল দেহ তত্ত্বও বেশ জটিল ছিল। এর কারণ বলিউডের ওই সময়কার লগ্নিকারীদের বেশিরভাগ আরব দেশের অথবা স্থূল দেহের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। সুতরাং প্রযোজক থেকে শুরু করে কলা কৌসুলি প্রায় সবাই ছবির লগ্নি করা অর্থ মোহে থাকতো।

আর এখনকার বলিউড জিরো ফিগার এর বলিউড। এটা সম্ভব হয়েছে শুধু নিজের দেশের দর্শকদের যখন টার্গেট মার্কেট ভাবতে শুরু করেছে তখন থেকে। এরমানে এখনকার বলিউড যে ছবিটা বানায় তার লাভের পুরোটাই নিজেদের দর্শকদের পকেট থেকে আসে। এই ট্রান্সফরমেশন টা কিন্তু এক দিনে হয়নি। অন্য সব বাজার বা মার্কেটের মতো আপনা আপনিই প্রযোজকরা বুঝতে পারলো তাদের দর্শক কি চায়। এরপর যোগ বিয়োগ করে দেখলো এখন আর আরব টাকার দরকার নেই। নিজেদের ছবি নিজেদের মার্কেট বা বাজারে ছাড়লেই টাকা উঠে আসবে লাভ সহ। অতপর আজকের বলিউড। বাহুবলীর মতো ছবি মুহূর্তেই হাজার কোটি টাকা আয় করে। ভালো ছবির যদি টার্গেট মার্কেট থাকে তবে ভালো ছবি এমনিতেই হবে। এর জন্য আন্দোলনের প্রয়োজন নেই। আমি আপনি টাকা না দিলেও ব্যাংক টাকা লগ্নি করবে আমাদের প্রযোজকদের পেছনে।

অনেকটা ডিম আগে না মুরগি আগে ধরনের সমস্যা। মানে আগে কি হল মালিকরা বা ডিস্ট্রিবিউটররা আমাদের রুচিশীল সমাজ বা পরিবার সহ দেখার মতো পরিবেশের আয়োজন করবে, নাকি প্রযোজক পরিচালকরা নিজেদের টাকা খরচ করে আগে ভালো ছবি বানিয়ে টার্গেট মার্কেট পরীক্ষা করে দেখবে? টার্গেট মার্কেট বা আমাদের সর্বোচ্চ জনপ্রতি হয়তো একটা সিনেমা দেখার পেছনে টিকেট বাবদ শো খানেক টাকা গচ্চা যেতে পারে। কিন্তু একজন প্রযোজক বা হল মালিকের জন্য এই ধরনের ট্রান্সফরমেশন প্রায় কোটি টাকার উপর। সুতরাং আবার বোঝার ব্যাপার। কিভাবে ভালো ছবি পর্দায় আনা যায়?

যেহেতু আগেই বলেছি একজন প্রযোজক বা পরিচালক ফিলিপ কোটলারের চেয়েও ভালো ব্যবসা বুঝেন। কারণ উনাদের কোটি টাকার পণ্য এটি। তাহলে মেনেই নিতে হবে উনারা এখনো আমাদের রুচিশীল দর্শকদের উপর খুব একটা আস্থা করতে পারছেন না। তা নাহলে কাউকে বলতে হতো না। একটার পর একটা ভালো ছবি এমনিতেই বের হতো। আর ডিস্ট্রিবিউটর বা হল মালিকরাও লাভের আশায় হলের পরিবেশ ঠিক করে ফেলতো। প্রচন্ড কাপিটালিস্টিক সমাজে লাভের অংক কাউকে শিখিয়ে দিতে হয় না। সবাই নিজের লাভ বুঝে।

ভারতে কিছু তরুণ পরিচালক একটা নতুন ধরনের সিনেমা বা চলচ্চিত্র ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল বের করেছে। এর নাম ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল। মানে কোনো ভালো গল্পের ছবি যদি প্রযোজক না পায় তাহলে এরা নিজেদের ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে দর্শকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ছবিটা বানাবে। আর নিজেদের ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেলেই তা প্রচার করব। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমি বা আপনি কেন যে ছবি দেখেই নি তার জন্য নিজেদের টাকা লগ্নি করবো? এই ক্রাউড সার্চিং ব্যাপারটা খুব একটা জমলো না ভারতে। স্বাভাবিক ভাবেই যদি কোনো টুথপেস্ট কোম্পানি আপনাকে বলে এখন কিছু টাকা ওদের দিন কিছুদিন পর আপনার পছন্দ মতো একটা টুথপেস্ট ওরা বাজারে ছাড়বে। আপনি কি রাজি হবেন?

তবে এতো কথার মানে এই না যে দর্শকদের রুচি বদলাচ্ছে না। হয়তো সময় নিচ্ছে। কিন্তু ঠিকই একদিন বদলে যাবে আমাদের বেশির ভাগ দর্শকদের রুচি। চলচিত্রের ক্ষতি যে শুধু টার্গেট মার্কেট বা আমরা করছি তা কিন্তু না। আধুনিক ডিজিটাল যুগে বায়োস্কোপ এর মতো ওয়েব বেসড প্লাটফর্মে যদি সবাই ঘরে বসে নিজের ইচ্ছে মতো ছবিটা দেখতে পারে তাহলে হলে গিয়ে কেন দেখবে?

নেটফ্লিক্স বা ইউ টিউবের যুগে হল ভিত্তিক ছবি ব্যবসা অনেক কঠিন একটা ব্যাপার। একসময় একটা ভালো ছবি হলে মাসের পর মাস চলতো। এখন একটা ছবি রিলিজ হবার পর প্রথম সপ্তাহে যা আয় করে এরপর তা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। অনেক ছবি প্রথম সপ্তাহের পরই হল থেকে ছিটকে পরে। দর্শকরা আগের মতো ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তার জ্যাম পেরিয়ে হলে বসে ছবি দেখতে মজা পায় না। এটা মানতেই হবে।

আগে একসময় সিনেমা হলে থাকতো ঘটঘূটে অন্ধকার। সবাই বসে বেশ ভালো ভাবেই ছবির মধ্যে ঢুকে যেতে পারতো। এখন হলে থাকে হাজারটা মোবাইল ফোনের আলো। সেলফি তোলার হিড়িক। লাইভ এর যুগে মন বসিয়ে একটা ভালো ছবি দেখার ধৈর্য এখন বেশীর ভাগ আমাদের নেই বললেই চলে। এই সমস্যাটা হলিউডের ছবিগুলো বেশ ভালো ভাবে টের পাচ্ছে। আমরা এতো পাইরেসি নিয়ে কথা বলছি। পারবেন একজন দর্শকের মোবাইল ফোন হলে ঢোকার আগে বন্ধ করে দিতে বা হলের ভেতর নেটওয়ার্ক জ্যাম করে দিতে? পারবেন না। সামান্য এইটুকু করতে পারলেও ছবিগুলো পাইরেসি থেকে বেঁচে যেত।

আরো ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে ভালো চলচিত্রের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যামেরা বা প্রোডাকশন স্টুডিও। খুব সাধারণ ভাবে বলতে গেলে সিনেমা হলে বেশির ভাগ ছবি বানানো হয় ৩৫ এম এম রীলে। যা অনেক ব্যয় বহুল। এই ধরনের একটা রিলের প্রিন্ট ব্যবস্থা আমাদের দেশে প্রায় হাতেগোনা। ব্যবসায়িক বিজ্ঞাপন গুলো সাধারণত ভারত বা থাইল্যান্ড থেকে প্রিন্ট করে আনে এই রীলগুলো। তাহলেই বুঝুন! কতটা অমূলক আমাদের ইচ্ছেগুলো। যেখানে বেশিরভাগ পরিচালক জানেনই না উনারা শেষমেশ কি প্রিন্ট পাবেন রীলের সেখানে একটা উঁচু মানের চলচ্চিত্র কতটা কঠিন আমাদের দেশে। আজকাল আবার যৌথ প্রযোজনায় ছবি হচ্ছে। মানে টেকনিকাল সাপোর্টটা আমরা বাইরে থেকে নিচ্ছি। এ নিয়েও বিপত্তি। যৌথ প্রযোজনার ছবিগুলো রাজনীতির শিকার।

হ্যারি পটার বা জেমস বন্ডের মতো ছবি গুলোর গল্প বা স্বত্ব যুক্তরাজ্যের আর ছবির টেকনিকাল সাপোর্ট সহ প্রায় সব কিছু হয় হলিউড থেকে। এখন এই দুই দেশের দর্শকরা যদি স্বত্ব আর টেকনিক্যাল সাপোর্ট নিয়ে রাজনীতি শুরু করে তাহলে এই ছবিগুলো হল পর্যন্ত পৌঁছুতো না।এমনিতেই যুক্তরাজ্যের চলচিত্রের বাজার অতটা ভালো না। কারণ জনসংখ্যার দিক থেকে কম হওয়ায় জেমস বন্ডের মতো ছবিগুলোর প্রধান বাজার আমেরিকা বা বিশ্বের নানান দেশ। চলচ্চিত্রের জন্য আসলে স্বাভাবিক রাজনৈতিক ব্যাপার গুলো বাদ দেয়া যেতেই পারে। এক দেশের গল্প দিয়ে যদি অন্য দেশ ছবি বানায় এতে তো দোষের কিছু নেই। আমাদের দেশের টেকনিকাল সাপোর্ট হলিউড এর পর্যায়য়ে পৌঁছুতে অনেক দেরি। তাই বলে আমাদের দেশের কোনো পরিচালক বা প্রযোজক কি হলিউডে ছবি বানাতে পারবে না। চলচ্চিত্রের বিশ্বায়নকে রাজনীতির বাইরে রাখা প্রয়োজন। সৃজনশীলতা বা মননশীলতার কোনো সীমানা থাকতে নেই।

যেহেতু আমাদের ভাষা বাংলা আর আমাদের বাংলাতেই বেশির ভাগ চলচ্চিত্র বানাতে হবে। তাই আমরা হলিউডের কথা হয়তো না ভাবলেও চলে। দেশীয় চলচ্চিত্রের  রেভেনিউ বা বাজেট বাড়বে তখনই যখন আমরা নিজেরা নিজেদের ছবিগুলো হলে গিয়ে দেখবো। নিচের গ্রাফটা দেখলে স্পষ্ট দেখতে পাবেন চীন কিভাবে নিজেদের ছবির বাজার বাড়িয়েছে হলিউডের সাথে পাল্লা দিয়ে। এক্ষেত্রে চীন মোটেও ইংরেজিতে ছবি বানায়নি। যেটা হয়েছে তা হলে সময়ের সাথে চীনের দর্শকদের জিডিপি আয় বেড়েছে আর নিজেদের ভাষায় ছবিগুলো বেশি করে হলে গিয়ে দেখছে।

সময় পাল্টে দেয় সব কিছু। সময়ের সাথে আমাদের রুচি বদলায়। আয় বাড়ে। আর আমরা চলচ্চিত্রের মাঝে নিজেদের রুচি খুঁজি। এটাই স্বাভাবিক। আর এভাবেই এক সময় বদলে যায় সবকিছু। এমনি এমনি।

সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালি বানাতে প্রায় পাঁচ বছর লেগেছিলো। বিক্রি করতে হয়েছিল বৌয়ের গহনা। তৎকালীন সরকার একটা টাকাও দেয়নি এই অসম্ভব প্রতিভাবান পরিচালককে। যা কিছু টাকা উনি সরকার থেকে পেলেন তা ছবি রিলিজ হবার পর। রেল যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে। সরকার যখন দেখলো ছবিটা তখন বুঝতে পেরেছিলো কতটা ভালো হয়েছে ছবিটা। নিজেদের দেশের কৃতিত্ব দেখাতে সরকার তখন বিশেষ ভাবে ওই টাকা সত্যজিৎ রায়কে অনুদান দেন। মানেটা বেশ পরিষ্কার। যতক্ষণ আমরা ভালো ছবি উপহার দিয়ে দর্শকদের কাছে টানতে পারছি না ততক্ষণ হল মালিক বা প্রযোজক কেউই এগিয়ে আসবে না। শুধুমাত্র ভালো ছবি বানালেই তো হবে না। ছবিটা বাজারে চলবে কিনা তা-ও দেখার প্রয়োজন আছে।

আরেকটা মজার বিষয় হচ্ছে ভালো পরিচালক আর প্রযোজক এর মধ্যে সম্পর্ক। প্রযোজক হচ্ছেন উনি যিনি ছবি বানানোর টাকা লগ্নি করেন। এক্ষেত্রে পরিচালক যতই ক্রিয়াটিভ হোক না কেন প্রযোজক নিজের জোর খাটাবেনই ছবির বিক্রির জন্য। ঠিক এই কারণেই ভালো ছবিতেও একটা আইটেম সং থাকতেই হবে। দর্শকরা চায়। আমি-আপনি হয়তো না-ও চাইতে পারি। কিন্তু বেশির ভাগ দর্শকরা তো চায়। অস্বীকার করার মতো সাহস নেই। ভালো আর ক্রিয়েটিভ পরিচালককে ভালো ছবি বানাতে হলে নিজেকে প্রযোজক হতে হবে। আর এরপর যদি ছবি বানানোর টাকা উঠে না আসে নিজেকে ক্ষতির ভার বহন করতে হবে। এতো বড় ভার বহন এতোটা সহজ হয়তো না।

আবার তোরা মানুষ হ ধরনের চলচ্চিত্রের সময় নেটফ্লিক্স বা ইউটিউব ছিল না। নেটফ্লিক্স আর ইউটিউবের এই দিনে আবার তোরা মানুষ হ বলাটা বেশ বেমানান। কারণ এখনকার মানুষ এর সংজ্ঞাটা ঠিক আগের মতো নেই। এখনকার মানুষ গুলো বেশ আর্থিক ভাবনায় বিভোর। সঙ্গত কারণেই সৃজনশীল এই চলচিত্রের ব্যবসায়িক ভাবনার ধারণা সবার থাকা প্রয়োজন। এটি একটি পণ্য। আর পণ্য মানে এর মূল্য দিতে হবে। মানুষ হিসেবে আমরা যদি চলচ্চিত্রের মূল্য দিতে পারি তাহলেই কেবল চলচ্চিত্র আমাদের মতো হতে বাধ্য। আপাতত না হয় আমরাই চলচ্চিত্রের মতো হলাম। ভবিষ্যতের জন্য হলেও। সুতরাং আমরা যারা ঠিক আগের মতো মানুষের গল্প করি চলচ্চিত্র নিয়ে তাদের নিজেদের বদলে যেতে হবে। তাহলেই শুধু সম্ভব এই শিল্পকে নতুন ভাবে মানুষ করা।