আর কয়েকদিন পরেই একুশের মাস। সবাই বাংলা চর্চা করবে। মেলায় যাবে একটা দুইটা বাংলা বই কিনবে। সাজিয়ে রাখবে বাসার কোণে। আমারও একটা বই বের হচ্ছে, তবে বেশ ভয়ে আছি। ভাবছি, বইয়ের সাথে একটা ছোট অক্সফোর্ড ডিকশনারি ফ্রি দিবো। ২০০ টাকা দিয়ে কেউ আমার বই কিনে পড়বে এটা আমারই বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। প্রকাশকের সাথে কথা বলে দেখবো। যদি বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি এর মতো অক্সফোর্ড ডিকশেনারিটা দেয়া যায় তবে খুব একটা খারাপ হবে না। যাই হোক, বইটার প্রুফ রিডিং এর কাজ ছিল আমার স্ত্রী আর ভাতিজির।
ভাতিজিকে জিজ্ঞেস করলাম মাইকেল মধুসূদনকে চিনে কিনা? ও বললো, নাহ। পরে আমার স্ত্রী বললো বাসার ছেলে-পেলেরা নাকি বাংলায় খুব একটা স্বাচ্ছন্দ বোধ করে না। মানে কি? স্বাচ্ছন্দ শব্দের মানে কি? আমি বেশি তর্কে গেলাম না। কারণ আদতেই বাংলা নিচু মানুষের ভাষায় পরিণত। ফেসবুকে বাংলায় পোস্ট দিলে হয় আপনি ইন্টেলেক্চুয়াল অথবা ইংরেজি খুব একটা যায় না আপনার সাথে। বাসার ছেলে-পেলেদের কাছে নিজের ইজ্জত রক্ষার্থে ফেসবুকের প্রোফাইল চেঞ্জ করলাম। লন্ডন আমেরিকার একগাদা ডিগ্রী দিয়ে আপলোড করলাম প্রোফাইল। না জানি ছেলে-পেলেরা ভাবে চাচ্চু ইংরেজিতে কাঁচা বলে বাংলায় লিখে। যাক এই প্রোফাইল চেঞ্জটা আরো আগে করলে ভালো হতো।
কিন্তু সমস্যা রয়ে গেলো মাইকেল সাহেবকে নিয়ে। উনার আসল কাহিনীটাই কেউ জানে না। আসলে একালের সন্তানদের মতো করে কেউ কখনই মাইকেল সাহেবকে নিয়ে কিছু লিখেননি। উনার ইংরেজি প্রীতি আর সর্বশেষে উনার বাংলার প্রতি মোহ এইসব এক কথায় প্রোফাইল চেঞ্জ এর মতো করে কেউ উপস্থাপন করেনি। কারণ ছেলেপেলেদের কাছে ভেনগগ এর পেইন্টিং এর কোনও আগ্রহ না থাকলেও ওই পেইন্টিং এর দাম মিলিয়ন ডলার শুনলে একটু হলেও ভ্রূ কুঁচকে উঠবে। পুরো ব্যাপারটাই উপস্থাপনের। সহজে কেউ রবীন্দ্রনাথ হাতে নিবে না আমি জানি। তবে যদি বলা হয় ঠাকুর সাহেব ব্রিটিশ নাইট উপাধির তোয়াক্কা করেননি বা আয়ারল্যান্ডে এখনো ঠাকুর বাড়ি আছে! হয়তো কিছুটা আগ্রহ আসতে পারে অনেকের। আপনি হয়তো বলতে পারেন রবীন্দ্রনাথ কেন হাতে নিতে হবে? কিন্তু ওদের হাতে তো শেক্সপিয়ারও নেই। তাহলে ওরা কি নিয়ে বড় হচ্ছে? অবশ্যই ফিলিপ কটলার নিয়ে।
দেশের প্রথম সারির একটা টেলিকমে কাজ করতাম একসময়। সেই রকম মাল্টিন্যাশনাল পরিবেশ। কথার চেয়ে মেইল চালাচালি হতো বেশি। আর বেশির ভাগ মেইলের অর্থ বুঝতে মোটামুটি অক্সফোর্ড ডিকশেনারি নিয়ে বসতে হতো। কারণ দেশি বসরা মেইল লেখার সময় একটা শব্দ টাইপ করে তার উপর মাউস বসিয়ে রাইট বাটন ক্লিক করে সবচেয়ে কঠিন সিনোনিমসটা ব্যবহার করতো। নরওয়ে থেকে আশা আসল বসরাও ইংরেজিতে কাঁচা। সুতরাং দেশি বসরা তো পারলে অক্সফোর্ড ডিকশনারি গিলে খায়। নিজের পারফরমেন্স দেখাতে রাইট বাটন আর অক্সফোর্ড ডিকশেনারির তুলনা নেই। এখনো হয়তো এই রকমই চলে। কর্পোরেট হাউসগুলোর ডেস্কে একটা করে অক্সফোর্ড ডিকশনারি সাজিয়ে রাখাটা বেশ মানানসই।
দেশের ইংরেজি মিডিয়ামের রত্নরা বেশ ঝামেলায় পরে যখন লন্ডন বা আমেরিকায় পড়তে আসে। তাদের জানা তাবদ ইংরেজি জ্ঞান এয়ারপোর্টে বিসর্জন দিয়ে এসে আবার নতুন করে ইংরেজি শিখতে হয়। কারণ দেশে যে ইংরেজি চলে তা লন্ডন বা আমেরিকাতে চলে না। তাহলে কি শিখছে ছেলেপেলেরা? নাহ শেক্সপিয়ার নাহ রবীন্দ্রনাথ? যাই হোক, দেশ উদ্ধার করার মহান দায়িত্ব আমার না। এর জন্য লোকবল আছে। নিজের বাসার ছেলেপেলেকেই মধুসূদন চিনাতে পারলাম না। আমার স্ত্রী সতর্ক করে দিলো যেন এই নিয়ে বেশি কথা না বলি। কারণ এরপর ছেলেপেলেরা আর ফোনও ধরবে না আমার। যুৎসই। ইন্টেলেক্চুয়াল বা ইংরেজি না জানা পাপা বা চাচ্চুর যে কত জ্বালা তা দেশের বাসায় বাসায় উপলব্ধি হচ্ছে এখন।
একবার ভাবলাম ইংরেজিতে কিছু লিখি। প্রাক্তন বসদের মতো রাইট বাটন ক্লিক করে বেশ কঠিন কঠিন শব্দ দিয়ে কিছু একটা লিখি। কিন্তু মাইকেল সাহেবের কথা মনে পড়ায় সরে আসলাম ওই পথ থেকে। ইংরেজি আমার দ্বারা হবে না। যে ইংরেজি আমি জানি তার মান এতটাই খারাপ যে লেখা যায়না। আর যে ইংরেজি লেখা যায় তা আমি হাজার চেষ্টা করলেও পারবো না। অজ্ঞতা প্রোফাইল এডিট করাটাই যথার্থ।