লেখক বনাম প্রকাশক

আশরাফুল আলম
Published : 20 Feb 2018, 04:19 AM
Updated : 20 Feb 2018, 04:19 AM

প্রকাশক লেখকদের দ্বন্দ্ব তুমুল পর্যায়ে। লেখালেখির এই জগতে না ঢুকলে বুঝতে পারতাম না এটাও অন্য সব জগতের মতোই। কোন প্রকাশক লেখকের লগ্নির টাকায় বই ছাপেন, কেউবা ফেসবুক ফলোয়ার এর সংখ্যার উপর টাকা লগ্নি করেন। এক্ষেত্রে শেষমেষ মাশুল গুনতে হয় লেখকদের। নিজের লগ্নি করা টাকা আর সম্মান বাঁচানোর জন্য লেখকদের একটু করে হলেও 'কটলার জ্ঞান' প্রয়োজন এই যুগে।

যারা নতুন বই বের করবেন বা যাদের ফেসবুক ফলোয়ার বেশ তলানিতে তাদের বেশ সতর্কভাবে এগুনো প্রয়োজন। ১৬ পাতার ১ ফর্মার জ্ঞান না থাকলে ঝামেলায় পড়বেন। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই হোমওয়ার্ক করে ফেলা যায়। এরপর প্রচ্ছদ আর ছাপা খানার ঠিকানা জোগাড়। দেশের অনেক প্রচ্ছদ শিল্পী আছেন যাদের ঠিকানা অনলাইনে পাওয়া যায়। আর প্রিন্টিং প্রেস তো খুঁজলেই অহরহ। বই ছাপার পুরো বিষয়টা যদি লেখক নিজে দেখেন তাতে দোষের কিছু না। এটা হতেই পারে। প্রকাশকদের প্রধান কাজ ছাপানো বইয়ের ডিস্ট্রিবিউশন বা মার্কেটিং করা। বই বিক্রির মতো কঠিন বিষয়টা তাদের হাতেই। সেটাই যদি না হয় তবে লেখকের প্রকাশক হতে দোষ কি?

নিজের বই এর বিক্রির জন্য আমিও বেশ মরিয়া। বইয়ের সাথে টি-শার্ট ফ্রি বা এই রকম নানা ধরনের কটলারীও মার্কেটিং কপচালাম। কিন্তু যে বই প্রকাশকের হাতে তা আমি হাজার চাইলেও বিক্রি-বাট্টায় যাবে না। এক্ষেত্রে লেখকরা নিজে থেকে নিজের বইয়ের মার্কেটিং করতেই পারেন। তবে তা যদি হয় নিজের পরিবার-পরিজনের কাছে তবে সে বই প্রকাশ না করাই ভালো।

আমাদের দেশে বই এর বাজার বেশ সীমিত। বছরে একবার একুশে বই মেলায় আর কিইবা বই বিক্রি হবে? সুতরাং লেখকদের আরো বেশি বইয়ের ডিস্ট্রিবিউশন পয়েন্ট এর দিকে নজর দেয়া উচিত। রকমারি ডটকম বা এই জাতীয় অনলাইনে বই বিক্রির সাইটগুলোতে লেখক চাইলে নিজেই নিজের বই আপলোড দিতে পারেন। এক্ষেত্রে সাইটে  গিয়ে এদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করলে এরাই আপনাকে পুরো প্রক্রিয়া বলে দেবে। আর বেশিরভাগ বই এর স্বত্ব যেহেতু লেখকের, লেখক এটি চাইলেই করতে পারেন।

যাদের সামর্থ আছে তারা ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রচার করতে পারেন। এক্ষেত্রে লেখককে নিজে বই এর কেনা-বেচার দায়িত্বটুকু নিতে হবে। দেশে অনেক ই-কুরিয়ার সার্ভিস আছে যাদের সাথে কথা বলে নিলে ওরাই আপনার হয়ে পাঠকের কাছে বইগুলো পৌঁছে দিবেন।

অনেক লেখক নিজের বই কলকাতা থেকে প্রকাশ করার ইচ্ছে পোষণ করতেই পারেন। এক্ষেত্রে কলকাতার অনলাইনে অনেক বুক পাবলিশার্স কোম্পানি আছে যারা ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকায় ৩০০ কপি বই ছাপিয়ে থাকে। আর প্রচলিত সকল আইন আর নিয়মের মধ্যে থেকেই আপনার বইয়ের অনলাইন মার্কেটিং ওরা করে দিবে। আমাজন থেকে শুরু করে ওপার বাংলার বেশ কয়েকটি অনলাইন সাইটে আপনার প্রকাশিত বইয়ের বিপণনও ওরা করে দিবে।

যেসব লেখকরা এখনো ভাবছেন শুধু ভালো লিখলেই লেখক হওয়া যায়, তাদের জন্য হতাশা বেশ কঠিন আকার ধারণ করে। কারণ বই প্রকাশের পর শুধু প্রকাশকের কাছে ধর্ণা দিলেই এখন আর খুব ভালো লেখক হওয়া যায় না। এর জন্য প্রয়োজন বইয়ের ডিস্ট্রিবিউশন প্ল্যান। খুব ভালো ডিস্ট্রিবিউশন প্ল্যান না থাকেল যেকোন লেখন অতি অল্পতেই খসে পড়তে পারে।

আমার ক্ষেত্রে আমি এই মুহূর্তে নিজের বইয়ের জন্য একটা কন্টিনজেন্সি প্ল্যান করে রেখেছি। কারণ আমার ধারণা, মেলা শেষে আমার
প্রকাশক প্রায় সবগুলো বই আমাকে ফেরত দিবেন। এটা একজন লেখকের জন্য বেশ বাজে রকমের অবস্থা। তাই আমি নিজে উবার আর পাঠাও এর মতো রাইড শেয়ার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ফোন দিয়ে ওদের প্রতিটা গাড়িতে আমার বইটা নিশ্চিত করতে বললাম। ছোটখাটো একটা অ্যাপস এর ধারণা দিলাম। রিড অন রাইড– মানে যাত্রীরা যখন গাড়িতে থাকবেন ওই সময়টা আমার বইয়ের কিছু পাতা উল্টে দেখবেন। আর বইটা থাকবে গাড়ির সামনের সিটের পেছনের কভারে। এক্ষেত্রে যাত্রী চাইলে পড়তেও পারে আবার নাও পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে অন্তত আমার বইয়ের অবিক্রিত অংশটুকুন চলে যাবে ঢাকা শহরের গাড়িতে গাড়িতে। এটাকে বলা যায় বাল্ক সেল

জানি না কতটুকুন শুদ্ধ এই রিড অন রাইড ধারণা। তবে এই মুহূর্তে এতোগুলো বই যদি বাসায় ফিরে আসে তবে আমি নিশ্চিত পরের বইটা লেখার সাহস পাবো না।

লেখকদের নিজের লেখা নিয়ে মার্কেটিং চিন্তা দোষের কিছু না। যদিও এটা প্রকাশকের দায়িত্ব। তবে সব কিছু প্রকাশকের উপর ছেড়ে দিলে লেখকের লেখক সত্তার কি মূল্যায়ন? আমাদের সবার উচিত বই বের করার আগে নিজেদের বই এর মার্কেটিং প্ল্যান, ডিস্ট্রিবিউশন প্ল্যান আর প্রকাশকদের সাথে চুক্তি নিয়ে কথা বলা। দিন শেষে পাঠক একজন ক্রেতা আর আমরা লেখক এক্ষেত্রে বিক্রেতা।