স্বপ্নের পদ্মা সেতু ইস্যুটি জাতীয়ভাবে দেখা উচিত

(আসাদ জামান)
Published : 27 August 2012, 07:09 PM
Updated : 27 August 2012, 07:09 PM

আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে বড় অর্জন হওয়ার কথা ছিল পদ্মা সেতু। এই সেতু নিয়ে আওয়ামী লীগ অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছে। নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে এই সেতুকে সামনে এনেছিল তারা। কিন্তু একজন মাত্র লোককে বাঁচাতে গিয়ে পুরো একটি সরকার ধরা পড়ে গেল হাতেনাতে। এখন শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থায় পড়ে গেছে তারা। নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণের এবং সরকারের সব অর্জন ধূলায় মিশে যাবার অবস্থা। পদ্মা সেতু নিয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চল যে স্বপ্ন দেখেছিল তা মিথ্যা হতে বসেছে।

অনেকে মনে করেন পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাথে আসল বিবাদ শুরু হয়েছে ড. ইউনুসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বের করে দেবার পর। যারা এই বিশ্বাসে অটল তাদের যুক্তিকে হয়ত উড়িয়ে দেয়া যাবেনা। কারণ ড. ইউনূস গ্রামীন ব্যাংক থেকে বিতাড়িত হবার পর দেশে-বিদেশে এই সরকারের বিরুদ্ধে প্রপাগাণ্ডায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। ইউনুসের বন্ধু বলে খ্যাত আমেরিকা যাদের কোন বিনিয়োগ নাই গ্রামীণ ব্যাংকে তারা সবচাইতে বেশি উদ্বিগ্ন ইউনুসকে সরিয়ে দেবার কারনে। খোদ হিলারি ক্লিনটন ঢাকা সফরের সময় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে যে কথা বলেছিলেন তা হল ইউনুসকে গ্রামীন ব্যাংকে ফিরিয়ে দেয়া। কিন্তু সরকার মোটেও গুরুত্ব দেয়নি তার উপদেশ। উল্টো হিলারিকে শুনতে হয়েছিল বিভিন্ন কথা। হিলারির সফরের কয়েকদিনের মধ্যেই বিশ্বব্যাংক জানিয়ে দেয় তারা বিনিয়োগ করবে না পদ্মা সেতুতে। অভিযোগ করে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে দুর্নীতি হয়েছে এই সেতু বিষয়ে।

বিশ্বব্যাংকের এই দুর্নীতির অভিযোগ প্রথম দিকে সরকার কোন গুরুত্ব না দিলেও পরবর্তীতে অভিযুক্ত মন্ত্রী আবুল হোসেনকে সরিয়ে নেয়। এর ফলে বিশ্বব্যাংকের একটি শর্ত পালন হলেও সরকার নৈতিকভাবে যে দুর্নীতিকে স্বীকার করে তা বলাই বাহুল্য। সরকারের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত একজন দুর্নীতির অভিযোগ অভিযুক্তকে আঁকড়ে ধরা উচিত হয়নি। এটা বর্তমান সরকারের শাসনামলের একটা কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে পরিগণিত হবে। যতই অস্বীকার করা হোক অথবা ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলা হোক না কেন এই সরকার নিজেরাই যে দুর্নীতিকে স্বীকার করেছে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বাঁচাতে চেয়েছে তা বলা যায়। এই সব পরস্পরবিরোধী পদক্ষেপ যে কোন স্বাধীন সরকার ব্যবস্থার সহায়ক হতে পারেনা।

আবুল হোসেন ছিলেন মুল অভিযুক্ত ব্যক্তি। এই লোকটির অতীত ইতিহাস সবচেয়ে নোংরা। টিসিবিতে থাকাকালীন সময়ে তাদের মত কয়েকজন লোকের কারণে যুদ্ধ পরবর্তী বিধ্বস্ত বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের চরম দশা পরিলক্ষিত হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আগের শাসনামলে একই সাথে দুইটি পাসপোর্ট থাকার কারণে মন্ত্রিত্ব হারাতে হয়েছিল। এবারের শাসনামলে শুধুমাত্র তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের কারণে পদ্মা সেতুর মত একটি বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের অনিশ্চয়তার মাঝে পড়ে গেছে বাংলাদেশ। যদিও এর সাথে ড. ইউনূসের কিছুটা সংযোগ থাকতে পারে। কারণ ইউনূস সাহেব তার মুরুব্বী আমেরিকাকে দিয়ে বিভিন্নভাবে দেশে-বিদেশে প্রমাণ করতে চান বাংলাদেশে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ নেই।

বিশ্বব্যাংক আমেরিকার হাতের পুতুল বলে মনে হয়। দেশে দেশে আমেরিকার স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা বিশ্বব্যাংককে ব্যবহার করে আসছে অনেক দিন ধরে। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো উপায়ান্তর না পেয়ে বিশ্বব্যাংকের দিকে ঝুকে থেকে। আমেরিকাও এই সুযোগে অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের কায়েমি স্বার্থ হাসিল করে নেয়। ইউনুসের সাথে আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বন্দ্ব ও পদ্মা সেতুর মত বৃহৎ একটি নির্বাচনী অঙ্গীকার এই দুইটিকে ভালই কাজে লাগিয়েছে আমেরিকা। ওয়ান ইলেভেনের কিংস পার্টির ব্যর্থ নায়ক ইউনূসের ক্ষমতা গ্রহণের লোভ ও সরকারের অঙ্গীকার এই দুইটির মাঝে ঢুকে পড়েছিল আমেরিকার স্বার্থ ও নসিহত। সরকার ইউনুস সম্পর্কে আমেরিকার নসিহতকে গুরুত্ব না দিলে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে সরকারকে। ফলে যেখানে আমেরিকার স্বার্থ ও নসিহত বিঘ্নিত হচ্ছে সেখানে কেন বিনিয়োগ করে আওয়ামী লীগ সরকারকে সাহায্য করবে আমেরিকার স্বার্থরক্ষাকারী বিশ্বব্যাংক। সেই সাথে তাদের হাতের কাছে পেয়ে গেছে একজন দুর্নীতির সাথে জড়িত আবুল হোসেনকে। বলির পাঠা বানানো হল দেশের একটি বৃহৎ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে এবং সরকারকে। সরকার প্রথম দিকে এই বিষয়টি বুঝতে না পারলেও অথবা গুরুত্ব না দিয়ে যে ভুল করেছে তা প্রমাণিত। সরকার যদি কাউকে কিছু বুঝতে দেয়ার আগে আবুলকে সরিয়ে দিত তাহলে হয়ত ইউনুসের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও অভিলাষ পুরণ হত না।

উল্লেখ্য, ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ২৯০ কোটি ডলারের পদ্মাসেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছিল বিশ্বব্যাংক।
পদ্মাসেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের পাশাপাশি এডিবি ৬১ কোটি ডলার, জাইকা ৪০ কোটি ডলার এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ১৪ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার কথা ছিলো। আর বাকি অর্থের যোগান দেওয়ার কথা ছিলো সরকারের। পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগের জন্য বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে যেসব শর্ত দেয়া হয়েছিল তার সব মেনে নিয়েছে সরকার। কিন্তু তারপরেও সেখানে তারা বিনিয়োগ না করারই সম্ভাবনা নব্বই ভাগ। ইতিমধ্যে মালয়েশিয়া সরকার অর্থায়নের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে কিন্তু তাদের এই আগ্রহ বাস্তবে রূপ নেবে কিনা সন্দেহ।

এই পদ্মা সেতু স্বপ্ন ছিল দেশের মানুষের। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার তা পূরণে ব্যর্থ হতে চলেছে। এটা নিয়ে অনেক রাজনীতি চলছে দেশে। বিশ্বব্যাংকের এই ঋণচুক্তি বাতিলে সরকার বেকায়দায় পড়লেও খুশি হয়েছে বিরোধীদল, ড. ইউনুস ও ইউনূস পক্ষীয় কতিপয় লোক। দেশের বিপক্ষে এমন একটি সিদ্ধান্তের পর কতিপয় মানুষের এমন উল্লাস অনাকাঙ্ক্ষিত।

বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, মালয়েশিয়া অথবা অন্য যে কোন সংস্থা অথবা দেশি অর্থায়ন যেভাবেই এই পদ্মা সেতুর কাজ হোক অথবা নাই হোক দেশের সম্মান ও ভাবমুর্তি রক্ষায় আমাদের সবাইকে একই কাতারে দাঁড়িয়ে যাওয়া উচিত। পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন যেমন আওয়ামী লীগ সরকারের একক সাফল্য নয় ঠিক তেমনিভাবে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিল ইউনুস অথবা বিরোধীদলের কোন সাফল্য নয়। যেহেতু দেশ আমাদের সবার সেহেতু এই দেশের যে কোন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সাফল্যের ও ব্যর্থতার দায়ভার আমাদের সবার।