দেশকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবার অধিকার কারো নাই

(আসাদ জামান)
Published : 29 April 2012, 04:18 PM
Updated : 29 April 2012, 04:18 PM

ইলিয়াস আলীর জন্য সারা দেশবাসীকে জিম্মি করে রেখেছে আওয়ামী লীগ সরকার ও ১৮ দলীয় জোট। এক ইলিয়াস আলীর জন্য এই পর্যন্ত ৫ জন লোক প্রাণ হারিয়েছে। অনেক ভাংচুর হয়েছে, গাড়ি পুড়েছে অনেকগুলো। এই পর্যন্ত হরতাল হয়েছে গত সপ্তাহে একটানা তিনদিন এবং ২৯ ও ৩০ এপ্রিলসহ মোট পাঁচদিন। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আরো হরতাল বাকি আছে।

হরতাল বিরোধীদলের একটি কার্যকর অস্ত্র। কিন্তু এই হরতালের অত্যাধিক ব্যবহারের কারণে হরতালের কার্যকারিতা হারিয়ে যেতে বসেছে। বিশেষ করে বিএনপির হরতালে সরকার যেভাবে জোর করে হোক অথবা কৌশলে হোক রাস্তায় গাড়ি নামানোর ব্যবস্থা করেছে তাতে করে রাস্তায় প্রাইভেট গাড়ি ছাড়া বাকিসব যানবাহন পাওয়া যায়। ঢাকার বাইরে অবশ্য এই চিত্র অন্যরকমের। মানুষজন ভয় এবং আতংকে রাস্তায় বেরোয় না বলে হরতাল এমনিতেই পালন হয়ে যায়। দেশের প্রশাসনিক রাজধানী ঢাকা হওয়ার কারণে এই হরতাল যানবাহনের উপর খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করেনা। অফিস-আদালত খোলা থাকলেও মানুষজনের উপস্থিতি খুব একটা না থাকলেও লেনদেন যে হচ্ছে তা বলা যায়। ব্যাংক-বীমাসহ অন্যান্য অফিস খোলা থাকলেও মার্কেটের অবস্থা করুণ। মানুষজন নিজেদের সম্পত্তি বাঁচানোর তাগিদে ব্যক্তিগত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখছে। ফলে নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদির উপর প্রভাব পড়ছে, দাম বাড়ছে অন্যান্য স্বাভাবিক সময়ের চাইতে অনেক বেশি।

বিএনপির এই হরতালের আসল ইস্যু ইলিয়াস আলীকে উদ্ধার। তাদের দাবি সরকার নিজে ইলিয়াস আলীকে 'গুম' করেছে। সরকার অস্বীকার করে বলছে এর পেছনে বিএনপিই দায়ি থাকতে পারে। ফলে অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগের মধ্য দিয়ে দিন যাচ্ছে। ইলিয়াস আলী উদ্ধারের জন্য কোন অগ্রগতি হচ্ছেনা। র‍্যাব ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হবার পর পরই তাহমিনা রুশদীকে নিয়ে গাজীপুরে একটি অভিযানে গিয়েছিল। সেই অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল। মিডিয়ার এই খবর প্রকাশ হবার পর বিএনপি নেত্রী তাহমিনা রুশদীকে ডেকে পাঠান। দেখা হবার পরেই তাহমিনা র‍্যাবের সাথে সেই অভিযানে যাবার কথা অস্বীকার করেন। ইলিয়াসের বউয়ের এই মিথ্যাচার এবং বোল পালটানো রহস্যজনক।

ইলিয়াস আলী ছিলেন সিলেট বিএনপির সভাপতি। সিলেট বিভাগে তার একচ্ছত্র রাজত্ব সাইফুর রহমানের মৃত্যুর পর। বদমেজাজী এই নেতার কারণে সিলেটে কোন নেতৃত্ব গড়ে উঠছেনা বলে অভিযোগ রয়েছে। কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের নীতিনির্ধারক হবার পর তিন মাসের মাথায় সেই কমিটি ভেঙে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। ভেঙে দেয়া কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ইলিয়াস আলী এবং সভাপতি ছিলেন রুহুল কবির রিজভি। রুহুল কবির রিজভি বর্তমানে কেন্দ্রীয় বিএনপির প্রচার সম্পাদক। রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি খুব ঠান্ডা মাথার বলে অনেকেই মনে করেন। শুধুমাত্র ইলিয়াস আলীর মত সাধারণ সম্পাদক পাবার কারণে তার সেই কমিটি টিকেনি। এ থেকে প্রমাণ হয় কতটা দুর্ধর্ষ ছিলেন এই ইলিয়াস আলী। ইলিয়াস আলীকে অনেকেই এরশাদবিরোধী আন্দোলনের একজন ছাত্রনেতা হিসাবে মনে করলেও শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে তাকে ঢাকা বিস্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এম ইলিয়াস আলী তার রাজনৈতিক অবস্থান একদিনে তৈরি করেননি। ছাত্রজীবন থেকে তিনি বিভিন্নভাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। সিলেটের এমসি কলেজে এইচএসসি অধ্যয়নকালে ছাত্ররাজনীতির সাথে যুক্ত হন ইলিয়াস আলী। সে সময় তিনি ছিলেন ছাত্রলীগের একজন কর্মী। ১৯৮১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর তিনি ছিলেন জসিম উদ্দিন হলের আবাসিক ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই ইলিয়াস আলী যোগ দেন এরশাদের ছাত্রসমাজে। এসময় অস্ত্রবাজির রাজনীতি শুরু করেন। নতুন বাংলা ছাত্রসমাজের ক্যডার হিসেবে যোগ দিলেও পরে দলবদল করে ছাত্রদলের নেতা হয়ে ওঠেন ইলিয়াস আলী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায়ই দলে গ্রুপিংয়ের রাজনীতি ঢুকিয়েছিলেন ইলিয়াস আলী। গড়ে তুলেছেন নিজস্ব গ্রুপ। ছাত্রদলের ক্যাডার পরিচিতি দিয়েই উত্থান তার। একের পর এর ঘটনার নায়ক হয়ে জন্ম দিতে থাকেন অভন্তরীণ সংঘাত। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যায় বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। ইলিয়াস আলী পরিণত হন ত্রাস সৃষ্টিকারী এক সন্ত্রাসনির্ভর ছাত্রনেতায়। বহু খুনের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। সে কারণে একাধিকবার গ্রেফতার করা হয় তাকে। জেলে কাটে সময়।

১৯৮৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। তার বিরুদ্ধে ৮৮ সালের ১১ ডিসেম্বর ছাত্রদল নেতা বজলুর রহমান শহীদ ওরফে পাগলা শহীদ হত্যাকা-, ৮৯ সালের ২৯ নভেম্বর তার নেতৃত্বে ডাকসু কার্যালয় ভাংচুর, ৯২ সালের ৩ আগস্ট ছাত্রদলের রতন গ্রুপের সঙ্গে ইলিয়াস গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির নিহত হওয়া এবং এই সংঘর্ষের জের ধরে ৯২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মামুন ও মাহমুদ নাম দুই ছাত্রদল নেতার হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক ছিলেন ইলিয়াস আলী। মামুনকে হত্যা করে তার লাশ গুম করা হয়েছিলো সূর্যসেন হলের পানির ট্যাংকিতে। এছাড়াও প্রতিপক্ষ গ্রুপের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষে ছাত্রদল নেতা মির্জা গালিব ও ছাত্রলীগ নেতা লিটন হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৯৯১ সালে গ্রেফতার করা হয় ইলিয়াস আলীকে।

১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। তাই এক বছরের মধ্যেই ছাড়া পান ইলিয়াস আলী। এর পর দলের প্রত্যক্ষ মদদে ছাত্রদলে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন তিনি। ৯২ সালে ১৬ জুন ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠন করা হলে রহুল কবির রিজভী আহমেদ সভাপতি ও এম ইলিয়াস আলী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। কিন্তু সন্ত্রাসী তখনও কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় বিএনপির শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা তার প্রতি বিরগভাজন হয়ে ওঠেন। মাত্র ৩ মাসের মাথায় ছাত্রদলের কমিটি ভেঙ্গে দেওয়া হয়। এ সময় বিএনপি ক্ষমতায় থাকা স্বত্বেও ৯৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর মামুন ও মাহমুদ হত্যা মামলায় আবার গ্রেফতার হন ইলিয়াস আলী। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। ২ বছর কারাবাসের পর মুক্তি পান তিনি।

ইলিয়াস আলী নিজে ছাত্র খুন করে লাশ গুম করেছিলেন তার ছাত্রজীবনে। এখন তিনি সম্ভবত এর শিকার হয়ে গেছেন। যে কোন গুম ও খুনকে নৈতিক দিক থেকে সমর্থন করিনা। ইলিয়াস আলীর বর্তমান অবস্থাকেও সমর্থন করিনা। আমরা চাই দ্রুত আসল রহস্য বের হয়ে আসুক। সরকার যদি তাকে গুম করে খুন করে তাহলে এর কারণ জানিয়ে তার লাশ পরিবারের কাছে ফেরত দিক। আর যদি আত্মগোপন করে থাকেন তাহলে দ্রুত বের করে নিয়ে আসা হোক। তাকে ঘিরে বর্তমানে সারা দেশবাসিকে বিএনপির নেতৃতাধীন ১৮ দলীয় জোট যেভাবে জিম্মি করে রেখেছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত।

আতংকের ব্যাপার বিএনপি যখন নামসর্বস্ব ১৮ দল নিয়ে জোট করল ঠিক সে সময়ই নিখোঁজ হলেন ইলিয়াস আলী। এবং জোতের সবাই হরতাল দিতে মরিয়া হয়ে উঠলো। কর্ণেল অলি আহমদ সরকারকে হুমকি দিয়েছিলেন এই বাজেট অধিবেশনের আগে সরকারের পতন হবে। এর আগে আরো দুইবার তিনি এরকম হুমকি দিয়েছিলেন। আগের দুইবারের হুমকি ব্যর্থ হয়েছিল কিন্তু প্রতিবারই ষড়যন্ত্রের কাহিনী বের হয়েছিল। এবারের হুমকির সাথে ইলিয়াস আলীর নিখোজের ঘটনা মিলিয়ে দেখলে এবং এই ইস্যুতে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে একই দৃষ্টিতে দেখলে পুরো বিষয়টিকে কেউ ষড়যন্ত্র বলতেও পারে।

ইলিয়াস আলীর নিখোজের ঘটনা যদি ষড়যন্ত্র হয় তাহলে এটা উদ্ঘাটনের দায়িত্ব সরকারের। তিনি যদি গুম হয়ে খুন হয়েও যান তাহলে তার লাশ ফিরিয়ে দিয়ে অনিশ্চিত অবস্থা থেকে মুক্তি দেয়ার দায়িত্বও সরকারের। বিরোধীদলকে এই বিষয়ে দোষারোপ না করে সরকারের দায়িত্ব নিজেদের দায়িত্ব পালন করা। এবং গুম ও খুনের উপযুক্ত কারণ বর্ণনা করা। কোন বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ডকে আমরা সমর্থন করিনা যেমন করিনি প্রকাশ্য জনসভায় আহসানউল্লাহ মাস্টার এবং শাহ্‌ এ এম এস কিবরিয়ার হত্যাকাণ্ডও।

ব্যক্তির চেয়ে দল এবং দলের চেয়ে দেশ বড়। ইলিয়াস আলী এমন কেউ হয়ে যাননি যে তার জন্য সারা দেশবাসীকে এভাবে জিম্মি করে রাখা হবে। সরকার ও বিরোধীদলকে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই তা না হলে দেশ একটা অস্থিতিশীল এবং অনিশ্চিত অবস্থার দিকে নিপতিত হবে।