অপরূপ লামায় প্রকৃতির হাতছানি- পাহাড়ে শুনেছিলাম প্রাণের স্পন্দন

আতাস্বপন
Published : 1 April 2016, 02:23 AM
Updated : 1 April 2016, 02:23 AM

২০০৩ সাল। ফেব্রূয়ারী মাস। বান্দবানের লামায় আমাদের রাবার বাগানের প্রকল্প চলছে। অফিসের বসেরা সব সিদ্ধান্ত নিল এবার আমাদের বাৎসরিক ওয়ার্কসপ হবে রাবার প্রকল্পে। ১৯ আর ২০, এ দুদিন আমাদের ওয়ার্কসপ। ১৮ তারিখ রাতে পল্টন থেকে রওনা দিলাম আমরা লামার উদ্দেশ্যে।

সকালে আমরা বান্দরবনে পৌছলাম। বাসস্টেশন থেকে লামা যেতে হলে চাদেঁর গাড়ি নামে একটি টেম্পু জাতিয় বাহন করে যেতে হয়। আমরা চাদেঁর গাড়িতে চড়লাম। গাড়ি ছুটে চলছে পিচ ঢালা পথ ছেরে সরু উচু নিচু মেঠো পথে। ওরে বাবা! রাস্তা এমন উচু নিচু যে গাড়ি খাড়া হয়ে উঠে আর নামে। এই বুঝ উল্টে গেল। বুকের ভিতরটা আতংকে প্রায় ধুক ধুক করে উঠছিল। যাক অনেক ধকল সহে অবশেষে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজে পৌছলাম আমরা।

অপরূপ লামা। চারদিকে পাহারে ঘেরা। সামনে পাহাড়ী ঝর্ণায় সৃষ্টি হওয়া ছোট ছোট খাল প্রবাহিত।পাশে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন এর সুন্দর সাজানো গোছানো বাগানবাড়ীই বলতে পারি। এ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার গুরুজি মহাজাতক শহিদ আল বুখারী পাহারীয়াদের বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে একটি স্কুল চালান। আমাদের প্রতিষ্ঠানের সাথে শহিদ আল বুখারীর আ্ন্তরিক সম্পর্ক। আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রায়ই সব কর্মকর্তাকে বাধ্যতামুলক ভাবে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের মেডিটেশন কোর্স করতে হয়েছে। রাবার প্রকল্পে গুরুজিরও শেয়ার আছে। গুরুজির প্রতিষ্ঠানের পাসেই আমাদের বাংলো। লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজের ম্যানেজার জিয়া উদ্দিন বাংলোয় অভ্যর্থনা জানালেন আমাদের সবাইকে ।


অনেকটা পথ জার্নি করে শরীর ক্লান্ত । তাই ঝর্ণার পানিতে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। সামান্য নাস্তা করে শুরু হল ওয়ার্কশপ। প্রায় ৩ চার ঘন্টা ধরে চলল কার্যক্রম।

ওয়ার্কসপ এর আরো একটি পার্ট হলো পাহাড়ে আরোহন ও মেডিটশন। আমাদের কে কয়েকটি দলে বিভক্ত করে পাহাড়ে ছেড়ে দেয়া হল। মাথায় কেপ । হাতে শুধু একটি লাঠি। এই লাঠি ভর করে উঠতে হবে উচু পাহাড়ে। আমি এই প্রথম কোন পাহাড়ে উঠছি। তাই ভয় ভয় করছিল । এই বুঝি হঠাৎ পতন।


সারাদিন পাহাড়ে চড়েই কেটে গেল। গুরুজি পাহারড়ে কতগুলো জায়াগা নিজ মত করে সাজিয়েছেন। স্তরে স্তরে। একটু উঠলে একটা স্তর এর আবার নাম আছে। যেমন- তক্তে তাজাল্লি, তক্তে জামালি, তক্তে কামালি এই টাইপ নাম। প্রত্যেক স্তরে একটি করে বিশ্রামের জায়াগা আছে। বাঁশের মাচার মত। গুরুজির ভাষ্যমতে এখানে যদি কেউ পৌছে তাকে দু রাকাত নফল নামাজ পড়তে হবে অথবা মেডিটশন বা প্রর্থানা করতে হবে। সেখানো অনেক্ষন বসে মেডিটশন করে আবার শুরু করলাম পাহাড় পরিভ্রমন। পাহাড়ে দেখলাম কিছু কুড়ে ঘর আছে। এতো উচুতে কুড়ে ঘরে থাকে কারা? গিয়ে দেখি একটি পাহাড়ী পরিবার। রিতমত সংসার পেতে বসবাস। আমি অবাক হলাম এতউচুতে আমাদের উঠতে জান ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা ওরা কিভাবে প্রতিদিন খাবার আর পানি নিয়ে। উঠে নামে।

নানা বৈচিত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ালাম পাহাড়ের ঘন অরণ্যে। হারিয়ে গেলাম অপরূপ এক মায়ার জালে যেনো। কি যে শান্তি। আহা! কি যে প্রশান্তি। মনে হলো এখানেই থেকে গেলে কতইনা ভাল হতো। এভাবে দুপুর পর্যন্ত আমরা সেখানে কাটালাম। গোসল করলাম ঝর্ণার জলে। আহা! প্রানটা জুড়িয়ে গেল ঠান্ডা শিতল জলে। সারাদিনের ক্লান্তি সব নি:শেষে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল।

নামাজ পড়ে দুপুরের খাবার খেলাম সবাই। এরপর আবার ওয়ার্কসপ শুরু হল। চলল রাত অবধি। এরপর বারবিকউ পর্ব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রাত যত গভীর হয় লামার বনে তখন শুনা যায় নানা শব্দ। কিছু চেনা কিছু অচেনা। এর মাঝে চাঁদের আলো আর আবছা অন্ধকারে হারিকেনের আলোতে চলল বারবিকিউ প্রস্তুত প্রক্রিয়া। একটি আস্ত ছাগলকে দেখলাম আগুনে লটকিয়ে দিল। তারপার গ্রীল চিকেন যেভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পোরে তেমন পুরতে লাগল। এর মাঝে চলতে থাকল আমাদের হাসি ঠাট্টা আর গান। আজই জোস্না রাতে সবাই গেছে বনে……………..বষন্তের এই মাতাল সমিরনে। বারবিকিউটা আমার ভাল লাগেনি। এই প্রথম খেলাম বলে হয়তো। কেমন যেন গা গুলিয়ে গেল। যাক রাতের খাবার শেষ করে আমরা আবার ওয়ার্কশপ এ বসলাম। সারাদিনের কর্মকান্ডের উপর অনুভতি প্রকাশ করল সবাই। এরপর ঘুম। লামার অরণ্যে আমাদের প্রথম রাত্রীযাপন।
সকালে উঠেই সবাই ফজরের নামাজ শেষে আবার মেডিটশনে বসল। এরপর সকালের নাস্তা সবজি আর খিচুরী। সাথে অবশ্য রাতের বারবিকিউও ছিল । আমি ছুয়েও দেখিনি আর। নাস্তা পর্ব শেষে আবার শুরু হল ওয়ার্কসপ। চলল সকাল ১০ টা পর্যন্ত। এরপর আবার পাহার ভ্রমন । তবে এবার যেতে হবে রাবার বাগানে। রাবার গাছগুলি কিছু বড় কিছু আবার চারা। এই প্রথম রাবার বাগান দেখলাম।


রাবার বাগান ছাড়াও বিভিন্ন ফলের গাছও দেখলাম। বাগান দেখতে দেখতে আমরা চলে এলাম একটি গুহার কাছে। ঢুকে পড়লাম আল্লাহর নাম নিয়ে তার ভিতর। একটু অন্ধকার আর ঠান্ডা গুহাটা। পানির নহর বয়ে যাচ্ছে । সেই পানিতে হেটে হেটে আমারা চলছি। গুরুজি এ গুহাটার নাম দিয়েছেন চিচিং ফাক। আলি বাবা চল্লিশ চোরের গুহার মত দেখতে বলে হয়তো। গুহার শেষ মাথায় এসে সামনে একটা বড় খাদ দেখলাম। তাতে পানি গুলো গিয়ে পড়ছে। খাদে নামতে চাইলাম । কিন্তু সাহাস হলো না । কি থেকে কি হয়ে যায়। ফিরে আসলাম সবাই বাংলোয় । তখন ঘরি কাটা ১২টা বাজে। এসে দেখলাম ম্যানেজার জিয়া ভাই প্রজেক্টের পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরার ব্যবস্থা করেছেন। আমরা নেমে পড়লাম পুকুরে। জাল ফেলার পর ডুব দিয়ে জালে আটাকানো মাছ ধরছে অনেকে। আমার পায়েও জালের মাছ লেগেছে । কিন্তু ধরতে পারিনি। আমাদের নির্বাহি পরিচালক ঘোষণা করলেন যে বেশী মাছ ধরতে পারবে তাকে পুরস্কৃত করা হবে। বাস লেগে গেল সবাই মহা উৎসাহে মাছ ধরতে। আমিও লেগেগেলাম এবং একটি মাছ ধরলাম । আর পারিনি। মাছ ধরা পর্ব শেষ করে সবাই আবার গেলাম ঝর্নার জলে স্নান করতে। দুপুরে মোরগ পোলাও। খাশির মাংস। চমৎকার খানা। মজা করে খেলাম। এরপর ওয়ার্কশপ সমাপনি। ওয়ার্কশপ শেষ বলা হল গান গাওয়ার জন্য। যে যেটা পারে। আমাদের নির্বাহী পরিচালকও দেখলাম গান ধরলেন । একটি পুরনো পপ গান। আজম খানের। ওনার বয়সের সাথে জায় না। কিন্তু ভালই গাইলেন। আলাল ও দুলাল………………….ওদের বাবা………….। এরপর ফটোসেশন।

ভালই কাটল সময়গুলো। এবার ফেরার পালা।