চলে গেলেন যুবক গ্রুপের চেয়ারম্যান ও আরটিভির স্থপতি আবু মোঃ সাঈদ

আতাস্বপন
Published : 6 June 2017, 09:01 PM
Updated : 6 June 2017, 09:01 PM

চলে গেলেন লামা রাবার এসোশিয়েশন এর চেয়ারম্যান, আর টিভির প্রকৃতি চেয়ারম্যান সর্বপরি যুবক গ্রুপের চেয়ারম্যান আবু মোঃ সাঈদ। অনেক স্বপ্ন ছিল এই মানুষটার। স্বপ্ন নিয়েই যুবকের যাত্রা শুরু করেন। সেই প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র এক কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার থেকে আজ যুবক গ্রুপ হয়েছিল। এই মানুষটার স্বপ্নগুলোকে হরণ করে নিয়েছে লুটেরার দল। স্বপ্নগুলোতে কলংকের কালি লেপন করে অপবিত্র করা হয়েছে। তবুও থেমে ছিলনা তার স্বপ্ন। নুতন করে সব শুরু করার চেষ্টায় আত্মনিযোগ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্তও স্বপ্ন দেখেছেন যুবককে নতুন রূপে গড়ার। আমি যুবকের একজন কর্মকর্তা ছিলাম। আবেগপ্লুত মনে তার সম্পর্কে তাই কিছু বলতে চাই সবাইকে।

১৯৯৮ সালের কথা আমি তখন সবে জয়েন করেছি যুবকে। হুসাইন ভাই আর নজরুল ভাই রাশেদ ভাইকে ছারা কাউকে তেমন চিনি না। এরা আমার খিলগাঁও এলাকার বড় ভাই । এদের মধ্যে হুসাইন ভাইয়ের সাথেই সখ্যতা বেশী ছিল। আবু মোঃ সাঈদ ভাইয়কে তখন প্রায়ই হুসাইন ভাইদের সাথে দেখতাম কিন্তু আলাপ পরিচয় হয়নি। সাইদ ভায়ের সাথে আমার আলাপ হয় কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশ এর কোর্স করতে গিযে।

কোয়ান্টাম মেথড প্রায় একরকম জোর করেই অফিস আমাদের করালো। প্রতিমসে বেতন থেকে কোর্স ফি কাটা যেত। কোয়ান্টাম মেথড কোর্সের শেষ দিন ছিল সেদিন। গুরুজি মাতাজি সামনে টেবিল পেতে বসা। পাসের মঞ্চে কোর্স সম্পন্ন কারিরা তাদের অনুভূতি ব্যাক্ত করছে। সামনে অডিয়েন্সে বসা সদ্য কোর্স সম্পন্নকারীরা আর যুবকের কয়েকজন পরিচালক ও দায়িত্বশীল। সাইদ ভা আর মনির ভাই তাদেরই মাঝে রয়েছেন।

আমাকে অনুভূতি ব্যাক্ত করতে মঞ্চে ডাকা হলো। কোয়ান্টাম মেথড আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন এক ধারনা। কী বলব কী বলব করে ভাবছিলাম। একসময় হর হর করে অনেক কিছু বলে ফেললাম। যা শুনে উপস্থিত সবাই শুধু নয় আমাদের সাইদ ভাই খুব পুলকিত ও অবাক হয়েছিলেন। দু'একটা কথা এরকম-
মাতাজি সম্পর্কে-

সবাই মাতাজিকে মাতাজি বলে কেন? মায়ের মত ভাবসাবতো দেখি নাই। যদিও মহিলা মাতৃজাতি। কিন্তু আমরা তো সবাইকে মাতা ডাকি না। কেউ মা কেউ বউ কেউ বোন আাবার কেউ দাদি-নানি। কথা হলো উনি কেন মাতাজি। প্লিজ ডোন্ড মাইন্ড, মানে সাজ-পোশাক দেখে উনাকে কিন্তু আমার বড় বোনের মত মনে হচ্ছে । মাতাজি মনে হয় না। এর উত্তর অবশ্য মাতাজি দিয়েছিলেন তার পরবর্তি বক্তিতায়। আমার কাছে মনে হয়েছিল বেচারি ভালই মাইন্ড করেছেন।

মেথড সম্পর্কে-
গুরুজির মেথডটা খুব ভাল লেগছে আমার। আর কিছু না হোক কিভাবে ঘুমানো যায় এই কোর্স এ এটা শিখে গেলাম। আলফা লেবেল গাামা লেবেল …….এই তত্বটাও খুব ভাললেগেছে আমার। হুট করে ধ্যানে না নিয়ে একটু একটু করে ধ্যানে প্রবেশ। বাহ! দারুণ! কখন যে ধ্যানের গভীরে বা ডিপ স্লিপে চলে গেছি টেরই পাইনি। অবশ্য এমন টেকনিক আমারও আছে। আমি ছাত্র পড়াই। ছাত্র ভীষন দুষ্ট। পড়া তার পছন্দ না। একেবারে ছোট তো ৪/৫ বছর হবে বয়স। কোলে নিয়ে পড়াই । সে কোলে বসে আমার গালটাল খামছে একাকার। পড়বেই না। খালি বলে গল্প বল। গল্প শুনব। মহা ফ্যাসাদ। এখন পর্যন্ত অ -টাও লিখতে শেখেনি। মানে শেখাতে পারিনি। ছাত্রের মা-বাপের সামনে প্রেসটিজ আর থাকে না! কি করি! কি করি!

তখনই গুরুজির মত তত্ত্ব বের করলাম। গল্পে গল্পে শিক্ষা। তখন টিভিতে রবিন হুড চলত। ছাত্র তার খুব ভক্ত। দেখ সোনা এই গোল দিলাম এইটা হইল রবিনহুডের জঙ্গল। ছাত্র মনোযোগ দিল। এর অপর পাশে———রাস্তা গেছে। এভাবে গল্প বলে বলে তাকে কখন যে অ শিখিয়ে ফেললাম। আমার কাছে এই মেথডে প্রবেশ এই রকমই লেগেছে । গুরুজিকে ধন্যবাদ। ধ্যান মিশ্রিত ঘুমের জন্য।

মঞ্চ থেকে নেমে আসার সাথে সাথে সাইদ ভাই আমাকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত দিয়ে বললেন ভালো বলেছ তুমি। এই থেকে শুরু সাইদ ভায়ের সাথে আমার চলা…..। তার সাথে অনেক স্মৃতি আছে আমার। প্রত্যেকটিই আমাকে উৎসাহ দেয়া বাণী। কখনো বা বন্ধুসুলভ পরামর্শ। হয়তো অবাকই হবে অনেকে একজন চেয়ারম্যান একটি গ্রুপের তার সাথে একজন সাধারণ কর্মকর্তার বন্ধুত্ব কেমন করে?

সাঈদ ভাই এমনই। উনি যতবার আমার সাথে কথা বলেছেন বন্ধুর মতই খোলাখুলি বলেছেন। উনার মুখে রাকঢাক ভাবটা দেখিনি। কখনো বলছেন সিনেমা নিয়ে। কখনো বলছেন আইটি নিয়ে। কখনো দেশের হালচাল নিয়ে। আবার এমন কিছু বিষয়ে তিনি কথা বলতেন তা শুনে আমি লজ্জায় মর মর। বস এসব কি বলছেন। আচ্ছা একটা ঘটনা তাহলে বলেই ফেলি।

একদিন বলছেন, তালেব জানো, পৃথিবীতে একটা ন্যাংটো আধুনিক সম্প্রদায় আছে। তুমি কি জানো? আমি শুনে লজ্জায় সংকুচিত হয়ে বললাম, না ভাইয়া জানি না তো। আজই ইন্টারনেটে সার্চ করে দেখ । সত্যই অবাক করার মতো ব্যপার। মা-বাবা-ছেলে-মেয়ে সবাই ন্যাংটো। ভাবতে পার। হাটে বাজারে ন্যাংটো হয়ে চলাফেরা করছে।

আমি মনে একটু সাহস সঞ্চয় করে লজ্জা ভাব কাটানোর চেষ্টা করে অবাক বদনে জিজ্ঞেস করলাম, কী বলছেন ভাইয়া? ছি। ছি। ভাইয়া ওদের মধ্যে ন্যাংটো নারী দেখে কি কোন ফিলিংস হয় না? গল্পটা আর বলব না। যা বলেছি শুধু বোঝানোর জন্য বলা।

মানুষটা আমাকে খুব স্নেহ করতেন। মাঝে তার একান্ত কিছু কথাও বলতেন। একদিন আমাকে বললেন, তালেব আরটিভিটা আমাদের কাছে থেকে নিয়ে গেল কিছুই করা গেল না। হুসেন আর আমাকে আটকে রেখে জোর করে নিয়ে গেল। আজ ওখানে থেকে অন্যে লাভবান হচ্ছে। আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখছি। আমাদের এ দু:সময়ে ওটা থাকলে কাজে লাগতো। তুমি একটা কাজ করনা কেন, ফেসবুকে একটা সাইট খুলে আমাদের পক্ষে জনমত তৈরি করো। মিশরের রাজনীতিতে তো ফেসবুকে একটা বিপ্লব করে ফেলেছে।

আমি একটা গ্রুপ খুললাম । তাতে লেখালেখি শুরু করলাম। আজ সে গ্রুপে অনেক সদস্য। তারা আরটিভি ফেরত চায় বলে গ্রুপে মতামত দেয। যুবক নিয়ে মতামত দেয়। এই সাইদ ভাইয়ের জন্য আমি আজ ব্লগার। না আমি ব্লগে আগে লিখিনি কখনো। যুবকের জন্য সাইদ ভাই আর হুসাইন ভা্ইয়ের অনুপ্রেরণায় ২০১২ সালে ব্লগ ডট  বিডিনিউজ টোয়ান্টিফোর ডট কমে আমার প্রথম পোষ্ট 'যুবকের আর.টিভি ফিরিয়ে দিতে হবে' দিয়ে যাত্রা শুরু হয়।

সাইদ ভায়ের সাথে অনেকদিন দেখা হয়নি। তার সাথে সর্বশেষ দেখা হয়েছিল পল্লবী আপার অফিসে এক ইফতার পার্টিতে। তাও দু'বছর হয়ে গেল। সেবার যুবক নিয়ে তার সামনে স্মৃতিচারণ করেছিলাম। আজ সাঈদ ভাই নিজেই স্মৃতি হয়ে গেলেন। তার রুহের মাগফিরাত কামনা করি। মরহুম আবু মোঃ সাঈদ ভাই আর টিভির অরজিনাল চেয়ারম্যান ছিলেন। আফসোস তার জীবদ্দশায় তাকে সে আসনটি ফিরিয়ে দেয়া গেল না। ইনশাআল্লাহ তার সে আসনসহ আরটিভি ফেরত আনা হবে। শুধু একটু ধৈর্য আর অপেক্ষা। যুবকের চেয়ারম্যান আবু মো: সাঈদ ভাই আমাদের অহংকার। তার মধুর বচন আর শোনা যাবে না। ভাবতেই কেমন করে উঠছে বুকে। হে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করো। জান্নাতবাসি করো।

সব চলে যাওয়া চলে যাওয়া নয়
ফিরে আসাও হয়
নতুন করে, হয়ে চেতনা ময়
তব চেতানায় জাগিবে যুবক
রাংগীবে আকাশ ভুলক দুলক
তুমি যে নও শুধু একজন আদমসন্তান
তুমি যে আজ লাখ স্বপ্ন, নব ঐকতান।