আঙ্গুলের ডগায় বাংলা বর্ণের শিহরণ

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 20 Feb 2012, 09:18 AM
Updated : 20 March 2022, 01:47 PM

অভ্র বনাম বিজয়। এই বিষয়ে বহু বিতর্ক-বাহাস হয়েছে দৃশ্য, শ্রাব্য, প্রথাগত ও সামাজিক গণমাধ্যমে। বিজয় কঠিন, জব্বার সাহেবই নাকি কোনো কারণে বিজয়কে কঠিন করে রেখেছেন ইচ্ছা করে। মন্ত্রী হবার পর জব্বার সাহেবের ওপর লোকজন আরও বেশি ক্ষিপ্ত, কারণ ব্যক্তি মোস্তফা জব্বারের ওপর ক্ষোভের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারবিরোধী ক্ষোভ। ক্ষোভ ঝাড়তে গিয়ে মানুষের মন্তব্য ও অভিযোগ- 'জব্বার সাহেব নাকি বিজয়ের প্রকৃত উদ্ভাবক নন, অন্য একজন', 'কোন অধিকারে জব্বার সাহেব বিজয় প্রোগ্রামে মুনীর কিবোর্ড যুক্ত করেছেন', 'কেন তিনি বিজয়ের বিনিময়ে সামান্য হলেও টাকা নিচ্ছেন, যখন কিনা অভ্র তার প্রোগ্রাম মাগনা দিচ্ছে', 'কেন তিনি (আকিজ বিড়ির বোঁদার উপর মালিক আকিজের ছবির মতো) নিজের ও নিজের নাতির 'ভ্যাটকিয়া' হাসিযুক্ত ছবি দেখতে বাধ্য করছেন বিজয় ব্যবহারকারীদের', 'কেন তিনি নির্বাচন কমিশনের কাজের জন্যে কয়েক কোটি টাকা দাবি করেছিলেন, যখন কিনা অভ্র নিজের প্রোগ্রাম বিনা পয়সায় দিয়ে দিয়েছে সরকারকে এবং এর ফলে জনগণের সেই টাকাটা সাশ্রয় হয়েছে', 'কেন তিনি অভ্রের বিরুদ্ধে কপিরাইট মামলা করেছিলেন' ইত্যাদি। মোস্তফা জব্বার সাহেবের বিরুদ্ধে এরকম হাজারও অভিযোগ আপনারা অন্তর্জাল ঘাটলেই পাবেন।

যারা বলেন, জব্বার সাহেবের উচিত বিজয় ফ্রি করে দেওয়া, তাদের সঙ্গে আমি একমত নই। কোনো পণ্যই ফ্রি হওয়া উচিত নয় এবং সস্তার তিন অবস্থা– এই আমার মত। পণ্য তৈরি করতে খরচ আছে এবং বিক্রি করেই সেই খরচ তুলতে হবে। কম্পিউটার প্রোগ্রাম লঙ্গরখানার ভাত নয় যে ভুখামাত্রকেই ডেকে ডেকে জগাখিচুরি খাওয়াতে হবে। কেউ যদি তার পণ্য দান করে পূণ্য লাভ করতে চায়, তিনি মহানুভব। একজন সত্যিকারের ব্যবসায়ীর মহানুভব হবার কোনো দায় নেই। সব ব্যবসায়ী যদি তাদের পণ্য ফ্রিতে দিতে থাকে, তবে ব্যবসা লাটে উঠবে এবং সেই সাথে লাটে উঠবে সমাজ-ব্যবস্থা।

আমার যদিও কাজ চলে যায়, কিন্তু অনেকেই বলেন এবং আমিও অনুভব করি, বিজয় প্রোগ্রামের অনেক সমস্যা আছে। বিজয়ও আবার দুই রকম, সাধারণ বিজয় এবং ইউনিকোড। সাধারণ থেকে ইউনিকোডে বা ইউনিকোড থেকে বিজয়ে রূপান্তর বা কনভার্ট করা যায় বটে, কিন্তু কিছু সমস্যা থেকেই যায়। বিজয়ের ফন্টেও সমস্যা আছে, বিশেষ করে কোনো কোনো যুক্তাক্ষরে। কিছু কিছু সমস্যার কথা আমি জব্বার সাহেবকে বলেছিও মেসেঞ্জারে। কিন্তু আমি যেহেতু প্রিন্টিং-এর সঙ্গে যুক্ত, বিজয় ছাড়া আমার চলে না। ফটোশপ, ইলাস্ট্রেটর, ইনডিজাইন ইত্যাদিতে বিজয়ের প্রয়োজন হয় দেখেছি।

অভ্রে যারা টাইপ করেন, তাদের টেক্সট আবার বিজয়ে টাইপ করে নিতে হয়– এটা অবশ্য আমার অভিজ্ঞতা এবং হয়তো 'অ-বিজ্ঞতা'। সম্পাদনা ও মুদ্রণ বিশেষজ্ঞ রাখাল রাহা জানিয়েছেন, অভ্র টেক্সট সহজেই বিজয়ে কনভার্ট করা যায়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, অভ্রের বিজয়কে প্রয়োজন হয় কেন, বিজয়েরতো অভ্রকে প্রয়োজন হয় না! অভ্রকে কেন তার কিবোর্ডের নাম 'ইউনি-বিজয়' রাখতে হয়? বিজয়তো তার কিবোর্ডের নাম 'ইউনি-অভ্র' রাখে না!

প্রথমেই বলে নিই, বিজয় আমি ব্যবহার করি বটে, কিন্তু অভ্রের বিপক্ষে আমি নই। যে কেউ তার পছন্দমতো যেকোনো কিবোর্ড ব্যবহার করতে পারে। একেক জনের টাইপ শেখার ইতিহাস একেক রকম। সবার ইতিহাস আমার সঙ্গে মিলবে না, মেলার কথাও নয়। আমি অভ্রের তেমন খোঁজ রাখি না, তবে অভ্রের নাকি একাধিক কিবোর্ড আছে, যার মধ্যে একটিকে 'ফোনেটিক কিবোর্ড' বলা হয়। ফোনেটিক কিবোর্ড আরও অনেক রকম আছে, অনেক দেশেও আছে। আমি মূলত এই কিবোর্ড বা এই ধরনের কিবোর্ডের বিপক্ষে। অভ্রের বাংলা কিবোর্ডে যদি বাংলা দিয়ে বাংলা লেখা হয়ে থাকে, তবে সেই কিবোর্ডে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই।

তথাকথিত ফোনেটিক কিবোর্ডে বাংলা শব্দের বানানকে প্রথমে ইংরেজি বর্ণে বানান করা হয়। আরবেরা এমন কিবোর্ড ব্যবহার করে, থাইরাও নাকি করে। উইকিপিডিয়া বলছে (মৎকৃত অনুবাদ): 'ফোনেটিক কিবোর্ড হচ্ছে এমন একটি বর্ণক্রম যাতে সংশ্লিষ্ট ভাষার প্রতিটি বর্ণ 'অন্য একটি ভাষার কিবোর্ডের একটি বর্ণের সঙ্গে যুক্ত থাকে। ভিত্তিভাষা এবং নির্ভরশীল ভাষার বর্ণ ধ্বনিসাম্যের ভিত্তিতে পরস্পরের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়।' কিন্তু ইংরেজি 'এ' বর্ণের কমবেশি নয় রকম উচ্চারণ আছে, যার মানে হচ্ছে, 'এ' বর্ণের সঙ্গে নয়টি ফোন বা ধ্বনি যুক্ত। এর মধ্যে একটি ধ্বনি বাংলা 'আ'-এর সঙ্গে কিছুটা হয়তো মেলে। এর মানে হচ্ছে, বাংলা ও ইংরেজি বর্ণের ধ্বনিসাম্য অসম্ভব। ট্রান্সলিটারেশন বা কাছাকাছি প্রতিবর্ণীকরণ সম্ভব, কিন্তু প্রতিবর্ণীকরণকে কোনো বিচারেই ফোনেটিক বলা যাবে না।

ইংরেজি বানান যেরকম ফোনেটিক নয়, তেমনি বাংলা বানানও ফোনেটিক নয়। কোনো ইংরেজি-ভিত্তিক অক্ষরদানী ফোনেটিক নয়, এগুলো ইংরেজি বর্ণমালা ব্যবহার করে থাকে– এই মাত্র। ফোনেটিক বর্ণ বলে কিছু নেই, বর্ণ সাধারণত ফোনেটিক হয় না। ইংরেজি ও বাংলা বর্ণমালার তফাৎ হচ্ছে, ইংরেজির বর্ণগুলি একেকটি ফোনিম বা ধ্বনিমূল (যাকে আমি বলি 'প্রণব') আর বাংলার বর্ণগুলি (ৎ বাদে) একেকটি সিলেবল বা অক্ষর। 'আমার' শব্দকে amar লিখে যারা ভাবছেন, তারা ফোনেটিক কী-বোর্ড ব্যবহার করছেন, বোকার স্বর্গে বাস করছেন তারা। প্রতিবর্ণীকরণেও সমস্যা আছে। 'ভি' বর্ণ দিয়ে লেখা ইংরেজি Avro বানানটিই অশুদ্ধ। বাংলা ভ-এর কাছাকাছি উচ্চারণের ইংরেজি ধ্বনিক্রম হবে bh। ইংরেজি 'ভি' বর্ণের সমোচ্চারিত ধ্বনি বাংলায় একটিও নেই, যদিও হিন্দিতে আছে বটে। ব্র্যান্ডের নামের বানানটাই যখন ঠিকমতো লেখা হয়নি, তখন বাকি সব বর্ণের প্রতিবর্ণীকরণের ওপর ভরসা রাখি কী করে!

একেক বর্ণমালা একেক ভাষার জন্যে উপযুক্ত– এ কথা যেমন সত্য, আবার যেকোনো বর্ণমালা দিয়েই যেকোনো ভাষা লেখা যায়– এ কথাও মিথ্যা নয়। উর্দু আর হিন্দি একই ভাষা, কিন্ত উর্দু লেখা হয় ব্যঞ্জননির্ভর আরবি লিপিতে এবং হিন্দি লেখা হয় সিলাবিক বা অক্ষর-নির্ভর দেবনাগরী লিপিতে। বাংলাও আরবি লিপিতে লেখা হয়েছে পুঁথির যুগে, আরবিতে বাংলা লেখা প্রচলন করার চেষ্টা হয়েছিল পাকিস্তান আমলে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতো ভাষাবিজ্ঞানী রোমান/ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লেখার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু ভাষাবিজ্ঞানীরা এটাও স্বীকার করেন যে আক্ষরিক লিপিই বাংলার মতো ভাষার জন্যে শ্রেয়তর।

যারা ইংরেজিতে টাইপ করতে জানে কিংবা ধরুন, দুই আঙ্গুল দিয়ে কোনোমতে খুঁটে খুঁটেও টাইপ করতে পারে, তারা অভ্র ফোনেটিক বা অনুরূপ কোনো কিবোর্ড ব্যবহার করতে পারবে, তবে শর্ত হচ্ছে, ইংরেজি বর্ণমালা তাকে চিনতে হবে। ইংরেজি যারা জানে না, তথাকথিত ফোনেটিক কিবোর্ডের দুয়ার তাদের জন্যে বন্ধ। ফোনেটিক কিবোর্ডে টাইপ করতে হলে ইংরেজির উঠান দিয়েই আপনাকে বাংলার ঘরে ঢুকতে হবে। সুতরাং ফোনেটিক কিবোর্ড ব্যবহার করার প্রথম এবং প্রধান শর্ত হচ্ছে, দ্বিতীয় একটি ভাষা জানতে হবে আপনাকে। এটা অনেকটা আঙ্গুলের সঙ্গে কাঁটা-চামচ লাগিয়ে সাইবর্গ বা জাফর ইকবালের বায়োবটের হাত দিয়ে খাওয়ার মতো বিব্রতকর অবস্থা। তবে কেউ একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে, ক্ষুধাও যদি থাকে, সেক্ষেত্রে খেতেই হয় এবং খাওয়ার কাজটা কোনো না কোনোভাবে চলেও যায়।

পরগাছার জীবন হেয়, কারণ বেঁচে থাকার জন্যে তাকে অন্য একটি গাছের ওপর নির্ভর করতে হয়। বাংলাকে যদি টিকে থাকার জন্য ইংরেজির ওপর নির্ভর করতে হয়, সে যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন, তবে বাংলা ও বাঙালির জন্যে ব্যাপারটা লজ্জাস্কর নয় কি? তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, বেঁচে থাকার এই পদ্ধতি কখনোই টেকসই বা সাসটেইনবেবল হতে পারে না। বাংলাকে নিজের জোরেই টিকতে হবে, ইংরেজির সহায়তায় নয়। এমন বহু জার্মান, চীনা, জাপানি আছেন, যারা এক বিন্দু ইংরেজি জানেন না, কিন্তু তাদের জীবন থেমে থাকেনি। সুতরাং 'ইংরেজি জানে না!' এই অজুহাতে টাইপ শেখা থেকে আমজনতাকে বঞ্চিত করবো আমরা কোন যুক্তিতে?

ইংরেজি, শুধু ইংরেজি কেন, একাধিক বিদেশি ভাষা শেখা মনের স্বাস্থ্যের জন্যে, জীবনে টিকে থাকার জন্যে সহায়ক– প্রতিটি ভাষা একেকটি কার্যসহায়ক যন্ত্র। কিন্তু সাবধান! 'সহায়ক' আর 'অপরিহার্য'-কে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। ইংরেজি শেখাকে আমরা 'উৎসাহিত' করতে পারি, কিন্তু কোনোক্রমেই 'অপরিহার্য' ঘোষণা করতে পারি না, কারণ সেটা হবে বাংলা ভাষার অপমান! ইংরেজির সহায়তা ছাড়া যদি একজন জার্মান, বিন্দুমাত্র ইংরেজি না শিখে একজন চীনা বা জাপানি যদি পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারে, মঙ্গলে রোবট নামাতে পারে, তবে বাঙালি কেন পারবে না? ফোনেটিক কিবোর্ডের প্রথম এবং প্রধান দোষ, এই কিবোর্ড বাঙালিকে বেহুদা এবং একান্তভাবে ইংরেজি-নির্ভর করে তুলছে।

বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব জানলে ফোনেটিক কিবোর্ড দিয়ে টাইপ করা সহজ বলে দাবি করছে অনেকে। এর মানে কী, আমি বুঝি না। বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব অনুসারে 'আমার' শব্দে তিনটি ধ্বনিমূল বা ফোনিম আছে: /আ/, /ম/, /আ/ এবং /র/, একটি ফোনিম দুই বার ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং /আ/ এর পরিবর্তে ইংরেজি 'এ'-বর্ণ, ম-এর পরিবর্তে 'এম' এবং /র/-এর পরিবর্তে 'আর' বর্ণ বসিয়ে দিলেই 'আমার' শব্দ ভেসে উঠবে স্ক্রিনে। এখানে আমার আপত্তি হচ্ছে, প্রথমত, টাইপ করার মতো অতি সাধারণ একটি কাজে কেন ধ্বনিবিজ্ঞানের জ্ঞান বাধ্যতামূলক হবে? দ্বিতীয়ত, একজন ধ্বনিবিজ্ঞানী বা একজন শিক্ষিত লোকের ধ্বনিবিজ্ঞানের জ্ঞান থাকতে পারে, কিন্তু সাধারণ মানুষের এই জ্ঞান থাকাটা স্বাভাবিক নয়। পেঁয়াজ কিনতে গিয়ে আমাকে যদি পেঁয়াজের বৈজ্ঞানিক নাম জানতে হয়, তাহলেতো মহা মুশকিল!

ভদ্দরলোকেরা ইংরেজি দিয়ে বাংলা লেখাকে স্বাগত জানাচ্ছে, তারা ইংরেজি জানে বলে। কিন্তু বাঙালি জনগোষ্ঠীর ৯৯%ভাগ ইংরেজি না জানা আমজনতা কী করবে? তাদের কথা ভেবেই আমাদের প্রযুক্তির প্রকৃতি ও করণীয় নির্ধারণ করা উচিত। কোনো কোনো নাদান প্রযুক্তিবিদ বলে, বাংলার অনেক সমস্যা, বিকল্প বানান, কারক-বিভক্তি, ইংরেজির এত জটিল নয়, সুতরাং বাংলাকে প্রযুক্তির আওতায় আনা যাবে না। এরা না বুঝে ভাষা, না বুঝে প্রযুক্তি। প্রযুক্তিকে বাংলা ভাষার বাস্তবতাকে হিসেবের মধ্যে নিয়ে নিজেকে অধিকতর কার্যকর প্রমাণ করতে হবে। বাংলা ভাষাকে বোঝার দায় প্রযুক্তির, প্রযুক্তির উপযুক্ত হওয়ার ক্ষমতা বাংলা ভাষার নেই, প্রাকৃতিকভাবেই নেই। বাঙালি হাজার চাইলেও বাংলা ভাষাকে প্রযুক্তির অনুরোধে বদলাতে সক্ষম হবে না।

যদি বলা হয়, প্রযুক্তি-নির্ভর হবার জন্যে ইংরেজি শেখা অপরিহার্য, তবে সেই প্রযুক্তি ঘরের জিনিস হয়ে উঠবে না কখনোই। কম্পিউটার যদি ফরাসি বোঝে, জাপানি বোঝে, চীনা বোঝে, তবে বাংলা বা আরবি বুঝতে তার সমস্যা কী? কম্পিউটারের জন্য ভাষা কোনো সমস্যা নয়। চেক বা চীনাভাষীরা কি ইংরেজিতে কোডিং বা ট্যাগিং করছে? কম্পিউটার বুলিয়ান বীজগণিতের লজিকাল ভাষা বোঝে, তার কাছে বাংলাইবা কী, ইংরেজিই বা কী? বাংলা-ইংরেজির মতো প্রকৃতি-সৃষ্ট ভাষা বা ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ কম্পিউটার বোঝে না। কোডিং-এর ভাষা ইংরেজি হবার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ফরাসি দেশে ফরাসি ভাষাতেই কোডিং হয়।

একটি ভাষার কিবোর্ড আপনি জানেন এবং তা দিয়ে আপনি ফোকটে 'কাম সারতে' চাইছেন। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট আমজনতা কখনোই ইংরেজি শিখবে না, শিখতে সক্ষম হবে না, কারণ চমস্কির মতে, একটি ভাষা শিখতে হলে, ভাষা অর্জন ও শিক্ষাকালীন সেই ভাষার ইনপুট লাগে। যেহেতু সিংহভাগ বাংলাভাষীর ভাষা অর্জনকালে ইংরেজির কোনো ইনপুট থাকে না, সেহেতু ইংরেজি কখনই অধিকাংশের ব্যবহার্য ভাষা হয়ে উঠবে না। ইংরেজি খুব বেশি হলে কিছু বাঙালির ধাত্রীভাষা হবে, মাতৃভাষা কখনই নয়। দাই দিয়ে মাকে প্রতিস্থাপিত করতে গেলে 'মাই' না পেয়ে শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগবে।

ইংরেজি কিবোর্ডকে অনেকে 'কোয়ের্টি' (দ্বিতীয় সারির 'কিউ-ডব্লিউ-ই-আর-টি বর্ণের সম্মিলিত উচ্চারণ) কিবোর্ডের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। ক্রিস্টোফার ল্যাথাম শোলস ১৮৬৭ সালে এই কোয়ের্টি কিবোর্ডের পরিকল্পনা করেছিলেন, যেটা রেমিংটন কোম্পানি ১৮৭৩ সালে কিনে নেয়। শোলসের কোয়ের্টি কিবোর্ডে 'আর' বর্ণ ছিল নিচের চতুর্থ সারির সর্ব ডানে এবং ফুলস্টপ ছিল 'আর'-এর জায়গায়। রেমিংটন সেটা বদলে এখনকার মতো করে নিয়েছিল।

যেকোনো অক্ষরদানীতে অক্ষর সাজানোর নিয়ামক হওয়া উচিত সংশ্লিষ্ট ভাষার বর্ণ বা অক্ষরের পৌনঃপুনিকতা বা ফ্রিকোয়েন্সি। কিবোর্ডের কার্যকর নিয়ম হচ্ছে, যে বর্ণগুলোর ব্যবহার বেশি, সেগুলো মাঝের সারির মধ্যখানে, তর্জনী ও মধ্যমার নাগালের মধ্যে থাকতে হবে। কোয়ের্টি নির্মাণের সময়ে ইংরেজি বর্ণের পৌনঃপুনিকতা মাপার বিজ্ঞানসম্মত উপায় ছিল না কিংবা অন্য কোনো কারণে ইংরেজি বর্ণের পৌনঃপুনিকতার বিচারে কোয়ের্টি সর্বোত্তম অক্ষরদানী বলে বিবেচিত হয় না। কোয়ের্টিতে টাইপ করতে গিয়ে হাতে ব্যথা হয় বলে অভিযোগ আছে। পৌনঃপুনিকতার নিরিখে একাধিক কিবোর্ডের প্রস্তাব করা হয়েছিল কোয়ের্টি কিবোর্ডের পর, কিন্তু টাইপিস্টরা কোয়ের্টিতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল যে বাকি কিবোর্ডগুলো প্রচলন করা সম্ভব হয়নি।

ইংরেজির পর জার্মান, ফরাসি ইত্যাদি ভাষারও কিবোর্ড নির্ধারণ করতে হয়েছিল, সেই টাইপ-মেশিনের প্রয়োজনেই। ফরাসি কিবোর্ডের নাম 'আজের্টি' (উপর থেকে দ্বিতীয় সারিতে আ-যেড-ই-আর-টি বর্ণের সম্মিলিত উচ্চারণ)। এটি নির্ধারণের সময় ফরাসি বর্ণের পৌনঃপুনিকতার একটা হিসাব করা হয়েছিল নিশ্চয়ই, যার প্রমাণ, কয়েকটি বর্ণ: এ, এস, কিউ, ডব্লিউ, এম, কমা স্থানপরিবর্তন করত না। জার্মান কিবোর্ড কোয়ের্টির মতোই, তবে 'ওয়াই' আর 'যেড' বর্ণের স্থানপরিবর্তন হয়েছে। এর কারণ জার্মানে 'যেড' বর্ণের ব্যবহার 'ওয়াই'-এর চেয়ে অনেক বেশি এবং সে কারণে এই বর্ণটিকে তর্জনীর নাগালের মধ্যে রাখতে হয়েছে। এর মানে জার্মান কিবোর্ডে বর্ণ সাজানোর সময় বর্ণের পৌনঃপুনিকতার কথা কমবেশি ভাবা হয়েছিল।

বাংলা এবং ইংরেজি ভাষা যেহেতু আলাদা, এর শব্দকোষ আলাদা, সুতরাং বাংলা বর্ণের পৌনঃপুনিকতা এবং ইংরেজি বর্ণের পৌনঃপুনিকতা কখনোই এক হতে পারে না। বাংলা 'ক' এবং ইংরেজি 'কে'-বর্ণের পৌনঃপুনিকতা এক রকম হওয়ার কথা নয়। সুতরাং ইংরেজি বর্ণের স্মৃতি থেকে বাংলা বর্ণ টাইপ করতে সময় বেশি লাগার কথা। তার উপর বাংলায় শীষ বর্ণ আছে তিনটি: শ, ষ, স। যেকোনো দুটি শীষ বর্ণকে যদি ইংরেজি 'এস' বর্ণ দিয়ে টাইপ করা হয়, তৃতীয় শীষ বর্ণটিকে একাধিক বর্ণ দিয়ে টাইপ করতেই হবে। এছাড়া মহাপ্রাণ বর্ণগুলোকে, যেমন, 'খ' বর্ণকে যদি 'কে+এইচ' টাইপ করে লিখতে হয়, তার মানে হচ্ছে, একটি বাংলা বর্ণের জন্যে দুটি চাবিতে চাপ দিতে হচ্ছে। এর পর 'জ্ঞান' শব্দটির কথা বিবেচনা করা যাক। তথাকথিত ফোনেটিক কিবোর্ডে কি 'গ'+ 'এ'+ 'য়'+'আ'+'ন'– এভাবে টাইপ করা হয়? 'বিজ্ঞান' শব্দটির যুক্তাক্ষর 'জ্ঞ' কি 'গ'+'গ' টাইপ করে লেখা হয়? যদি এভাবে টাইপ না করা হয়ে থাকে, তবে ফোনেটিক কিবোর্ড আদৌ ফোনেটিক নয়। বিজয়ে 'জ্ঞ' লেখা হয় বাংলা বানানের নিয়ম অনুসরণ করে: জ+ঞ।

রোমান বা আরবি বর্ণমালা এলোপাথারিভাবে সাজানো। বাংলা বর্ণমালায় স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ আলাদা, উচ্চারণ স্থান, উচ্চারণের প্রকৃতি অনুসারে সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো, কারণ ভাষাবিজ্ঞানে ভারতবর্ষ হাজার দুয়েক বছর আগেই চরম উন্নতি করেছিল। যাই হোক, ইংরেজি অ্যালফাবেট বা বাংলা বর্ণমালা ভাষার ধ্বনি/বর্ণগুলোকে সাজানোর একটা উপায় ছাড়া আর কিছুই নয়। কোয়ের্টিও ইংরেজি বর্ণমালাকে সাজানোর একটা উপায় মাত্র।

বড় আর ছোট হাতের মিলিয়ে ইংরেজিতে বর্ণ আছে ৫২টি, বাংলার মতোই। ফরাসি আর জার্মানে বর্ণের সংখ্যা জের-জবর মিলিয়ে কিছুটা বেশি। ফরাসি ও জার্মান নিজেদের ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক প্রকৃতি অনুসারে স্ব স্ব ভাষার অক্ষরদানিতে অক্ষর/বর্ণ সাজিয়েছে। ফরাসি ও জার্মানেরা কোয়ের্টিকেই নিজেদের অক্ষরদানিকে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করেছে। রাশিয়ানরাও ১৯১৭ সালের কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর নিজেদের সিরিলিক বর্ণ দিয়ে কোয়ের্টিকে সাজিয়েছে। কোয়ের্টি ব্যবহার করতে গিয়ে ফরাসি, রুশ বা জার্মানেরা ইংরেজি বা কোয়ের্টি বর্ণমালা দিয়ে ফরাসি বা জার্মান লিখছে– এমন দাবি হাস্যকর।

কম্পিউটার যন্ত্রটা মোস্তফা জব্বারের আবিষ্কার নয়। তিনি বা তার টিম এই যন্ত্রটা দিয়ে বাংলা লেখার একটা প্রোগ্রাম আবিষ্কার করেছেন। তিনি কোয়ের্টি কিবোর্ড ব্যবহার করেছেন, এর চেয়ে বড় কিবোর্ড বাংলার জন্যে প্রয়োজন হয়নি। মুনীর চৌধুরীও কোয়ের্টি কিবোর্ডই ব্যবহার করেছিলেন। কোয়ের্টির চেয়ে বেশি স্তরবিশিষ্ট কিবোর্ড বাংলার জন্য অপরিহার্য হলে, কম্পিউটারপূর্ব যুগের চীনা বা জাপানি কিবোর্ডের মতো কোনো অক্ষরদানী নিশ্চয়ই তাকে উদ্ভাবন করতেই হতো, বাংলা ভাষাই তাকে বাধ্য করত উদ্ভাবন করতে।

বিজয় প্রোগ্রাম বা কিবোর্ডের সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, কিন্তু এর বিকল্প এখনও কেউ বের করতে পারছেন না। করতে পারলে সেটা বাজারে আসত। অভ্রের ননফোনেটিক, বাংলা কিবোর্ডতো অনেক আগে থেকেই বাজারে আছে এবং লোকে চাইলে সেটা ব্যবহার করতেই পারে। মোস্তফা জব্বার বিজয় ছাড়া অন্য কোনো কিবোর্ডকে আসতে দিচ্ছেন না বলে অভিযোগ করতে পারেন অনেকে। কিন্তু প্রথমত, জানালা বন্ধ করলেই কি সূর্যোদয় বন্ধ হবে? দ্বিতীয়ত, কোয়ের্টি, আজের্টি ইত্যাদির একাধিক বিকল্পের প্রস্তাব করা সত্তেও সেগুলো চালু করা যায়নি ইংল্যান্ড-আমেরিকা-ফ্রান্স-বেলজিয়ামে স্রেফ ব্যবহারকারীদের অনিচ্ছার কারণে। জ্ঞান চিরকাল অভ্যাসের কাছে হেরে যায়। কানু বিনে গীত নাই। কোটি কোটি রেমিংটন-টাইপিস্টেরা কোয়ের্টি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো কিবোর্ড ব্যবহার করতে রাজি হয়নি, শ্রেফ অভ্যাস বদলাতে হবে বলে।

যদি প্রমাণ হয়, ধ্বনি/বর্ণের পৌনঃপুনিকতার বিচারে বিজয়ের অক্ষর-সজ্জা সঠিক নয়, তবে বাংলার জন্য অন্য অক্ষরদানীর প্রস্তাব করা হোক। আমি আর এই বয়সে নতুন কোনো অক্ষরদানী অভ্যাস করতে যাবো না, ঠিক যেমন করে ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের টাইপিস্টরা কোয়ের্টি ছাড়তে রাজি হননি। ব্যবসায়ী হিসেবে মোস্তফা জব্বারও আর সেই ঝুঁকি নিতে রাজি হবেন বলে মনে হয় না– কিবোর্ডের ইতিহাস অন্তত সেটাই বলে। কিন্তু চেষ্টা করতে দোষ কী? সেই চেষ্টা থেকে বিজয়ের দোষগুলো অন্তত বের হয়ে আসবে। ক্ষতিকর জেনে এবং না জেনে ধূমপানে অভ্যস্ত হবার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য নিশ্চয়ই আছে। মরবো সবাই, অন্তত জেনে মরবো যে কেন মরছি।

কোনো কোনো হণ্টন-প্রতিবন্ধীকে আজীবন ক্র্যাচ ব্যবহার করতে হয়। ক্র্যাচের অপরিহার্যতা এবং উপযোগিতা অনস্বীকার্য, কিন্তু ক্র্যাচ সুস্থ মানুষের সব সময়ের সমাধান হতে পারে না। যারা ইংরেজি পারেন, বাংলা টাইপ শিখবেন না বলে ধনুকভাঙা পণ করেছেন, যারা সব কাজ ফোকটে সারতে চান, সবকিছু সহজ চান, তারা ফোনেটিক/ইংরেজি কিবোর্ড দিয়ে বাংলা টাইপ করতে থাকুন, কে মানা করেছে? কিন্তু পৃথিবীর কোনো জাতি, একান্তই যদি মাথা খারাপ না হয়ে গিয়ে থাকে, নিজের ভাষাকে অন্য ভাষার ওপর নির্ভরশীল দেখতে চাইবে না। ফরাসি কিশোর যদি ফরাসিতে টাইপ শিখতে পারে, রুশ কিশোর যদি শিখতে পারে রুশ টাইপ, তবে বাঙালি কিশোর কেন বাংলা টাইপ শিখবে না। কেন তাকে আমরা ইংরেজির ওপর নির্ভরশীল করে পঙ্গু করে রাখব? ইংরেজি-নির্ভরতার এই ধারণাটাই আমার কাছে বাংলাভাষাবিরোধী, বাঙালি-বিরোধী, একুশ-বিরোধী বলে মনে হয়। বাঙালি কিশোর বাংলা লিখতে পারছে বলেই আহ্লাদে অষ্টখণ্ড হবার পক্ষে আমি নই। আমি জানতে চাই, সে বাংলা দিয়ে বাংলা লিখছে কিনা। আজকের কিশোরকে যদি বাংলা লেখার জন্যে ইংরেজির ওপর নির্ভরশীল হতে হয়, তবে সেটা হবে ইংরেজির জয় এবং বাংলার পরাজয়। যেকোনো পরাজয় জাতির জন্য দুঃখজনক হবারই কথা।

কেউ বলতে পারে, অনেকে বলছেও, ওসিআর, স্পিচ টু টেক্সট ইত্যাদি ডিভাইস চলে আসবে অচিরেই, সুতরাং এই সব কিবোর্ডের প্যঁচাল নিরর্থক। বিবর্তন হতে হতে প্রতিযোগিতায় যোগ্যতমেরাই যেভাবে টিকে যায়, প্রতিটি প্রযুক্তিকেও প্রতিযোগিতায় টিকতে হয়। টেলেক্স যে মাত্র কয়েক বছর এবং ফ্যাক্স কয়েক দশক মাত্র টিকবে, কেউ কি সেটা জানত? রেডিও এখনও টিকে আছে, যখন রেডিওর চেয়ে শতগুণ শক্তিশালী টেলিভিশন মৃত্যুযন্ত্রণায় ভুগছে। এমনও হতে পারে, আমরা যতটা ভাবছি, কিবোর্ড তার চেয়েও দীর্ঘজীবী হবে। কাল বিরিয়ানি খাবো, এই আশায় আজকে পান্তার সানকিটা কেন ছেঁদা করে দেবো?

ভিন্ন ভাষা দিয়ে টাইপ করা যদি লাভজনক হতো, তবে যে জাতিগুলো কম্পিউটার বা কিবোর্ড আবিষ্কার করার মতো বুদ্ধিমান ছিল, তারাই কি সেটা করত না। ফরাসি কিবোর্ড রাশিয়ায় ঐতিহ্যের অংশ ছিল, কিন্তু তবু কেন রুশরা ফরাসি দিয়ে টাইপ করেনি? আমরা 'শিবে ঝেবু' (আমার বড় মামার ভাষায় 'বেশি বুঝে') বাঙালিরা যাদের আবিষ্কারের মধ্যে আছে এক ভটভটি 'নসিমন', কেন আমরা ভাবছি যে রুশ বা জার্মানরা নয়, আমরাই সঠিক পথে আছি? ইংরেজি কিবোর্ড বাঙালি জাতির জীবনাচরণে যে বদভ্যাসের জন্ম দেবে, তার ফলে যে তার ভবিষ্যৎ ঝরঝরে না হয়ে, 'ঝড়ঝড়ে' ('ঝড়-বহুল) বা নড়বড়ে হয়ে যাবে না সেই নিশ্চয়তা কে দেবে?

থাই, আরবি, চীনা, জাপানি ভাষার নিজস্ব কিবোর্ড ছিল। কমপিউটার প্রযুক্তি আসার পর থাই এবং আরবিভাষীরা জাতীয় কিবোর্ড ব্যবহার করে, অনেকে আবার রোমান অক্ষর দিয়েও টাইপ করে। এর মধ্যে কোন কিবোর্ডটি জিতবে এবং টিকবে, সেটা সময়ই বলবে। চীনা এবং জাপানি ভাষার সমস্যা একটু আলাদা। হাজার ছয়েক কাঞ্জি বা হাঞ্জির মধ্যে হাজার দুয়েক বেছে নিয়ে তারা কিবোর্ড বানিয়েছিল বটে, কিন্তু সেই টাইপরাইটার ব্যবহার করা সহজ ছিল না। কমপিউটার প্রযুক্তি আসার পর চীনারা প্রথমে পিনইন বা চীনা উচ্চারণের প্রতিবর্ণীকৃত রোমান বর্ণ ব্যবহার করে শব্দটি লিখে কিবোর্ডে। চীনা ভাষায় তান বা টোনভেদে শব্দের অর্থ পাল্টে যায়, যেমন এক 'মা' শব্দেরই নাকি ৮০টি অর্থ হতে পারে। রোমান বর্ণে 'মা' লেখার পর স্ক্রিনে এই আশিটি কাঞ্জি ভেসে ওঠে এবং সেখান থেকে উপযুক্ত শব্দটি বেছে নিতে হয়। জাপানির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই, তবে রোমান বর্ণমালা ব্যবহার না করে তারা অক্ষরভিত্তিক বর্ণমালা হিরাগানা ব্যবহার করতে পারে। পর্দাতেও কাঞ্জি, হিরাগানা এবং (বিদেশি শব্দ হলে) কাতাকানা, তিন ভাবেই শব্দটি ভেসে উঠবে। বলা বাহুল্য, চীনা-জাপানি সবাই কোয়ের্টিই ব্যবহার করছে।

সব বিচার মানি, কিন্তু একটা তালগাছ আমি ছাড়তে পারব না কখনোই। ইংরেজি দিয়ে বাংলা টাইপ করাটা আমি কখনই মেনে নেবো না। 'যারে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা।' বিজয় যদি পছন্দ না হয়, মোস্তফা জব্বারের নাম শুনলে যদি রাগে কারও পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়, তবে অন্য কোনো বাংলা অক্ষরদানী ব্যবহার করুন, আবিষ্কার করুন উন্নততর কোনো অক্ষরদানী। কিন্তু শর্ত একটাই, বাংলা বর্ণ দিয়ে বাংলা টাইপ করতে হবে, ইংরেজি বর্ণ দিয়ে নয়। নিজের আঙ্গুলের ডগায় আমি বাংলা বর্ণের শিহরণ অনুভব করতে চাই। বাংলা বর্ণমালার ওপর কোনো প্রকার আঘাত, যত ঘুরিয়ে-ফিরিয়েই সেটা করা হোক না কেন, আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। মাতৃভাষাকে ভালোবাসে, এমন কেউই হয়তো ব্যাপারটা মেনে নেবে না।

বাংলা কিবোর্ডের প্রতি আমার এই পক্ষপাত কি ফাঁপা আবেগ এবং দেশপ্রেম-সঞ্জাত? দেশপ্রেমে কেউ বিশ্বাস না করতে পারে, কিন্তু মানবপ্রেম এবং গণপ্রেমে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ তো আমি দেখি না। কে না চায়, 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে'? এই দুধ-ভাত বা নিজের জনগণের উন্নয়ন চেয়েছিলেন বলেই ভাষার প্রশ্নে ৪৮-৫২ সালে বঙ্গবন্ধুসহ সকল ভাষাসংগ্রামী এতটুকু ছাড় দেননি। আবেগী না হলে পাকিস্তানি পুলিশের গুলির সামনে কেউ অকুতোভয়ে মিছিল করতে পারে না। ভাষাসংগ্রামীদের আবেগটা ছিল স্বজন ও দেশবাসীর প্রতি তাদের কর্তব্য ও ভালোবাসার বহিঃপ্র্রকাশ মাত্র।

হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি লোক অভ্র-ব্যবহার করছে, আমি জানি। তবুও একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও পেশাদার ভাষাতাত্ত্বিক হিসেবে শতভাগ বাংলা কিবোর্ডের পক্ষে নিজের মতটা প্রকাশ করলাম, একান্তই নিজের কর্তব্য মনে করে। একটা প্রেয়, আরেকটা শ্রেয়, কিন্তু প্রেয় মাত্রেই শ্রেয় নয়। কোনটা শ্রেয় এবং কেন শ্রেয় আমি যথাসাধ্য বুঝিয়ে বললাম।

ইংরেজি দিয়ে বাংলা লিখতে চাই না আমি কোনো আবেগের বশবর্তী হয়ে নয়, এই লিখন-অভ্যাসটা আখেরে বাঙালি জাতির জন্য ক্ষতিকর মনে করি বলে। 'আপনি আচরি ধর্ম পরকে শেখাবে।' আমি নিজে বাংলা টাইপ শিখেছি এবং অন্যকে শিখতে বলছি। যে আচরণ, যে অভ্যাস ক্ষতিকর, হাজার লোকে করছে বলেই, এমনকি আমি নিজেও যদি সেটা করি, রাতারাতি সেটা শুদ্ধ, কল্যাণকর হয়ে যাবে না। হাজার লোকে খেলেও ইয়াবার নেশাকে খারাপই বলতে হবে। বাচ্চা পছন্দ করে বলেই তাকে আমরা ফিডারে করে কোকাকোলা খাওয়াবো না। তাকে আমরা দুধ খাওয়াবো, কারণ আমরা বিশ্বাস করি, শিশুর স্বাস্থ্যের জন্যে কোকের চেয়ে দুধ ভালো।