যেই দিনটা একদিন আসবেই…

অস্থির ব্যাকটেরিয়া
Published : 7 May 2012, 06:19 PM
Updated : 7 May 2012, 06:19 PM

আজ খুব সকালে ঘুম ভাঙল আমার। সকাল ৮ টায় একটা ক্লাস আছে। সকাল ৮ টার ক্লাস সাধারণত আমি করি না। কিন্তু আজ কেন যেন মনে হচ্ছে আজ একটা অন্যরকম দিন। যাই হোক, সকালে উঠেই মুখে ব্রাশ ঢুকিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম গোসল করার জন্য। ঢুকেই যে জিনিসটা দেখে খুব অবাক হলাম তা হল কলে পানি আছে। গত চারদিন ধরে তো এলাকাতেই পানি নাই। বুঝলাম না কিছু।

বের হলাম বাসা থেকে। রিকশাওয়ালাকে ডাকতেই বেশ খুশি খুশি চেহারা নিয়ে এগিয়ে আসলো। যেই নাবিস্কো মোড় পর্যন্ত আমি যাবো, এখান থেকে তার ভাড়া ১০ টাকা। অথচ দিতে হয় ২০ টাকা। জিনিসপাতির দাম যা বাড়ছে, তাতে এই গরিব রিকশাওয়ালাদের দোষ দিয়ে ফায়দা কি!

রিকশা থেকে নেমে ২০ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিতেই রিকশাওয়ালা ১০ টাকা ফেরত দিল। কাহিনী কি!
আমিঃ ১০ টাকা ফেরত দিলেন কেন?
রিকশাওয়ালাঃ ভাড়া তো ১০ ট্যাহাই। বেশি নিমু ক্যান? জিনিসপাতির দাম তো আর আগের মতোন নাই ভাইজান। স্লামালেকুম।
স্ট্যাচু অব লিবার্টির মূর্তিরূপ ধারণ করলাম। জিনিসপাতির দাম আগের মতন নাই! মানে কি!

বলাকা বাস ধরতে হবে এখন। আমার মতো মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানদের ভরসাই এই লোকাল বাস। এমনিতেই ভাড়া কম, দেই আরও কম, হাফ-পাশ আর কি!কিন্তু কাহিনী কি! একটা বাসও থামছে না। সবগুলোর গেট লক! পকেটে আছে ২৪০ টাকা। এই টাকা দিয়ে সিএনজি তে উঠলে আর বাসায় আসা লাগবে না,ক্যাম্পাসেই রাত্রি যাপন করতে হবে। সিএনজি এর দিকে এখন তাকাতেই এখন ১০০ টাকা লাগে। উঠলে মানিব্যাগ দিয়ে নেমে আসতে হয়। আমরা যেমন শো-পিস কিনে শোকেস সাজাই,এই সিএনজি ড্রাইভারগুলো তেমনি মিটার দিয়ে সিএনজি'র ইনটেরিওর ডিজাইন করে।
সিএনজি ড্রাইভারঃ কোথায় যাবেন?
আমিঃ মৌচাক যাবো।কতো?
-কতো মানে?
-ভাড়া কতো?
-মিটারের লাল বাত্তি জ্বলজ্বল করতাছে,দেখতেছেন?

সিএনজি তে গালে হাত দিয়ে বসে আছি। এতক্ষণ যা যা ঘটলো, তা নিয়ে ভাবতেছি তা না! যেই কারণে আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে সেই কারণটা হল……রাস্তায় কোন জ্যাম নাই!
আমিঃ আচ্ছা ভাই, লোকাল বাসের গেট বন্ধ কেন?
সিএনজি ড্রাইভারঃ সব বাস আইজকা থাইকা কাউনটার কইরা ফালাইছে, জানেন না? আর আপনে যেইহানে দাড়ায় আছিলেন, অইখানে আর বাস থামবো না। তাইলে গাড়ির কেস হইয়া যাইব।
-ও।
মগবাজারের রেললাইন ক্রসিং এ সিএনজি টা থামল। সকালে ভার্সিটি তে যাবার সময় ২ টাকা দিয়ে একটা "আমাদের সময়" পত্রিকা আমি সবসময়ই কিনি। আশেপাশে তাকালাম হকারের প্রত্যাশায়। অবশেষে পেলাম। মধ্যবয়সী একটা লোক। কাহিনী কি! পিচ্চিগুলা গেলো কই! আমি ২ টাকা বাড়িয়ে দিতেই লোকটা আমার হাতে পত্রিকাটা দিল।
-স্যার, আমার পুলাটারে ইসকুলে দিসি। দোয়া কইরেন। অহন ও আর প্যাপার বিক্রি করে না, প্যাপার পড়ে। স্লামালেকুম।
পত্রিকাটা হাতে নিয়ে ১ মিনিট বসে থাকলাম। আমি কই আছি, বুঝতেছি না। একটা পুলিশ সার্জেন্ট এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,
-কোন সমস্যা হচ্ছে নাতো স্যার?
-কি সমস্যা হবে?
-কোন অভিযোগ?
-না।
-আপনার ভ্রমণ শুভ হোক।
পকেট থেকে রুমালটা বের করে ঘাম মুছলাম। পত্রিকাটা খুলেই আক্কেল গুড়ুম হবার মতো অবস্থা!

"অভিযোগ বাক্সে কোন অভিযোগপত্র আজও জমা পড়েনি"
"বিরোধীদল সরকারের কোন দোষই খুঁজে পাচ্ছে না। এই সরকারের প্রতি জনগণ সন্তুষ্ট।– খালেদা জিয়া"
"আমরা নির্বাচনে যে প্রতিজ্ঞাগুলো করেছিলাম, তা বাস্তবায়ন করতে বিরোধীদলের সহায়তা আমাদের কাজকে আরও সহজ করে তুলছে-শেখ হাসিনা"
"ইতিহাসের এই দিনে- বিরোধীদল হরতাল ডেকেছিল"

পত্রিকাটা উলটানোর আর সাহস পেলাম না! ব্যাগে ভরে রাখলাম।

খুব দ্রুতই ভার্সিটিতে এসে পৌঁছলাম। সবগুলো ক্লাস ঠিকমতো হয়ে গেলো। ক্যান্টিনে পেপসি, কোকাকোলার বদলে ইউরো-কোলা, মোজো শোভা পাচ্ছে। বাসায় আসার সময় লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কিনে লোকাল বাসে উঠে বসলাম(!)। একটা টেলিটক নাম্বার থেকে আমার সেলে একটা ফোন আসলো।
-হ্যালো! কে?
-দস্ত,আমি মৃদুল।
-টেলিটক নাম্বার?
-দুর্দান্ত নেটওয়ার্ক বন্ধু। সজিব,শোভন,তানভীর,আমি সবটি মিল্লা এখন থেইকা টেলিটক ব্যবহার করমু। দেশের টাকা দেশে রাখতে হইব না??? সবাই-ই কিনছি। যাক গিয়া, মনটা খারাপ,তাই ফোন দিসি তোরে।
-মন খারাপ ক্যান? আবার পুরান গালফ্রেন্ডের কথা মনে পড়ছে তোর?
-আরে নাহ! ডিএকটিভেট করা ফেসবুক অ্যাকাউন্টটার কথা মনে পরতেসে।
ফেসবুক অ্যাকাউন্টটা থেকে ও কেন বের হয়ে গেছে তা আর ওকে জিজ্ঞেস করলাম না। এটাই এখন স্বাভাবিক মনে হচ্ছে।

ঢাকা শহরটা পুরোই অপরিচিত লাগছে। রাস্তায় রাস্তায় প্লাস্টিকের ডাস্টবিন। গার্লস স্কুলের মেয়েরা হাসতে হাসতে একা একা বাসায় যাচ্ছে। আজ তাদের সাথে তাদের অভিভাবক নেই।
বাসায় ঢুকেই দেখলাম ছোট্ট বোনটা টিভি দেখছে। এখন স্টার প্লাসে ওর সিরিয়াল দেখার সময়। কিন্তু সে বিটিভি ছেড়ে বসে আছে। অবাক হলাম না। অবাক হবার ক্ষমতা সারাদিনে আমার ধ্বংস হয়ে গেছে। জানি, আজ কারেন্টও যাবে না। আজ অন্যরকম একটা দিন।
রাতে খেয়ে ঘুমাতে গেলাম। সারাদিনের কথা ভাবতে ভাবতে একটা সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ঘুম ভাঙল একটা বন্ধুর ফোনে। জিপি নাম্বার।
মৃদুল-কিরে, কই তুই? এখনো ঘুমাস? ক্লাসে আসবি না? আজকে ৮ টায় ক্লাস,ভুলে গেছিস?
চটজলদি বাথরুমে ঢুকলাম।

কলে পানি নাই!