নারী স্বাধীনতা ও শিক্ষানীতিঃ যে আলো দেখা যায় না

রাত্রিশেষ
Published : 25 Dec 2012, 11:12 AM
Updated : 25 Dec 2012, 11:12 AM

মিতু মন খারাপ করে বসে আছে জানালার পাশে। পাশের রুমের টেলিভিশনে কোন নারীবাদী সংগঠনের নেত্রী চেচাচ্ছে সমঅধিকারের দাবী তুলে। মিতুর মেজাজটা যেন আরেকটু বিগড়ে য়ায় – শুধু সমঅধিকার কি পারে নারী স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে?? সমাজে "নারীর সম্মান" নারী স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অথচ নারীর সম্মান নিয়ে নারীবাদী সংগঠনের নেত্রীরা এমন নির্বিকার যেন "ইজ্জত তো অনেক আগেই গেছে, বেইজ্জতটাও বাকী নাই"। মিতু নিজেই ভাবে, আজ তো সে বেশ গুছিয়ে চিন্তা করতে পারছে! নারীর অধিকার-সম্মান নিয়ে এর আগে সে তো এমন করে ভাবে নি কখনো। আজ তার মন খারাপের মূল কারণ কি তবে অধিকার নয় অসম্মান?

মিতু রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্রী। আধুনিক, রুচিসম্মত, গতিশীল ও বুদ্ধিমতী। রনির সাথে পরিচয় মাসখানেক আগে, যদিও সে মিতুর সাথেই পড়ে। রনি শান্ত, ভদ্র, বিনয়ী ও মেধাবী। রনির একটা নোটের বেশ প্রসংশা করেছিল ম্যাডাম। মিতু নিজের প্রয়োজনেই নোটটা চেয়েছিল রনির কাছে। তখনই মূলত আনুষ্ঠানিক পরিচয়। নোট চাওয়ায় রনি একটুও বিরক্তি দেখায় নি। বরং বেশ আহ্লাদি সুরেই অনেক খোঁজখবর নিয়েছে। খাতির-যত্নও দেখাল বেশ। সেদিন বিকেলেই নিজে ফটোষ্ট্যাট করে বাসায় পৌছে দিতেও ক্লান্তি বোধ করে নি এতটুকু! যদিও এমন কথাও ছিল না; মিতু নিজেও আশা করে নি আর কোন প্রয়োজনও ছিল না। তবু ছেলেটির উদারতায় মিতু মুগ্ধই হয়েছিল, মনের কোণে জেগে উঠেছিল একটু প্রশান্তি, রনির প্রতি শ্রদ্ধাভাব আর তার আদর্শের প্রতি সম্মান। কিন্তু অচিরেই মিতু সম্বিৎ ফিরে পেল। সে আবিষ্কার করল, রনি তার কাছে যেন প্রতিদান চাইছে!! আজ কথা বলার সময় রনির কণ্ঠে বন্ধুসুলভ আন্তরিকতা ছিল না; বরং ছিল করুণা করার স্পষ্ট অহমিকা আর ঔদ্ধ্যত্ব। মিতু তো করুণা চায় নি। মিতুর হঠাৎ জানতে ইচ্ছে করে, রনি অন্য যেসব ছেলে মেয়েকে নোট দিয়েছে তাদের সবার কাছেই কি প্রতিদান আশা করে? রনি কি প্রতিদান চায় মিতু তা বোঝে। মিতু তন্ময় হয়ে ভাবে, সমাজে সবাই যদি এভাবে "অসম প্রতিদান" আশা করে, তবে আগামীতে মিতুরা কি সামাজিক সহায়তার আশা করতে পারে? কে রনিদের "অসম প্রতিদান" আশা করতে শেখায় অথবা সাহস যোগায়? কোলের কাছে রাখা মোবাইলটা বেজে ওঠে। মোবাইল স্ক্রীনে ভেসে ওঠে শান্তার নাম্বার। শান্তা ওর সাথেই পড়ে।

রিসিভ করার সাথে সাথে শোনা যায় শান্তার চিকন মোলায়েম কণ্ঠ – কাইফা হালুকা, ইয়া হাবীবা?
– মোটামুটি। তোর কথা বল?
– ভালো। কিরে ভদ্রতা কি ভুলে গেছিস? প্রশ্নকর্তা যে ভাষায় প্রশ্ন করে সেই ভাষায় উত্তর দেওয়াটা ভদ্রতা,তাই না?
– তা ঠিক। সালাম-শফিকদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না।
– সালাম-শফিকদের রক্ত তো আর বিদেশী ভাষা শিখতে মানা করেনি। তাছাড়া পরকালে হিসেবটা যে আরবীতে দিতে হবে, বিশ্বাস করিস তো?
– ভালো কথা বলেছিস তো! প্রশ্নই তো বুঝব না, উত্তর দেব কি?
– কবরে প্রথম প্রশ্ন করবে, "মান রাব্বুকা"। তুই বলবি, আমার মায়ের নাম হাসিনা বেগম (হা হা হা হা হা)।
মিতু প্রসঙ্গ পাল্টায়। – রনির নোট নিয়েছিস?
– না। বাজার থেকে কিনেছি। শুনলাম, তুই নাকি নিয়েছিস।
– হ্যাঁ। তুই-ই ভালো করেছিস।
– বুঝেছি, "জেন্টলম্যান এগ্রিমেন্ট" কেস।
– মানে?
– "জেন্টলম্যান এগ্রিমেন্ট" মানে গিভ এন্ড টেক। তুমি কাউকে কিছু দিবা বিনিময়ে তার কাছ থেকে কিছু নিবা। "জেন্টলম্যান এগ্রিমেন্ট" অনুসারে, রনি তোমাকে দেওয়া নোটের বিনিময়ে "অসম প্রতিদান" দাবী করছে। আর তোমার অবস্থা দাদন ঋণ গ্রহীতার মত। এসব নিয়ে মন খারাপ করিস না, স্রেফ মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল আর শিক্ষা নে।
– "জেন্টলম্যান এগ্রিমেন্ট" যারা মেনে চলে, তারা কি জেন্টলম্যান?
– কাকে বলবি! সবাই তো এই দলে।

– (অনুযোগের সুরে) তাহলে নারী স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে কিভাবে? সমঅধিকার কি বাস্তবায়ন করা সম্ভব পারস্পরিক সহায়তা ছাড়া? – অবশ্যই না। এভাবেই মেয়েরা প্রতিদিন অপমানিত হতে থাকবে, তাদের মানসিক নির্যাতনের কথা কোথাও প্রকাশিত হবে না। অচিরেই এর মাত্রা আরো বাড়বে। কারণ নারীবাদী আন্দোলনের নেত্রীরা পশ্চিমা প্রকল্পের টাকা কোমরে গুজতে শুধু মেয়েদের ঘরের বাইরে আনতে ব্যস্ত, কিন্তু তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোনো পদক্ষেপ তারা নিচ্ছে না। মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবশ্যই "পুরুষের চেয়ে মেয়েরা অধিক সম্মানী" মর্মে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে তুলতে হবে, যেমনটা বলা হয়েছে ইসলামে, "তোমার পিতার চেয়ে মাতার মর্যাদা তিনগুন বেশী"। অন্যথায় ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, ইভটিজিং মহামারী আকার ধারণ করবে।

– রনিদের "অসম প্রতিদান" প্রত্যাশা সৃষ্টির জন্য কে দায়ী?
– অবশ্যই শিক্ষানীতি। সমাজের ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী ভিন্ন ভিন্ন উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গী নিঃসন্দেহে শিক্ষানীতি দ্বারাই সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত হয়। আর তুমি হয়ত আমার সাথে একমত হবে, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের "অসম প্রতিদান" প্রত্যাশার দৃষ্টিভঙ্গীই নারী স্বাধীনতা নিশ্চিত ও সমঅধিকার বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। কেননা এটা তরুণ ছেলে-মেয়েদের মুখোমুখি দাড় করিয়ে দিচ্ছে আর তাদের মধ্যে জম্ম দিচ্ছে পারস্পরিক সন্দেহ আর অবিশ্বাস – যা থেকে বেরিয়ে আসতে জাতিকে কয়েক শতাব্দীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা লাগতে পারে; অথবা হয়তো কখনোই বেরুতে পারবে না।
– শিক্ষানীতির কি ধরণের সংস্কার "প্রতিদান-নিরপেক্ষ সামাজিক সহায়তা"র পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে – যা নারী স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে অপরিহার্য?
– মোতাহার হোসেন চৌধুরী বলেছেন, "শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য জ্ঞান পরিবেশন নয়, মূল্যবোধ সৃষ্টি করা।" সুতরাং নিশ্চিতভাবেই "পুরুষের চেয়ে মেয়েরা অধিক সম্মানী" ও "প্রতিদান-নিরপেক্ষ সামাজিক সহায়তা"র পরিবেশ সৃষ্টিতে শিক্ষানীতিই আমাদের প্রধান হাতিয়ার। এমন পরিবেশ সৃষ্টির কেবলমাত্র একটি উপায় রয়েছে, তা হলো – শিক্ষানীতিতে ধর্মীয় বিষয়সমূহের সর্ব্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে ব্যাপক অর্ন্তভুক্তি এবং তা হতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্ব্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত । ধরা যাক, ইসলামের কথাই; ইসলাম শুধু প্রতিদান-নিরপেক্ষ সামাজিক সহায়তার নির্দেশই দেয় নি, একই সাথে সহায়তা গ্রহীতার নিকট থেকে প্রতিদান প্রত্যাশার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। আমার জানামতে, কোন ধর্মই এর ব্যতিক্রম শিক্ষা দেয় নি। সুতরাং শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ সৃষ্টিতে স্ব স্ব ধর্মীয় মৌলিক জ্ঞানসমূহকে কাজে লাগাতে হবে। আর তা সম্ভব বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্ব্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত ধর্মীয় বিষয়সমূহের ব্যাপক অর্ন্তভুক্তির মাধ্যমে।
– বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, তিনি একটি আধুনিক, যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে পেরে গর্বিত। আমরা কি এই শিক্ষানীতি নিয়ে আশাবাদী হতে পারি না?
– মানবতার আশাবাদী হওয়ার মত কিছু আমি দেখছি না, তবে হতাশ হওয়ার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ আছে। নারী স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী গঠনে এই শিক্ষানীতির বিশেষত্ব কি? শিক্ষানীতির চূড়ান্ত খসড়ার ভূমিকায় বলা হয়েছে, "বাংলাদেশের কর্মক্ষম সাধারণ মানুষের অনেকেই উপার্জনের আশায় বিদেশে যেতে চায়। এদের প্রয়োজন শিক্ষার এবং আর্ন্তজাতিক ক্ষেত্রে চাহিদা রয়েছে এমন দক্ষতা অর্জনের। এই শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে এসবই বিবেচনা করা হয়েছে।" ভাষা মানুষের ভাব আদান-প্রদানের প্রধান মাধ্যম – যা যেকোন মানুষের স্বাভাবিক কর্মনৈপূণ্য প্রদর্শনের প্রধান পূর্বশর্ত। বাংলাদেশের মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে কর্মস্থল হিসেবে বেছে নেয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহকে – যাদের রাষ্ট্রভাষা আরবী। তাহলে শিক্ষানীতিতে আরবী ভাষা শিখতে উৎসাহিত করার পরিবর্তে অনুৎসাহিত করা হচ্ছে কেন? তবে হ্যাঁ, শিক্ষামন্ত্রীর গর্বিত হওয়ারও যৌক্তিক কারণ আছে। বামপন্থী রাজনীতিকরা আদর্শিকভাবেই সব ধর্মের বিরুদ্ধে। একজন সাবেক বামপন্থী ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে পেরে গর্বিত হবেন – এটাই স্বাভাবিক। কারণ বামপন্থী রাজনীতি ব্যাপকভাবে চর্চার জন্য ধর্মহীন জাতি অন্যতম প্রধান পূর্বশর্ত। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু বামপন্থীদের দমনে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন; অথচ তার তনয়া তাদেরকে নৌকার মাস্তুলে বসিয়ে বৈঠা হাতে দিতে কার্পণ্য করেনি……

লাইনটা এসময় হঠাৎ কেটে যায়। মিতু আবার ভাবনায় ডুবে যায়। তবে কি আমরা গভীর অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি না? মিতু তবু অপেক্ষায় থাকে একটা আলোর। সে স্পষ্ট অনুভব করে, এ আলো তার নিজের ভিতরেই আছে; হয়তো সবার ভিতরেই আছে। তবু দেখা যায় না। সবাই যেন সযতনে এ আলো লুকিয়ে রাখছে!! তবে অচিরেই এ আলো প্রকাশিত হবে – আলোকিত করবে সবকিছু।