কিস্তি ৩ছফামৃত

আফসান চৌধুরীআফসান চৌধুরী
Published : 13 Oct 2009, 04:20 AM
Updated : 13 Oct 2009, 04:20 AM

(কিস্তি ২-এর পর)


ছফা ও আহমদ শরীফ


ছফা আর নরেন বিশ্বাস, ১৯৭৫

এরপর প্রাইমারি স্কুলে থাকা অবস্থায় ছফা কাকা আর কোনো কবিতা লিখেছেন কিনা জানা যায়নি। তিনি তাঁর বাবার প্রতিষ্ঠিত স্কুলে প্রাইমারি শেষ করেছিলেন। প্রাইমারি পাশ করে তিনি একই গ্রামের গাছবাড়িয়া নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। সময়টি বোধকরি ঊনিশ শ' একান্ন সাল ছিল। এ স্কুলে পড়তে গিয়ে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। এখানে কতিপয় শিক্ষক তাঁর ওপর প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁদের সান্নিধ্যে এসে তিনি মনে-প্রাণে একজন পাকা মানুষে পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন:

"আমি যখন হাই স্কুলে আসি একসঙ্গে চারজন সাহিত্যপ্রেমিক শিক্ষকের স্নেহ আকর্ষণ করতে সক্ষম হই। তার প্রথম জন হলেন শিবশঙ্কর তালুকদার, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে তৎসম শব্দের মিশেল দিয়ে এক ধরনের বাংলা কথাবার্তা তিনি বলতেন। শিববাবু সম্পর্কে আমার অন্য রচনায় কিছু কথাবার্তা বলেছি। তিনি আমাকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি নবীনচন্দ্র সেন এবং কবি কায়কোবাদ এঁদের রচনা খুব যত্নসহকারে পাঠ করতে বাধ্য করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর এক ধরনের অবজ্ঞার ভাব ছিল। তিনি মনে করতেন, যাঁর রচনা পড়ামাত্রই মানুষ বুঝে যায় তাঁর মধ্যে কবিত্ব কোথায় থাকে। তিনি আরও মনে করতেন, যে কবি ভালভাবে অমিত্রাক্ষর ছন্দে কবিতা রচনা করতে পারেন তিনিই আসল কবি। আর সবাই ফালতু। শিববাবুর পাল্লায় পড়ে আমি অমিত্রাক্ষর ছন্দের কসরৎ করে যাচ্ছিলাম। সে সময় অনেক কবিতা লিখেছি, লেখাগুলো কোথায় গেছে আল্লাহ গায়েবুল মালেক মালুম। যা হোক, সে সময়ের অমিত্রাক্ষর ছন্দের রচনার কিছু অংশ এখনও আমার মনে আছে। ওই কবিতাটি শিববাবুর অনুপ্রেরণায় মাইকেল মধুসূদনকে নিয়ে লিখতে হয়েছিল। স্মৃতিতে যেটুকু ধৃত আছে উদ্ধৃত করার চেষ্টা করছি:
'হে বঙ্গকবিকূল চূড়া শ্রী মধুসূদন
তোমার যাওয়ার পথে বায়ু সমবেগে
আমিও বাসনা করি যেতে। কিন্তু সদা ভয় জাগে
যদি যায় সঙ্কল্প টলিয়া, পারিপার্শ্বিক পৃথিবীর চাপে,
যেমতি নদী এসে বাধা পড়ে শিলাময় পাহাড়ের ধারে
যদি কোনমতে তারে বারেক টলাতে নারে–
হয় প্রবাহিত ভূ-গর্ভের নিরপেক্ষ স্তরে।'

এই 'নিরপেক্ষ স্তর' শব্দটা দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছিলাম এখন ঠিক মনে পড়ছে না।

শিববাবুর কথা তো বললাম। এখন মাওলানা আবু সৈয়দ সাহেবের কথা বলি। তিনি ছিলেন একহারা চেহারার মানুষ। মুখে সামান্য দাড়ি এবং মাথায় কিস্তিটুপি ছাড়া তাঁর মধ্যে মাওলানাসুলভ বেশভূষার বিশেষ আড়ম্বর ছিল না। তিনি ছিলেন অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। আমাদের স্কুলের হেডমাস্টার মশাই পর্যন্ত তাঁকে সমীহ করে চলতেন। আবু সৈয়দ সাহেব একটা সময় জেনে গিয়েছিলেন যে, আমি কবিতা লেখালেখি করছি। তিনি হোস্টেলে থাকতেন। একদিন স্কুল ছুটির পর আমাকে তাঁর ঘরে ডেকে নিয়ে বললেন, তোমাকে আমি টাইটেল দিলাম লিটল কায়কোবাদ। ইসলামি বিষয়ে লিখবে। সৈয়দ সাহেবের অনুপ্রেরণায় সে সময় আমি একটা ইসলামি গান লিখেছিলাম। তার কয়েক পঙ্ক্তি এখনও মনে আছে:

'সেই তৌহিদের জোরে আল্লাহ
যার আমানত তোমার কাছে জমা
কাঙালেরে দেখাইও তোমার
মক্কা-মোয়াজ্জমা
স্বপ্নে দেখি ওই দূরে ওই মক্কারও প্রাণ [প্রান্তর]
সেখানে চড়াইতেন ছাগল আমার দ্বীনের পয়গম্বর।'

আমাদের স্কুলের এ্যাসিসট্যান্ট হেড মাস্টারের নাম ছিল মৌলভি মুহম্মদ এছহাক। তাঁর বাড়ি ছিল সাতকানিয়ার পুরানগর গ্রামে। তিনিও হোস্টেলে সপ্তাহে পাঁচদিন থাকতেন। এছহাক সাহেব গোপনে কবিতা লিখতেন। এ ধরনের গুরুগম্ভীর মানুষ কবিতা লিখেন, এটাকে গোপন ব্যাধির মত অন্য সবার কাছে লুকিয়ে রাখতেন। একদিন এছহাক সাহেব আমাকে তাঁর ঘরে ডেকে নিলেন এবং তোষকের নিচ থেকে একটা ঢাউশ খাতা টেনে বের করলেন। আমাকে বললেন, দেখ, পড়–এগুলো আমার কবিতা। অন্য কাউকে বলবে না। আমি দেখি কবিতার বন। পুরো খাতাটি শেষ করতে আমার এক সপ্তাহ লেগে যায়। আমি আর এছহাক স্যার অনেক সময় প্রতিযোগিতা করে লিখতাম। তিনি একটা লিখলে আমাকে একটা লিখতে হত।

এছহাক স্যারের কথা থাকুক। শারদাবাবুর কথায় আসি। শারদাবাবুর সম্পর্কেও আমি কিছু লিখেছি। তাঁর মাথা জুড়ে ছিল চকচকে টাকা। কণ্ঠস্বর ছিল স্নিগ্ধ, শান্ত। ক্লাসে কোনো ছাত্রকে শাস্তি দিতে কেউ তাঁকে দেখেনি। তিনি আমাদের ভূগোল ও ইতিহাস পড়াতেন। ক্লাসে এসে তিনি পরমাত্মা বিষয়ে কথাবার্তা বলতেন। ধ্যান করলে অনেক অজানা বিষয় জানা যায়–সে ব্যাপারে আমাদের উৎসাহী করতে চেষ্টা করতেন। শাক-সবজির উৎপাদনের দিকে ছিল তাঁর বিশেষ ঝোঁক। বাড়িতে গরু-বাছুর পুষতেন এবং জমিজমা চাষ করতেন। শারদাবাবু আমাকে অসম্ভব পছন্দ করতেন। মজার কথা হল প্রতি বছর রুটিন করে শারদাবাবু চার মাস পাগল হয়ে যেতেন। আমার যে গাছপালার প্রতি ঝোঁক, এটা যেমন শারদাবাবুর কাছে পেয়েছি, তেমনি পাগলামোরও কিছু অংশ গুরুপ্রদত্ত সম্পদ হিসেবে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছি।" (ছফা, খ. ৩, পৃ. ২৩৫)

শারদাবাবু সম্পর্কে ছফা কাকার পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ গ্রন্থে উল্লেখ পাওয়া যায় :

"আমি শারদাবাবুর ভীষণ ন্যাওটা হয়ে পড়েছিলাম। তাঁর কথা শুনতে আমার খুব ভাল লাগত। ছুটির দিনে তাঁর বাড়িতে চলে যেতাম। তাঁর স্ত্রী আমাকে কাঁসার বাটিতে করে ফেনা ওঠা গরম দুধ খেতে দিতেন। কোনোদিন দুধের সঙ্গে থাকত খই, কোনোদিন মুড়ি। শারদাবাবু যখন ক্ষেতে যেতেন আমিও সঙ্গে যেতাম। তাঁর সঙ্গে ক্ষেতের আগাছা নিড়াতাম। সার, মাটির ঝুড়ি মজুরদের সঙ্গে ক্ষেত অবধি বয়ে নিয়ে যেতাম। …যখন তাঁর সঙ্গে একা থাকতাম তিনি আমাকে প্রায়ই বলতেন গাছের সঙ্গে কথা বলার কৌশলটা তিনি আমাকে শিখিয়ে দেবেন। গাছেরা সব মানুষের ডাকে সাড়া দেয় না। আবার সব মানুষ গাছদের ভাষাও বুঝতে পারে না। মনের বিশেষ ধরনের শুদ্ধতা না থাকলে গাছের ভাষা বোঝার ক্ষমতা মানুষের জন্মায় না। শারদাবাবু মনে করতেন, গাছের সঙ্গে কথা বলার ক্ষমতা আমার আছে, তবে বিকাশ লাভ করেনি। তিনি আমাকে পরামর্শ দিতেন, তিনি যখন গাছপালার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন আমি যেন তাঁর সঙ্গে থাকি। এক সময়ে আমিও কথা বলতে পারব। কিন্তু আমি সাহস করতে পারতাম না। কারণ একটাই, ওই পাগল হয়ে যাওয়ার ভয়। বৃক্ষ বিষয়ে যে অনুভব শক্তি এবং অন্তর্দৃষ্টি আমার জন্মেছে তার পেছনে শারদাবাবুর প্রভাবই অনেকখানি দায়ী।" (ছফা, খ. ২, পৃ. ৫৯)

হাই স্কুলে পড়ার সময় আরেকজন শিক্ষকের সান্নিধ্য ছফা কাকা লাভ করেছিলেন, তিনি হলেন ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্রী বিনোদবিহারী দত্ত। ছফা কাকা কবুল করেছেন এ শিক্ষক মশাইয়ের ছায়া তাঁর জীবনে নানাভাবে পড়েছে। তিনি লিখেছেন:

"আমি যখন নবম শ্রেণীতে পড়ি আমার বাবা আমাকে হিন্দু হোস্টেলে থাকতে পাঠালেন। আমাদের স্কুলে বড়সড় মুসলিম হোস্টেল ছিল। আমার বেলায় অনেকটা প্রচলিত প্রথা লঙ্ঘন করে তিনি হিন্দু হোস্টেল বেছে নিলেন। তার পেছনে একটা কারণ ছিল–আমাদের স্কুলের হেড মাস্টার শ্রী বিনোদবিহারী দত্ত ছিলেন একজন অসাধারণ শিক্ষক। তিনি হিন্দু হোস্টেলে থাকতেন। ছাত্রদের স্বভাব-চরিত্র সুন্দরভাবে গঠন করার ব্যাপারে খুব দৃষ্টি দিতেন। একই কারণে আমাকে হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে বাস করতে হিন্দু হোস্টেলে যেতে হল। সকালে ঘুম থেকে উঠে অন্য হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে সকালের পড়াশোনা শুরু করার সময় সরস্বতী স্তুতি পাঠ করতাম। এখনও ভোলা সম্ভব হয়নি–
'আঁধারনাশিনী। জাগো হৃদি মাঝে
প্রণমি চরণে দেবীশ্বেতভুজে
বীণারঞ্জিত পুষ্প হস্তে
ভগবতী ভারতী দেবী নমস্তে।'

বিনোদবাবুর কাছ থেকে আমি তিনটি জিনিস শিখেছি।

প্রথমত, তিনি আমাকে খুব সকালবেলা–একেবারে ব্রাহ্মমুহূর্তে শয্যাত্যাগ করিয়ে এক মাইল হেঁটে আসার অভ্যাস করিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, হিন্দু হোস্টেলে যাওয়ার আগে আমি খুব মিথ্যা কথা বলতাম। বিনোদবাবু ধৈর্য ধরে কখনও আমাকে বুঝিয়ে, কখনও শাস্তি দিয়ে মিথ্যাকে ঘৃণা করতে শিখিয়েছিলেন। তৃতীয়ত, বিনোদবাবু ছিলেন কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন মানুষ। কথাটি ঠিক বললাম কিনা একটু সন্দেহ আছে। তবে আমাদের অঞ্চলের নামকরা কমিউনিস্ট নেতা সুধাংশু বিমল দত্ত বিনোদবাবুর কাছে আসা-যাওয়া করতেন। সুধাংশুবাবুর সঙ্গে আমাদের হেড মাস্টার মশাই শোষণ, শ্রমিক, কৃষক, বিপ্লব, সোভিয়েত রাশিয়া, লেলিন-স্টালিন নিয়ে কথাবার্তা বলতেন। আমি চুপ করে তাঁদের কথা শুনতাম। একদিন সুধাংশুবাবু তাঁদের কথাবার্তার প্রতি আমার ঐকান্তিক আগ্রহ লক্ষ্য করে কিছু পুস্তিকা এবং পত্রিকা আমাকে পড়তে দেন। সে সময়ে গ্রামের কৃষকদের দুঃখ-দুর্দশার অন্ত নেই। এই সুধাংশুবাবুর প্রেরণায় আমি কৃষক সমিতির কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি। কৃষক সমিতির সাংগঠনিক কাজকর্মে অধিক সময় ব্যয় করার কারণে লেখালেখির অভ্যাসটা আমি একেবারেই ভুলে যাই। সে সময় আমার সংকল্প ছিল আমার কাজ লেখালেখি নয়, কৃষক সমাজের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার জন্য সামনে একটা মহা লড়াই আসছে, সে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করাই হবে জীবনের প্রধানতম ব্রত।" (ছফা, খ. ৩, পৃ. ২৩৬)

প্রাইমারি স্কুলে পড়াকালীন ছফা কাকা বাবার ধমক খেয়ে রামচন্দ্রকে নিয়ে প্রথম কবিতাটি তিনি লিখেছিলেন এবং মসজিদের মুসল্লিদের তা পাঠ করে শুনিয়েছিলেন–একথা আমরা সকলে জানি। সুতরাং সকলে ধরে নিতে পারি তিনি বাবার অনুপ্রেরণায় সাহিত্যে-জগতে পা বাড়িয়েছিলেন। ছফা কাকা বলেছেন :

"বাবার প্রেরণায় বলা ঠিক হবে না। আমার বড় ভাইটিই আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনি সমস্ত পদ্মাবতী কাব্যটা মুখস্থ বলতে পারতেন। বেশি লেখাপড়া করেননি। তিনি কথায় কথায় গান বানিয়ে ফেলতে পারতেন। তাঁর কাছেই আমি বেশি ঋণী। …শিববাবু, মুহম্মদ ইসহাক, মাওলানা আবু সৈয়দ এবং শারদাবাবু এই চারজন শিক্ষকের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েছি এবং সাহায্যও পেয়েছি।" (ছফা, সা. পৃ. ৬৮)

ওই ব্যক্তি বিশেষের প্রেরণা তাঁর মধ্যে এত বেশি কাজ করেছিল গাছবাড়িয়া হাই স্কুলে পড়ার সময় তিনি অনেক কবিতা লিখে ফেলেছিলেন। এ নিয়ে হয়ত তাঁর তৃপ্তিবোধও জাগ্রত হয়েছিল। পরে এক ঘটনার প্রেক্ষিতে তাঁকে কবিতাগুলো নষ্ট করে ফেলতে হয়। পরবর্তীতে এ কবিতাগুলোর জন্য তাঁকে আফশোস করতে হয়েছে। এই সম্পর্কে তিনি তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছেন:

"সেই সময় আমি অনেক কবিতা লিখেছিলাম। সেটাও একটা দুঃখের ব্যাপার; সেই কবিতাগুলো থাকলে আজকে 'প্রভাত সঙ্গীত', 'শৈশব সঙ্গীত' কবিতাগুলোর মত হত। আমি বাংলা ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হওয়ার সময় ড. মনিরুজ্জামানকে দেখিয়েছিলাম। উনি বললেন যে কিছু হয়নি। তখন এগুলো জ্বালিয়ে ফেলেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার প্রফেসর বলেছেন কিছু হয়নি! তাঁর লেখা ছাপা হয়, এটা বিশ্বাস করে আমি কবিতাগুলো জ্বালিয়ে ফেলেছি। এটাও আমার জীবনের বড় লস।" (ছফা, সা., পৃ. ১৪)

ছফা কাকার জীবন গড়ার পেছনে ওই সময় আরও অনেক মানুষের পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। একটা কথা তিনি বারবার বলতেন, ইতিহাসের ভেতর থেকে তাঁকে উঠে আসতে হয়েছে। এই কথাগুলো তাঁর সাক্ষাৎকারে নানাভাবে এসেছে। ইতিহাসের ভেতর থেকে উঠে আসা মানে তাঁর এলাকাটি এত বিখ্যাত লোকের জন্ম সম্ভব করে তুলেছিল যাঁদের অবদান সাহিত্য এবং রাজনীতিতে খাটো করে দেখার অবকাশ ছিল না। ফলে এঁদের রেশ খানেকটা হলেও তাঁর ওপর এসে পড়েছিল। মনিরুজ্জামান ইসালামাবাদী, জে এম সেনগুপ্ত, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ওই এলাকার লোক ছিলেন। তাঁদের কথা মনে রেখে তিনি বলেছেন:

"[আমার এলাকাকে] স্বর্ণপ্রসবিনী আমি বলব না। এইগুলো হচ্ছে ফ্যাক্ট। এসব নিয়ে আমার গর্ব নেই, অগর্বও নেই। তখন আবুল ফজল সাহেবের বাড়ি [আমার বাড়ি থেকে] আড়াই মাইল দূরে। তারপর আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের বাড়ি পাঁচ মাইল দূরে। আমি যে গ্রামে জন্মেছি, এক শ' বছর আগে তার খুব বেশি এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল না। মাঝখানে কিন্তু ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকে প্রচণ্ড একটা ব্যাপার হয়। সেটা খুব আশ্চর্যের ব্যাপার। এই যে নেলী সেনগুপ্তা কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট ছিলেন তাঁর কাছ থেকে আমি প্রথম ইংরেজি (এবিসি) শিখেছি। তারপর প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম, হি কেইম ফ্রম এ ভেরি পুওরেস্ট ব্যাকগ্রাউন্ড। তিনি বাংলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। তারপরে ধর মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, তারপরে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, আবুল ফজল এঁরা সবাই পাঁচ সাত মাইল রেডিয়াসের মধ্যে। ক্লাস ফাইভে থাকার সময় আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে আমি দেখেছি। আর ঐ যে শিব মাস্টার তাঁর ক্লাসফ্রেন্ড ছিলেন। তখন এই সমস্ত লোকদের দেখার মধ্য দিয়ে আমাদের ছোটবেলা কেটেছে। (ছফা, সা., পৃ. ২২)

স্কুলের ভাল ছাত্র বলতে যা বোঝায় কাকা তা ছিলেন না। তাঁর বাহ্যিক জ্ঞানের বহর যত প্রশস্ত ছিল পরীক্ষা খাতায় বোধকরি ওরকম দাপট তিনি দেখাতে পারতেন না। হয়ত তিনি পাঠ্য বইয়ের প্রতি খুব বেশি মনযোগী হয়ে উঠতে পারেননি। দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় তাঁর ক্লাসে ছাত্রসংখ্যা ছিল মাত্র চৌদ্দজন। তাতে দেখা যায় তাঁর রোল ছিল সাত নম্বরে। সার্টিফিকেট থেকে জানা যায়, ঊনিশ শ' সাতান্ন সালের মার্চে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন সমাপ্ত করেন এবং তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।

স্কুল-জীবনে কাকা রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ওই সময় তাঁর মনে ধরেছিল তিনি বিপ্লব করবেন। সুধাংশু বিমল দত্তের মাধ্যমে তিনি কৃষক সমিতি-ন্যাপ এবং গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুুক্ত হয়ে পড়েন। এ সম্পর্কে সাক্ষাৎকারে উল্লেখ পাওয়া যায়:

"[কমিউনিজম] প্রভাবশালী ছিল না। সবেমাত্র জন্মাতে লেগেছে আমাদের অঞ্চলে। তখন অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ, পূর্ণেন্দু দস্তিদার এঁরা ছিলেন নেতা। আমাদের এলাকার নেতৃস্থানীয় কমিউনিস্টদের অনেকেই হিন্দু ছিলেন। তাঁরা পারিবারিক প্রভাব আছে এ রকম কিছু তরুণের সন্ধান করছিলেন। আমার ভাল লেগে গেল। কৃষক সমিতির কাজে লেগে গেলাম। আমাদের ওদিকে আরাকান রোড ছাড়া পাকা রাস্তা ছিল না। দশ বার মাইল দূরেও মিটিং-এ যেতে হত। আমি তখনও অত হাঁটতে পারতাম না। আমার বাবা মাঝে মাঝে ঘাড়ে করে দিয়ে আসতেন।" (ছফা, সা., পৃ. ৬৯)

…….
ছফা ও মেরি ড্যানহাম
……..
গাছবাড়িয়া হাই স্কুলে পড়াকালীন সময়ে শুরু করা রাজনীতি কলেজ জীবনে আরও বেগ পায়। এ সময় রাজনীতির সঙ্গে আষ্টে-পৃষ্ঠে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন যে সাহিত্যকর্ম থেকে নিজেকে অনেকদূরে সরিয়ে রাখতে হয়েছিল। তখন তিনি কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজের ইন্টামিডিয়েটের ছাত্র। তিনি যে এ কলেজের ছাত্র ছিলেন মেরি ডানহ্যামকে লেখা এক চিঠিতে তাঁর সাক্ষ্য মেলে। লিখেছেন, 'তাঁর [আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ] তিন চার ভাইয়ের ছেলের সঙ্গে আমি কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজে পড়েছি। তাঁরা আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র সংগঠনের সদস্য ছিলেন। তাঁদের কারও কারও সঙ্গে এখনও দেখা হয়ে যায়।' (ছফা, খ. ৪, পৃ. ২১৮)

কানুনগোপাড়া কলেজে পড়ার সময় তিনি রাজনীতির একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ওই সময় তাঁর সাহিত্য সাধনায় বড় রকমের ছেদ পড়ে। তিনি মনে করেছিলেন, সাহিত্য নয়, বিপ্লবের মাধ্যমে তিনি কৃষক সমাজের ভাগ্য পরিবর্তন করবেন। এর জন্য যা করণীয় তা তিনি করবেন। মাস্টার দা সূর্যসেন এবং তাঁর সহকর্মীদের দৃষ্টান্ত হয়ত তাঁকে অনেকখানি অনুপ্রাণিত করে থাকবে। যে কারণে বিপ্লবের জোশ তাঁকে এমনভাবে তাড়িত করেছিল তাঁরা কয়েক বন্ধু মিলে চট্টগ্রাম-দোহাজারি রেললাইল উপড়ে ফেলেছিলেন। এ নিয়ে তিনি সাক্ষাৎকারে বলেছেন:

"একবার কলেজে থাকার সময় আমরা ক'জন মিলে বিপ্লবী লোকনাথ বলের বাড়িটা ভাড়া করেছিলাম। দোতলা মাটির বাড়ি। উনি তো মেয়র ছিলেন, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ওয়ান অফ দ্যা মেইন ক্যারেক্টারস। তখন আমাদের ইচ্ছে হল আমরা একটা কিছু করি। তখন চট্টগ্রামের এ অঞ্চল স্বাধীন করার সহজ রাস্তা হচ্ছে রেললাইন তুলে দেয়া; কর্ণফুলির এই পাড়ে। এবং আমরা তুলে দিলাম। … চট্টগ্রাম স্বাধীন হয়ে গেল; এইটা বিপ্লবীদের আদর্শ। তখন পরদিন, প্রায় পাঁচ শ' মিলিটারি এসে স্যার আশুতোষ কলেজ ঘেরাও করল। আমার বন্ধুরা চলে গেল সব ইন্ডিয়াতে। অনেকেই এখনও ফিরেনি।" (ছফ, সা., পৃ. ২৩)

এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ছফা কাকার আর ওই কলেজে পড়া সম্ভব হয়নি। এমনকি পুলিশের ভয় তাঁকে এমনভাবে তাড়া করেছিল তাঁর ঘরমুখো হবারও জোঁ ছিল না। তাঁকে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ে। এই সম্পর্কে শান্তিচুক্তি ও অন্যান্য নিবন্ধ গ্রন্থে তাঁর দীর্ঘ বর্ণনা আছে। আমি লেখাটি হুবহু তুলে দেয়ার চেষ্টা করছি:

"আমার বাড়ি চট্টগ্রাম। আমার বাড়ি যেখানে তার এক কিলোমিটার পূর্বে পাহাড়। এই সামান্য পথ হেঁটে পাহাড়ে যাওয়া আমার কোনদিন হয়নি। ষাটের দশকে স্কুলের পরীক্ষা শেষ করার পর আমাকে পুলিশের নেকনজরে পড়তে হয়েছিল। লাল পাগড়ির হাত থেকে বাঁচার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্বমোট থেকেছিলাম এক বছর তিন মাস। এই এক বছর তিন মাস সময়ের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেকখানি অঞ্চল আমি পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখেছি। আমি যে সমস্ত জায়গায় গিয়েছিলাম, পাহাড়ি বন্ধুদের কাছে সেসব জায়গার বর্ণনা যখন তুলে ধরি, অনেক সময় নিজেরাও অবাক হয়ে যান এবং বলে থাকেন আপনি যত জায়গায় গিয়েছেন, সচরাচর আমাদের পাহাড়িরাও অতগুলো জায়গায় বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া যাই না।

আমি বিলাইছড়ি বাজার থেকে গোটা একদিন আধারাত দুর্গম পাহাড়ি পথ পায়ে হেঁটে ফারুয়া অবধি গিয়েছি। ফারুয়ার পথে যেসব পাহাড় পেরিয়ে যেতে হয় তার একেকটার চূড়ায় চড়লে চন্দ্রঘোনার কাগজের কল দেখা যায়। ওই জায়গা থেকে চন্দ্রঘোনার দূরত্ব এক শ' কিলোমিটার। কর্নফুলি নদীকে আঁকাবাঁকা চিকন একটি রূপালি রেখার মত দেখায়। ফারুয়া ছাড়া আমি রাঙ্গামাটি হয়ে বুড়িঘাট বাজার, নানিয়ারচর বাজার, মহালছড়ি, খাগড়াছড়ি, মাইনিমুখ–এসকল এলাকা পায়ে হেঁটে, কখনও লক্কর বাসে চেপে, কখনও নৌকাযোগে ভ্রমণ করেছি। ভ্রমণ করেছি কথাটা বোধহয় ঠিক হল না। আসলে ব্যাপারটি, আমি অন্ন ও নিরাপত্তার সন্ধানে ঘুরে বেড়িয়েছি।

কৃষক পরিবারে আমার জন্ম। নিজেদের জমিতে নিজ হাতে চাষবাসের কাজ করিনি। পৈতৃকসূত্রে যে জমিগুলো আমি পেয়েছি, তার কোন অংশ কোনদিন আমি পুরোপুরি চিনে নিতে না পারলেও কামলার খরচ ঠিকমত যোগাতে হয়। আমি বুড়িঘাট বাজারের কাছে মইশছড়ি পাড়ায় নতুন চন্দ্র কারবারির জমিতে প্রথম মোষের হাল বাইতে শিখি। আগে কোনদিন লাঙলের মুঠিও আমাকে ধরতে হয়নি। সেই সময়েই প্রথম রক্তখেকো মইশা জোঁকের সাথে আমার পরিচয় হয়। মোষের হাল বাইতে গিয়ে আমার আগুলে যে কড়া পড়েছিল তা এখনও মিলিয়ে যায়নি। নিতান্ত ঠেলায় পড়ে নতুনচন্দ্র কারবারির বাড়িতে অন্য দিনমজুরের সাথে দিনমজুরের কাজ করতে হয়েছে। আমি পরিবারের কনিষ্ঠতম সন্তান এবং অনেকগুলো বোনের পর মায়ের একমাত্র বেটা ছাওয়াল। বাড়িতে আরাম-আয়েশ, খাওয়া-পরা, আদর-যত্নের অভাব ছিল না। কিন্তু আমি সাধ করে কষ্টটা মাথায় তুলে নিয়েছিলাম।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের মধ্যে আমাকে অত্যন্ত কষ্টের জীবন যাপন করতে হয়েছে। আজ প্রায় চল্লিশ বছর পরে যখন চোখ বন্ধ করে ভাবি, কষ্টের কথাগুলো আমার মোটেও মনে পড়ে না। অতীতের সুখ-স্মৃতিগুলো মনের আনাচ-কানাচ থেকে উঁকি দিতে থাকে।
নতুনচন্দ্র কারবারি মশায়রা একটি প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্কুলে উর্দু পড়াবার একজন হুজুরের ঘাটতি দেখা গেল। উর্দু শিক্ষক ছাড়া স্কুলের মঞ্জুরি পাওয়া যাচ্ছিল না। মাসিক ছাব্বিশ টাকা মাইনের লোভে ওই জঙ্গলে কোন হুজুর মরতে যাবেন। আমার অল্প-স্বল্প উর্দু এলেম ছিল। প্রাইমারির তালেবে এলেমদের জন্য সেটা যথেষ্ট ছিল। সুতরাং আমাকে টেনে-হিঁচড়ে মোষের হাল থেকে উর্দু হুজুর হিসেবে প্রমোশন দেয়া হল। যাক, হালের পেছনে ছোটা থেকে উদ্ধার পাওয়া গেল। ভাগ্য আমাকে একটু করুণা করল। নতুনচন্দ্র কারবারির বাড়িতে টুটা ফাটা মহাভারত ছিল। সেটার সামনের এবং পেছন দিকের পাতাগুলো ছিল না। গ্রন্থটিকে একখণ্ড পরিষ্কার কাপড়ে মুড়িয়ে মাচান ঘরের উঁচু জায়গায় তুলে রাখা হত, পাছে পরিবারের কোন মানুষের অপবিত্র স্পর্শে গ্রন্থের মর্যাদাহানি ঘটে। শুধাং মানে শাস্ত্র। আমাদের চট্টগ্রাম অঞ্চলে মানুষ সচরাচর কথায় কথায় বলে ফেলে, এই জিনিস আমার শুধাংয়ে নেই। অর্থাৎ বিষয়টিতে আমার অভ্যাস নেই। শুধাং শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ আমার জানা নেই। খুব সম্ভব শব্দটি বর্মি ভাষা থেকে এসেছে।

আমি একদিন কারবারি মশায়ের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা শুধাংয়ের বইটি কখনও কি পড়ে দেখেছেন? তিনি হতাশভাবে বললেন, বুড়িঘাট বাজারের অমূল্য কবিরাজ শুধাং পাঠ করে কথার মাহাত্ম্য বুঝিয়ে দিতে পারতেন। তাঁর মৃত্যুর পর শুধাংয়ের মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করার মত কোন লোক পাওয়া যায়নি। আমি একদিন কথায় কথায় জানালাম আমি স্মৃতি থেকে মহাভারতের নানা অংশ শুধু উদ্ধৃত করতে পারিনে, চেষ্টা করলে মাতাত্ম্যও বুঝিয়ে দিতে পারি। একজন 'মগদা বাঙ্গাল' শুধাং পড়ে মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করতে পারে একথা জানাজানি হওয়ার পরে ওই পাড়ায় আবাল-বৃদ্ধ লোকজনের দৃষ্টিতে রাতারাতি একটা সম্মানের আসন পেয়ে গেলাম। আমার স্মৃতিতে ভাসে অনেক জ্যোৎস্না জ্বলা রাত। থোকা থোকা পরিপক্ক সিঁদুরে লিপুর মত আকাশের তারাগুলো উপত্যকার নির্জন ভূমির প্রতি তাকিয়ে আছে। কেরোসিনের আলোকে মাচানে ঘরের সামনের আঙিনায় আমি সুর করে মহাভারত পাঠ করছি, অর্থ বুঝিয়ে দিচ্ছি, নর-নারী, যুবা-বৃদ্ধ অবাক হয়ে যুধিষ্ঠির অর্জুন দ্রোপদী দুর্যোধনের কাহিনী শুনে যাচ্ছে। নতুনচন্দ্র কারবারির একটি মেয়ে ছিল, নাম লক্ষণা। সে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ত। আমার কাছে উর্দু ছাড়া অন্যান্য বিষয়ও পড়ত।" (ছফ, খ. ২, পৃ. ২৮৭)

কারণ কী ছিল বলা যাবে না, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে তাঁকে চলে আসতে হয়েছিল। হয়ত পড়াশুনার প্রতি আগ্রহবোধটা ভেতরে ভেতরে তাঁকে তাড়া করছিল। পুলিশি নজরদারির ভয়টা তিনি তখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। ফলে কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজে পুনরায় ফিরে আসা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। এবার তিনি পাড়ি জমালেন চট্টগ্রামের উত্তারঞ্চলে। এখানে এসে তিনি নাজির হাট কলেজে ভর্তি হন। এ কলেজের তিনি নিয়মিত ছাত্র ছিলেন কিনা জানা যায়নি। তাঁর সার্টিফিকেট থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় তিনি এ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন। সালটি ছিল ঊনিশ শ' বাষট্টি সাল। চট্টগ্রাম থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে একই বছর ঢাকার উদ্দেশে তিনি পা বাড়িয়েছিলেন। তখন তিনি বাঁধনহারা। কারও শাসন মেনে তিনি চলবেন এমন অবস্থা তখন তাঁর ছিল না। যখন যেটা মনে চেয়েছে সেটা তিনি করে চলেছেন। বড় ভাইয়ের তরফ থেকে বিয়ের কথাও উঠেছিল তিনি গা করেননি। পৈতৃক সম্পত্তির ওপর তাঁর নজর পড়েছিল অনেক আগে থেকে। ফলে কিছু খারাপ লোকের পাল্লায়ও তিনি পড়েছিলেন। তারা তাঁকে ঠকিয়ে বেশ কিছু জমি নিজেদের করে ছিয়েছিল। আমার বাবা পরে পরে সেটা জানতে পারেন। অনেক কষ্টে সে জমি তিনি উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে সময় ছফা কাকা জমি বিক্রি করে বেশ কিছু টাকা নিজের করে নিয়েছিলেন। খুব সম্ভব ঢাকা পাড়ি দেয়ার সময় তিনি টাকাটা সঙ্গে নিয়েছিলেন। তাঁর সাক্ষাৎকারে উল্লেখ পাওয়া যায়:

"প্রথমত আমি গরিব দরিদ্র ছিলাম। বাড়ি থেকে কিছু জমি বিক্রি করে পঁয়তাল্লিশ ছেচল্লিশ হাজার টাকা এনেছিলাম। আনার পরে সকলে বলল যে আমাকে জমি কিনতে হবে। একজন বলল এখন যেখানে 'মাসুকো সুজ' তার পাশের জায়গাটা কিনলে ওখানে প্রায় এক বিঘার মত জায়গা, ন' হাজার টাকা দিতে হবে। আমি কোন কারণ খুঁজে পাইনি যে মাটি বিক্রি করে আবার মাটি কিনতে হবে কেন। এই যে 'সাকুরা' আছে, সাকুরার পেছনে তখন 'হোটেল গ্রীন' ছিল সেকেন্ড বিগেস্ট হোটেল, আফটার শাহবাগ। ওখানে গিয়ে ঠিক করলাম যে যদি ইউনিভার্সিটিতে যাই, পোলাপান আমার টাকা ধার নিয়ে খেয়ে ফেলবে। ধার দেয়ার বদলে তখন আমি করলাম কী, নিজে নিজে টাকাটা এনজয় করি। সেখানে একটা বিপদ হল, যখন একদিন দু'দিন থাকলাম, বেশ মন্দ না।… তখন দেখি যে হোটেলে যারা আসে ব্যবসায়ীরা; আসে ব্যবসা করে চলে যায়। আমলারা আসে; কাজ করে চলে যায়। আমার তো কাজ নেই। বসে বসে টাকা খরচ করা। কদিন বাদে বোরিং লাগল। আবার এস এম হল থেকে, এখান থেকে, ওখান থেকে নরেন বিশ্বাস, অরুনেন্দু বিকাশ দেব, জামাল খান ওঁদের ডেকে আনতে হল। তারপরে তো দরিদ্র হয়ে গেলাম।" (ছফা, সা., পৃ. ১৭)

বলে রাখা দরকার, ছফা কাকা ঢাকা এসে কোথায় উঠবেন তার নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য ছিল না। হোটেল ওঠার আগে তিনি তাঁর এক বন্ধুর বাসায় উঠেছিলেন। তিনি বলেছেন:

"প্রথমে উঠেছিলাম আমি, ঢাকায় যখন প্রথম আসি, আমার এক বন্ধু ছিল ঢাকাইয়া। স্বামীবাগে তার বাসায় দুদিন ছিলাম। তারপরে ইকবাল হলে, আবার এক বন্ধুর বাসায় চলে আসি। এখন সার্জেন্ট জহুরুল হক হল যেটা, পরে এস এম হলে যাইয়া লুকাইয়া রইছি আমার বন্ধু আবুল কাশেম ফজলুল হকের সঙ্গে।" (ছফা, সা., পৃ. ১৭)

প্রফেসর আবুল কাশেম ফজলুল হকের সঙ্গে যে ছফা কাকার যে আন্তরিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেটি তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বহাল ছিল। তাঁদের সম্পর্ক ছিল তুই-তোকারির। কাকা মাঝে মাঝে আবেগের বশে তাঁকে ডাকতেন ফকা। প্রফেসর আবুল কাশেম ফজলুল হক প্রায়ই কাকার কাছে আসতেন। ফোনালাপও হত দীর্ঘ সময় ধরে। কাকাও তাঁর বাড়িতে যেতেন। মাঝে মাঝে আমাকে যেতে হত কাকার কোনো কাগজপত্র কিংবা বই-পুস্তকের বাহক হয়ে। ঢাকা আসার প্রথমদিকে কাকা প্রফেসর হকের ওপর নানাভাবে চড়া হতেন। দিনের পর দিন তিনি তাঁর পয়সায় খেয়েছেন–এই কথা নানাভাবে উল্লেখ পাওয়া যায়। ছফা কাকার মৃত্যুর পর নভেরা হলে প্রথম নাগরিক শোকসভায় প্রফেসর হক তার কিঞ্চিৎ বর্ণনাও করেছেন। তিনি যদি কোনোদিন এ ব্যাপারে লিখেন আমরা হয়ত সবিস্তারে জানতে পারব। ততদিন আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় কি। অবশ্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু জাফরের লেখায় প্রফেসর হক যে ছফা কাকার প্রতি সদয় ছিলেন তার কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

ছফা কাকা খুব কম সময় হালকা কথা-বার্তা বলতেন। তারপরেও গুটিকয় বন্ধু তাঁর ছিল তাঁদের সঙ্গে তিনি রসিকতা করতেন। প্রফেসর আবুল কাশেম ফজলুল হককে ছফা কাকা একবার কণ্ঠ পরিবর্তন করে ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন, বৃটিশ হাই কমিশনে একটা ডিনার পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। আপনাকে সেখানে থাকতে হবে। আমাদের লোকজন সন্ধের আগে গিয়ে আপনাকে গাড়িতে করে নিয়ে আসবেন। আপনি ঠিক সময়ে রেডি থাকবেন। আমরা অনুতপ্ত, আপনার কার্ডখানা হাতে হাতে পৌঁছুতে পারিনি।

ছফা কাকার কী হাসাহাসি। তিনি বলতে থাকলেন, বহুদিন পর ফকাকে একটা গোল দিলাম।

মিনিট দশেক পর ছফা কাকা আবার প্রফেসর হককে ফোন করলেন। বললেন, দোস্ত, একটা বিপদে পড়ে গেলাম। বৃটিশ হাই কমিশন থেকে ফোন করেছে ওখানে নাকি ডিনার পার্টি, ধরে বসেছে যেতে হবে। আচ্ছা বল তো, বলা নেই, কওয়া নেই এভাবে কি যাওয়া সম্ভব?

প্রফেসর হক হয়ত বলেছেন, আমাকেও তো ফোন করল।

কাকা বললেন, তাহলে ভালই হল। দু'জনে একসঙ্গে যাওয়া যাবে।

সন্ধে যখন পার হয়ে গেল প্রফেসর হক ফোন করলেন, ছফা, কেউ তো এল না। আমি কবে থেকে রেডি হয়ে বসে আছি। ছফা বললেন, ছেড়ে দে। তুই আমার এখানে চলে আয়।

ঘটনাটা ঘটিয়েছিলেন আজিজ মার্কেটের 'উত্থানপর্ব' অফিসে বসে। প্রফেসর আবুল কাশেম ফজলুল হক এসেছিলেন, নাকি ছফা কাকা গিয়েছিলেন আমার জানা নেই। কারণ তার আগে আমাকে অফিস ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল।

প্রফেসর আবুল কাশেম ফজলুল হককে কী পরিমাণ ভালবাসতেন তার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাই ছফা কাকার সাক্ষাৎকারে। তিনি বলেছেন, কাল তাঁর জন্মদিন। তাঁকে আমি এক শ' গোলাপ উপহার দেব।

তাঁর আরও একজন বন্ধু ছিলেন তিনি হলেন নেহাল আদেল। তাঁর সঙ্গেও ছফা কাকা রসিকতা করতেন। নেহাল সাহেব কিছুটা পাগলা কিসিমের ছিলেন। ছফা কাকা তাঁকে যা বলতেন বিশ্বাস করতেন। একবার নেহাল সাহেব বাসায় এলে দুজনে আড্ডায় মেতে থাকলে দুপুর হয়ে যায়। তখন ছফা কাকা বলে বসলেন, আজকে এখানে খেয়ে যা।

নেহাল সাহেব বললেন, আজকে খেতে পারব না। আমি বাসায় গিয়ে খাব।

কাকা বললেন, বেশ তো! তোরে খাওয়াব বলে এত টাকা খরচ করলাম, আর তুই কিনা খাবি না? ঠিক আছে, না খাস আপত্তি নেই। তোর জন্য দু' শ' খরচ হয়েছে সেটি দিয়ে যা।

নেহাল সাহেব রাজি হলেন এবং দু' শ' টাকা দিয়েও দিলেন।

টাকা হাতে নিয়ে ছফা কাকা বললেন, এখন দাঁড়িয়ে কেন, বেরিয়ে যা?

নেহাল সাহেব ঘর থেকে বের হবার উদ্যোগ নিতেই ছফা কাকা ক্ষুধার্ত বাঘের মত তাঁর ওপর ঝাপিয়ে পড়লেন। তিনি তাঁর চুল ধরে টেনে ঘরে ঢুকিয়ে বললেন, খামোকা দু' শ' টাকা নষ্ট করবি কেন? টাকা যখন খরচই করলি চারটে খেয়ে নে।

কাকা ইদ্রিসকে বললেন, ইদ্রিস, পোলাও-কোর্মা যা আছে সব নিয়ে আয়।

ইদ্রিস আলুভর্তা, ডাল, ডিম সামনে এনে দিয়ে গেল। তারপর দুজনে বসে একসঙ্গে খেয়ে নিলেন।

শাহবাগের আজিজ মার্কেটে নেহাল আদেলের সঙ্গে আরেকবার আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল। ছফা কাকার অফিস ছিল দোতলায়। নেহাল আদেল নাকি নিচের তলায় কোন একটা দোকানে বসে ছফা কাকার সমালোচনা করছিলেন। আহমদ ছফা মৌলবাদী, আহমদ ছফা পাগল ইত্যাদি ইত্যাদি।

নেহাল আদেলের সমালোচনার কথা এক তরুণ এসে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ছফা কাকাকে বলে গিয়েছিলেন। নেহাল আদেলের আচরণে ছফা কাকা তেতে আগুন। তিনি স্থির করে বসে আছেন নেহাল সাহেবকে সামনে পেলেই পিটাবেন।

নেহাল সাহেবের কপালে দুঃখ ছিল। কিছুক্ষণ বাদে তিনি ছফা কাকার অফিসে এসে ধরা দিলেন। তখন আর যায় কোথা। ছফা কাকার হাতের কাছে লাঠি ছিল। ওটা দিয়ে তিনি নেহাল সাহেবকে পিটাতে আরম্ভ করে দিলেন। নেহাল সাহেব উপায়ন্তর না দেখে পালিয়ে যান।

পরে শুনেছিলাম নেহাল সাহেব মার খেয়ে ডক্টর আহমেদ কামালের বাসায় ছুটে গিয়েছিলেন এবং তাঁর কাছে নালিশ করেছিলেন। তার কিছুক্ষণ বাদে ছফা কাকাও ওই বাসায় গিয়ে হাজির। তাঁদের দুজনের কথা ডক্টর আহমেদ কামালকে শুনতে হয়েছিল। পরে দুজনকে খাইয়ে দিয়ে ডক্টর কামাল তাঁদের বিদায় করেছিলেন।

এগুলো ছফা কাকার শেষ জীবনের ঘটনা। নানা কথার ফাঁক-ফোকর দিয়ে এমন সব বিষয় চলে আসছে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। সন-তারিখ ঠিক রেখে লেখাটি সাজানোর ইচ্ছে পোষণ করলেও সেটি আর হয়ে উঠছে না।

আগের কথায় ফিরে আসি। ইতোমধ্যে ছফা কাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। বাড়ি থেকে জমি বিক্রি করে যে টাকা সঙ্গে করে এনেছিলেন আরাম-আয়েশ করতেই তা শেষ হয়ে গিয়েছে। ওই সময় আমাদের আর্থিক অবস্থাও ভাল ছিল না। আমার পিতামহের রেখে যাওয়া জমিই ছিল বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। ছফা কাকা তো ঢাকায় চলে এলেন, ওদিকে বাবা ভুগতে থাকলেন মারাত্মক ব্যাধিতে। পরিবারের আয়-রোজগার বলতে কিছু নেই। ছফা কাকা যদিও জায়গা বিক্রির হাতেখড়িটি নিজ হাতে সম্পন্ন করেছিলেন, আমার বাবাও সেদিকে পা বাড়ালেন। তবে তিনি বিক্রি করতেন না। যখন টাকার প্রয়োজন হত তিনি জমি বন্ধক দিতেন। বন্ধকী জমির টাকা দিয়ে তিনি সংসার খরচ এবং চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতেন। তার থেকে একটা অংশ তিনি ছফা কাকার জন্যও পাঠাতেন।

ছোটকাল থেকে কাকা অমিতব্যয়ী ছিলেন। তিনি যখন যা পেতেন দু'হাতে খরচ করতেন। সুতরাং বাবার পাঠানো টাকা তিনি যে রেখে-ঢেকে খরচ করতেন তা মনে হয় না। এমনও হতে পারে বাবার পাঠানো টাকা তাঁর প্রয়োজনের চেয়ে কম ছিল। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিয়ে তিনি থাকা, খাওয়া, পরা ইত্যাদির অভাব তিলে তিলে অনুভব করেছিলেন। চেনাজানা মানুষের কাছ থেকে ধারদেনা করে চলা ছাড়া তাঁর গত্যন্তর ছিল না। এ ধারদেনা তিনি শোধ করতে পারতেন কি না বলা মুশকিল। কারণ পরিণত বয়সে তাঁর কোনো কোনো লেখায় উল্লেখ পাওয়া যায়, অমুকের কাছ থেকে বিশ টাকা, তমুকের কাছ থেকে পঞ্চাশ টাকা ধার করেছিলাম। ওই টাকা শোধ করার মত অবস্থা আমার কোনোদিন হয়নি এবং ভবিষ্যতেও তা কোনোদিন সম্ভব নয়।

ঢাকায় আসার পর তিনি কিছু বন্ধু-বান্ধব যোগাড় করতে পেরেছিলেন বটে, কিন্তু কারও সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ওই সময়ে তিনি ব্যতিক্রম হিসেবে পেয়েছিলেন অধ্যাপক নরেন বিশ্বাসকে, যাঁর ওপর কাকা অন্তত নির্ভর করতে পারতেন। কাকা সব সময় তাঁকে দুঃসময়ের সহায় হিসেবে পেয়েছিলেন। যখনই তিনি অধ্যাপক নরেন বিশ্বাসের কাছে ধন্না দিয়েছেন খালি হাতে তাঁকে কখনও ফিরাননি। এ মানুষটির কথা ছফা কাকা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত খুব বিনয়ের সঙ্গে স্মরণ করতেন।

……..
নরেন বিশ্বাস ও আহমদ ছফা
………
উনিশ শ' নিরানব্বই সালে অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিলেন। তখন নরেন বিশ্বাসকে সহায়তা দেয়ার জন্য অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এতে ছফা কাকা নরেন বিশ্বাসের বন্ধু হিসেবে এ কমিটির সদস্য হয়েছিলেন। ওই সময় অধ্যাপক নরেন বিশ্বাসকে নিয়ে পত্রিকায় তিনি একটি লেখা লিখেন সমাজের মানুষকে তাঁর চিকিৎসার সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য। ওই লেখায় ফুটে উঠেছে কী পরিমাণ ঋণ তিনি অধ্যাপক নরেন বিশ্বাসের কাছ থেকে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি লিখেছেন :

"অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিকের বন্ধু। তাঁর মুখের দাড়ি, চোখের চাহনি এবং বাচনভঙ্গির মধ্যে এমন কিছু ছিল, দেখেই আমি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র থাকাকালীন আমার অবস্থা ছিল অত্যন্ত জয়ীফ। নাস্তার পয়সা থাকলে খাওয়ার পয়সা থাকত না, কোন রকম দুবেলা খাবার জুটলে রাত্রে ঘুমাব কোথায় তার স্থিরতা ছিল না। সেই অনিশ্চিত দিনগুলোতে নরেনদা আমাকে যথেষ্ট সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। আমার হাতে পয়সা থাকত না, আর মেজাজের দিক দিয়ে একটা ঔদ্ধত্য সে সময়েও ছিল। একজন উদ্ধত দরিদ্র যুবককে বন্ধু হিসেবে, ভাই হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কথাটা একটু বাড়িয়ে বলছি না। নরেনদা'র গোটা পরিবারের সঙ্গে আমার একটি অকৃত্রিম সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আমার সঙ্গে নরেনদা'র ঘনিষ্ঠতা অনেকে পছন্দ করতেন না। তারা আড়ালে নরেনদাকে নানা কথা বলতেন। তিনি কোনদিন সেগুলো গায়ে মাখেননি।

নরেনদা খুব বেশি সঙ্গতিসম্পন্ন পরিবার থেকে আসেননি। তথাপি তাঁর ছিল দরাজ হাত এবং উদার হৃদয়। আমার বন্ধু-বান্ধবদের কারও হাতে যখন পয়সা থাকত না আমরা নরেনদার ওপর চড়াও হতাম। তিনি পয়সা না থাকলেও কোথাও থেকে পয়সা যোগাড় করে মুশকিল আসান করার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। নরেনদা'র পদবি ছিল বিশ্বাস। এই পদবি তাঁর ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত হয়েছিল, তিনি ছিলেন ছাত্র ও শিক্ষক, ছোট বড় সকলের বিশ্বাসভাজন। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথমদিককার দিনগুলো তো বটেই, তারপরও অনেকদিন আমরা অত্যন্ত কাছাকাছি ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধেও সাত-আট মাস সময় কোলকাতায় নরেনদার সঙ্গে উদয়ন ছাত্রাবাসে একসঙ্গে কাটিয়েছি। আমরা শুধুমাত্র দুজন নয় আরও কতিপয় বাংলাদেশী যুবক মিলে একটি পরিবারের মত মিলেমিশে ছিলাম। প্রয়াত গল্পকার বিপ্লব দাস এবং নাট্যশিল্পী মামুনুর রশীদও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। আমার এবং তাঁর জীবনের কতিপয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে পরস্পরের সাহায্য-সহযোগিতা গ্রহণ করেছি। আমার স্মৃতিতে নরেনদা'র অস্তিত্ব রয়েছে।" (ছফা, খ. ৪, পৃ. ১৭১)

অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস যেদিন মারা যান সেদিন ছফা কাকা খুব ছটফট করছিলেন। কোথাও তিনি স্থির হতে পারছিলেন না। তবে তাঁকে তেমন ভেঙে পড়েছেন বলেও মনে হয়নি। কিছুক্ষণ পর পর তিনি হারমোনিয়াম নিয়ে বসতেন, আবার উঠে পড়তেন। এক সময় দেখলাম কাগজ কলম নিয়ে। লিখে ফেললেন একটা অভিমানী কবিতা। কবিতাটির শিরোনাম ছিল 'পথিক'।

"যেই জন চলে যায়
সময় সিন্ধুর বুকে তার অন্তর্ধান
নিতান্ত রুটিন মাত্র যে যাবে সে যাবে
জন্ম মানে মৃত্যুদণ্ড
আজ কাল কিংবা পরে কার্যকর হবে
বন্ধুর মৃত্যুর জন্য শোক কেন তবে!"

যাক সেসব কথা। সদ্য গ্রাম থেকে আসা ছফা কাকাকে কেন মানুষ ধারদেনা কিংবা মুক্তহস্তে সহায়তা করতেন? তাঁর মধ্যে এমন কী ছিল? একটা বিষয় আমি জানি, কাকা যে কোনো মানুষকে খুব আপন করে নিতে পারতেন এবং কাউকে মনে না ধরলে নিমেষে সম্পর্কচ্ছেদ করতেও তিনি দ্বিধা করতেন না। তাঁর গুছিয়ে কথা বলা এবং বিচিত্র অঙ্গভঙ্গির যে আকর্ষণ তা মানুষের মধ্যে সহজে ক্রিয়া করত। তাছাড়া তাঁর ধীশক্তি এত প্রখর ছিল যে যুক্তিসহকারে কথার পিঠে কথা বলার অপূর্ব কারিশমা তাঁর ছিল। মোহাম্মদ আবু জাফর তাঁর স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছেন:

"তার সঙ্গে আমার দেখা ১৯৬২ সালে প্রথম বর্ষ বাংলা অনার্স শ্রেণীতে। …সাফা [ছফা] এমন একজন মানুষ যাকে ভোলা যায় না প্রথমত তার চেহারার জন্যে। তখন পাতলা ছিল। কিন্তু প্রথমে চোখ পড়ত তার চোখের দিকে। এক ধরনের অস্বাভাবিকতা সেখানে বিরাজমান। তার চোখ ট্যারা ছিল না হয়তো। কিন্তু, কথা বলার সময় সে এমনভাবে চোখের ব্যায়াম করত যে লক্ষ না করে উপায় ছিল না। অবশ্য তার আসল ব্যাপার ছিল তার চোখের গভীর ও তীক্ষè ভঙ্গিতে। তার কথার অর্ধেকই সে বলত তার চোখ দিয়ে, বস্তুত চোখমুখ না বাঁকিয়ে সে কথা বলতে পারত না। শেষ পর্যন্ত এটিই তাঁর একটি শৈলী হয়ে দাঁড়ায়। গত কয়েক দশকে, নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে বিগত চল্লিশ বছরে, ঐ ধরনের ব্যতিক্রমি ভঙ্গি আর দেখা যায়নি। তবে, সেটি করত উত্তেজনার সময়। মজলিশি আলাপে তার চোখমুখের ভাবভঙ্গি ছিল অনেকখানি সাধারণ শৈলীঘেঁষা।" (ছফা, স্মা. পৃ. ২৫)

মোহাম্মদ আবু জাফরের লেখা এখানে থেমে গেলে ভাল হত। কিন্তু ছফা কাকার দৈন্যদশা নিয়েও কথা বলতে তিনি ভোলেননি। তিনি লিখেছেন:

"সাফা বিশ্ববিদ্যালয় আসছে-যাচ্ছে, এমনই দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। সে আমাদের সঙ্গে, যতদূর মনে পড়ে, ইংরেজি অনুষঙ্গী বিষয় হিসেবে নিয়েছিল। অধ্যক্ষ আবু হেনা, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মিসেস রাজিয়া খান আমীন, অধ্যাপক কে এম এ মুনিম প্রমুখের ক্লাসে সে আসত। আমি থাকতাম ঢাকা হল তথা আজকের শহীদুল্লাহ হলে। হঠাৎ একদিন দেখলাম সে ডাইনিং হলের খাতায় আমার মেহমান হিসেবে নিয়মিত নাম লিখে যাচ্ছে। সে সময় খাওয়ার মাসিক খরচ ছিল আটাশ টাকা। বাধ্যতামূলকভাবে তা পরিশোধ করতে হত। মেহমানদের জন্য প্রতি বেলা দিতে হত এক টাকা। পরে সতীর্থ আবুল কাশেম ফজলুল হকও জানালেন যে রাতের বেলা সে সলিমুল্লাহ হলে তাঁর নিয়মিত মেহমান হচ্ছে। এই প্রথম আমরা আবিষ্কার করলাম যে সাফা সত্যি সত্যিই সংকটে নিপতিত। বেদনার কথা, কাউকে সেকথা জানাতে চাইত না। আমরা দুজনই যখন তাকে আমাদের সম্মতি জানালাম, তখন সে কিছুটা সহজ হয়ে গেল এবং অনেক সময় আমাকে নিয়ে ডাইনিং হলে প্রবেশ করত। একই জায়গায় দুপুরে-রাতে নিয়ম বেঁধে খাওয়া-দাওয়া তার ধাতে সইত না। মাঝে মাঝে তার খোঁজ পাওয়া যেত না। কোথায় থাকত, কী করত কিছুই বলত না সাধারণত। সে বোহেমিয়ান না হলে আর্থিক সংকটে পড়তে হত না।" (ছফা, স্মা., পৃ. ২৫)

ছফা কাকা ছিলেন স্বাধীনচেতা একজন মানুষ। বাঁধা-ধরা জীবনযাপন তাঁর ধাতে সইত না। যখন যেটা তাঁর মনে ধরত তা-ই করতেন। ভেতরে ভেতরে তাঁর মধ্যে একটা শৃঙ্খলাবোধ কাজ করত বটে, কিন্তু বাহ্যিক দিকটা ছিল অন্যরকম; একেবারে অগোছালো। যে কারণে মানুষের চোখে তাঁর বোহেমিয়ান ভাবটা বড় করে ফুটে উঠত। বন্ধু-বান্ধবদের তিনি অতিষ্ঠ করে তুলতেন সত্যি, তাই বলে নিজের বিবেক-বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে কিছু করার মত মানুষ তিনি ছিলেন না। সুতরাং কারও কোনো কথায় তাঁর মনোজগতে আঘাত লাগলে তিনি রেগে যেতেন এবং পারতপক্ষে ওদিকে তিনি আর পা বাড়াতেন না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন বটে, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম-কানুন তিনি খুব একটা মানতেন না। বিভিন্ন লেখায় তিনি তা স্বীকারও করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্কটাকে 'গ্র্যান্ডফাদারের নাতি'র সঙ্গে তুলনা করতেন। গ্র্যান্ডফাদারের কাছ থেকে যাবতীয় কিছু গ্রহণ করবেন, কিন্তু তাঁদের অর্পিত শৃঙ্খলা মানতে তিনি রাজি নন। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথমদিকে তাঁকে অনেকে অপছন্দ করতেন। 'একগুঁয়েমি' আর 'অভিমান' যে কারণেই হোক, তিনি অনেক কিছুই সহ্য করতে পারতেন না। শব্দ দুটি ব্যবহার করলাম একারণে–ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ডক্টর আহমদ শরীফকে তিনি খুব পছন্দ করে ফেলেছিলেন। পরে যখন ডক্টর শরীফ তাঁকে ধমক দিয়ে কথা বললেন তিনি ক্লাস করা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। ডক্টর শরীফ সম্পর্কে তিনি বলেছেন:

"আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে এসে প্রথমে ড. আহমদ শরীফের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেই সন্ধ্যাটির কথা আমার উজ্জ্বলভাবে মনে আছে। আমি আরমানিটোলা বটগাছের কাছে তাঁর বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিলাম। দীঘল গৌরবর্ণের মাহেন্দ্র নিন্দিত সুন্দর চেহারা দেখে যেমন খুশি হয়েছিলাম, কণ্ঠস্বরটি হতাশও করেছিল–বেশ কর্কশ।… আমার সঙ্গে শরীফ সাহেবের সম্পর্ক সব সময়ে এক রকম ছিল না। কখনও খুব ভাল, কখনও খুব খারাপ। একবার তিনি টিউটোরিয়াল ক্লাসে আমাকে খুব কড়া একটা ধমক দেন। ওই ধমকটা আমি প্রাণের থেকে গ্রহণ করিনি। ছোট বেলায় আমি অত্যন্ত স্নেহময় পরিবেশের মধ্যে বেড়ে উঠেছি। কেউ অকারণে আমার অনুভূতিকে আহত করতে পারে সেই জিনিসটি আমি চিন্তাও করতে পারতাম না। আমি কষ্ট পেয়েছিলাম– আপনার ক্লাস আমি আর করব না। পরবর্তী সময়ে অত্যন্ত নিষ্ঠাসহকারে ড. শরীফের টিউটোরিয়াল ক্লাস ও সাধারণ ক্লাসে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকি। তার ফলে সাধারণ একটি কলেজে [ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ] গিয়ে আমাকে বিএ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হল।" (ছফা, খ. ৪, পৃ. ২১৮)

ছফা কাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে গিয়েছিলেন। সেই প্রসঙ্গে পরে আসি। কলেজ জীবনে তাঁর লেখালেখিতে যে ভাটা পড়েছিল ঢাকা এসে সেটাকে তিনি পুনরায় জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন। ঢাকায় থেকে অনেকে লিখে এটা তাঁকে প্রলুব্ধ করেছিল। ঢাকা আসার পেছনে হয়ত এটা একটা বড় কারণ ছিল। ফলে ক্লাসের পড়াশুনার চে' লেখালেখির প্রতি তাঁকে বেশি করে মনোনিবেশ করতে হয়েছিল। তিনি লিখেছেন:

"বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। ভর্তি হওয়াটা উপলক্ষ্য, আসল লক্ষ্য লেখক হওয়া। পত্রিকা অফিসগুলো চষে বেড়াচ্ছি। সাহিত্য-সম্পাদক বরাবর খামের পর খাম পাঠাচ্ছি। কোনো মহাপুরুষের অনুকম্পা আমার ভাগ্যে জুটেনি। তারও চাইতে কষ্টের কথা, বারবার আমার লেখা প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। কারও কাছে দুঃখের কথা খুলে বলার উপায় নেই। সাহিত্য-সম্পাদক মহাশয়েরা আমার অত আদর করে খামগুলো খুলে দেখুন না দেখুন চাই কি বাজে কাগজের ঝুড়িতে ছুুঁড়ে দিন, এই অনাদর-অবহেলা হবু লেখকের ললাট লিখন। কিন্তু সে জিনিসটি যদি অন্যে জেনে যায়, তাহলে নীরবে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অগ্নিপরীক্ষাটি অন্য দশজনের হাসি-ঠাট্টার খোরাক হয়ে দাঁড়ায়।" (ছফা, খ. ৪, পৃ. ১৭৫)

তাঁর লেখা কেউ ছাপেন না। বারবার তাগাদা দিলেও কোনো কাজ হয় না। পরে ব্যাপারটা অনেকের জানা হয়ে গিয়েছিল। যাঁর লেখা কেউ ছাপে না তার গুরুত্ব থাকার কথা নয়। এটা তাঁকে বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে ভয়ানক লজ্জার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। এমনি একদিন একটা কবিতা নিয়ে তিনি সন্তোষ গুপ্তের কাছে গিয়েছিলেন। সন্তোষবাবু সংবাদ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। তাঁকে নিয়ে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন:

সন্তোষ গুপ্ত বলে এক ভদ্রলোক, তখন একটা একেবারে চিকন সাপের জিহ্বার মত টাই পরতেন উনি। একদিন আমাকে ধরে বললেন, বাপ আছে?

আমি বললাম, নাই।

বললেন, ভাই আছে?

আমি বললাম, আছে।

বললেন, ভাইরে চিঠি দেব।

বললাম, কেন?

তিনি বললেন, বিয়া করাইয়া দেব। (ছফা. সা., পৃ. ১৬)

কবিতার ধরন দেখে সন্তোষবাবুর মনে হয়েছিল তাঁর শিগগির বিয়ে করা দরকার। ঘটনাটি তাঁকে খুব রাগিয়ে দিয়েছিল। তাঁর ইচ্ছে হয়েছিল তাঁকে পিটাবেন। ছফা কাকা সন্তোষবাবুর ওখানে সেলুদার রেস্টুরেন্টে গিয়ে অপেক্ষা করছিলেন কখন তিনি বের হবেন। সেদিন সন্তোষবাবুর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল বটে, কিন্তু তিনি তাঁকে মারতে পারেননি। এক জায়গায় বলেছেন, 'পরে সন্তোষ গুপ্ত আমার অনেকদিনের গুরু হয়ে গিয়েছিলেন।'

বন্ধুদের কাছে লেখাটি ইমেইল করতে নিচের tell a friend বাটন ক্লিক করুন: