হতাশা এবং মোটিভেশন বিক্রেতা

অয়ন দাশ
Published : 18 Jan 2017, 02:22 AM
Updated : 18 Jan 2017, 02:22 AM

মানুষ নিজেকে ভিক্টিম ভাবতে ভালবাসে। তাই তারা নিজেকে ডিপ্রেশড, ফ্রাস্টেটেড হিসেবে প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ভার্চুয়াল সোশ্যালিজম এর কল্যাণে ব্যাপারটা একটু বেশি ইজাক্যুলেট হচ্ছে। একদল মোটিভেশন ব্যবসায়ী অনেকটা সেই সহজাত নেতিবাচক আচরণকে কাজে লাগিয়ে নিজের ব্রান্ড ভ্যালু বাড়াচ্ছে। মোটিভেশনমূলক বইপত্র বেস্টসেলারের তালিকায় আসতে কোন গভীর দর্শন বা প্রজ্ঞা জ্ঞাপন করতে হয়না। ঠিক পর্ণোমুভির মতই মানুষের সহজাত উপলব্ধি ও এক্টিভিটিকে ক্যাপিটালাইলজিং করে অনেকেই বেশ ভালো ব্যবসা করতে পারেন 'মোটিভেশন' ফোকাসড কর্মকান্ড করে।

বাস্তবে আমরা দেখি যারা অরিজিনাল সাক্সেসকে এচিভ করেছেন তারা কখনো এসব তথাকথিত ইন্সপেরিয়েশনাল বা মোটিভেট বই, লেকচার কিছুই ফলো করেননি। অটো বায়োগ্রাফি পড়া বা মহৎব্যক্তির জীবনাদর্শন সম্পর্কে জানার জিনিসটা ভিন্ন। মহৎ মনীষীদের জীবনী পড়লে বা জানলে বুঝা যায় ভবিষ্যতের জীবনে কি হতে পারে বা পারেনা। আপনি ভাল মানুষের বায়োগ্রাফি পড়লে বুঝে যাবেন সঠিক ডিসিশন না নিলে ত্রিশ বছর বয়সে আপনার কোন সমস্যা হতে পারে।
কিন্তু মোটিভেশনাল আইটেমগুলো (বইপত্র, লেকচারস, ফেসবুকে মোটিভেশনাল নোটস) মানুষকে এক ধরনের মোহ জাগায়। চরম দূরাবস্থার সংকেত যখন মস্তিষ্কে যায় তখন মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারগুলোতে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। এই মুহূর্তে ওই মস্তিষ্ক যদি উদ্দীপনামূলক বা ইন্সপেরিয়েশনাল ইস্যু নিয়ে থিংকিং করার সুযোগ পায় তাহলে সাময়িকভাবে সে পারিপার্শ্বিক চিন্তাভাবনা থেকে একধরণের রিলিজ পায়। ফলে ডিপ্রেশড পারসন একটু চাপমুক্ত হয় এবং মনে সাহস পায় যে সে অনেক বড় কিছু করতে পারবে।

আফসোস, বাস্তবতা হলো কেউ যদি এই মোটিভেশনাল আইটেমগুলোর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তখন তার মোটিভেশনের নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হবার পরই ডিমোটিভেটেড হওয়াটা সহজ হয়ে পড়ে। এই নির্দিষ্ট মেয়াদ পারসন টু পারসন ভ্যারি করে।

পারসেন্টিজের হিসেবে খুব কম এবং খুবই লিমিটেড পারসেন্ট মানুষ এই মোটিভেশনাল বইটই পড়ে জীবনে হাই প্রোফাইলের ব্যক্তিত্ব হতে পেরেছে। তাই দিনশেষে নিজের জীবনদর্শন, নিজের চিন্তা-চেতনা অনুযায়ী কাজ করাই সবচেয়ে শ্রেয়। কারণ অন্য কারো পরামর্শ, মোটিভেশন সবার উপর সমানভাবে কাজ করবে না। অন্যের মতামত কারো পৌষমাস কিংবা কারো সর্বনাশ টাইপ জিনিস হয়ে ঘটবে। কেউ যদি কোন কারণে হতাশ হয়ে পড়ে তাহলে তাকে বুঝতে হবে ফ্রাস্টেশন জাস্ট একটা সিচ্যুয়েশন। আমরা যদি আমাদের ব্রেইন দ্বারা বার বার ডিপ্রেশড হওয়ার চর্চা করি তাহলে দামী মার্সিডিজে বসেও ডিপ্রেশন কাটবে না। এজন্য দেখা যায় অনেকসময় খ্যাতি ও ক্ষমতাশালী মানুষ প্রতিদিন এন্টিডিপ্রেশেন্ট আর স্লিপিং ড্রাগস নেয় আবার সাড়ে দশ হাজারের মাইনেতে চাকরি করা ছাপোষাজীবী কোনপ্রকার অসুবিধা ছাড়াই রাতে চটকদার এক ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দেয়।

পৃথিবীতে পণ্যবাদের এই মুহূর্তে যেহেতু মতামত জিনিসটা বেশ সস্তা তাই সবাই সবাইকে মতামত দেয় এবং মতামত নেয়। আরো সমস্যা হলো কেউ ব্যর্থ হলে জিনিসটার দাতাগোষ্ঠী আরো বেড়ে যায়। কিন্তু সাফল্যের শতকরা পঁচানব্বই ভাগই নির্ভর করে সম্পূর্ণ নিজের উপর।

একজন মোটিভেশন গুরু যেভাবে সাফল্যের মাপকাঠি নির্ধারণ করেন সবার লাইফে সেটা সমানভাবে প্রযোজ্য না। উনি দেখাবেন এই এই কাজগুলো করলে আপনি এতটুকু সফল হবেনই। কিন্তু বাস্তবে দেখাগেল একজন মানুষ বইয়ে উল্লেখিত ঠিক সেই সেই কাজ করে এর অর্ধেক সফলতাও অর্জন করতে পারছেন না। তখন তিনি আরো বেশি হতাশ হয়ে পড়বেন এবং আরো বেশি মোটিভেশনাল আইটেমের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়বেন। মোটিভেশনের দুষ্টুচক্র পৃথিবীতে বেশ কার্যকর। নইলে প্রতিবছর এত এত মোটিভেশনাল বই বের হয়, সেমিনার হয়-এতে মানুষের আত্মহত্যা, বেকারত্বের হার কমার কথা ছিল এবং ৩০ দিনে ধনী হন টাইপ বই পড়ে দারিদ্রতাকে পরাজিত করার কথা ছিল। বাস্তবে বরং ধনী দেশগুলো আরো ধনী হচ্ছে আর গরীব দেশগুলো তলানীতে মশা মাছি মারছে। তার কারণ ধনী দেশগুলো যে এসব বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে তা নয়; বরং তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পালটে যাওয়া পৃথিবীর রাজনীতি-অর্থনীতির কারণ।

তলানী থেকে কেউ যখন কলসীর প্রথমভাগে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাবে খুব সিম্পল লজিকালিই সে তখন জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। এভাবে একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরীক্ষায় নির্দিষ্ট সিট থাকে জানা সত্যেও অনেকেই সবাইকে পরীক্ষায় উৎরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখায়। স্বপ্ন দেখানোর প্রসেসটা বেশ গ্ল্যামারেবল। এজন্য সবাই এই গ্ল্যামারটা উপভোগ করে। দিনশেষে স্বপ্ন দেখানো মানুষটি অন্যের ডিপ্রেশন সাময়িকভাবে কাটানোর মাধ্যমে অথবা অন্যকে সাময়িক ঘোরের মধ্যে নাচিয়ে বিল্ড আপ করে নিজের ক্যারিয়ার আর মার্কেটিং।

আমি অনুপ্রেরণার পুরোপুরি বিরোধিতা করছি না। শুধু এটুকুই বলার ছিল অনুপ্রেরণাকে পুঁজি করে সফল ব্যবসা করা যায়। এই ব্যবসা অনেকটা লটারির টিকিট জেতার মত। পুরস্কার মাত্র দশ জন পেলেও টিকিট কিনবে দশ হাজার জন। নিজের জীবনকে নিজে যে যত উপলব্ধি করে কাজ চালিয়ে যাবে সে তত ভাল কিছু করবে। সবাই সবকিছু হতে পারেনা, কিন্তু ভিন্নজন ভিন্নকিছু হতে পারে। নিজের জীবনের চিন্তাচেতনা ও মূল্যবোধ অনেক বড় কিছু। মোটিভেশন একটা লাঠি হতে পারে মাত্র, সম্পূর্ণ পাহাড় বেয়ে উঠতে হবে নিজেকেই।