ক্ষমতায় ‘বিকল্প শক্তি’

রণেশ মৈত্র
Published : 26 March 2011, 07:02 PM
Updated : 22 July 2013, 08:20 AM

দেশের সকল প্রগতিশীল, বাম-গণতন্ত্রী মহল থেকে এক যুগের বেশি সময় ধরে একটি জাতীয় প্রয়োজনীয়তার কথা বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বলয়ের বাইরের প্রগতিশীল, বামপন্থী ও গণতন্ত্রকামী দল ও ব্যক্তির সমন্বয়ে বিকল্প গড়ে তুলে দেশে গণতন্ত্রের প্রকৃত বিকাশ ঘটানো এবং দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা। বিষয়টি প্রকৃত অর্থেই জরুরি এবং তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট দল বা ব্যক্তিদের মধ্যে কোনো দ্বিমত রয়েছে এমন কথা আজতক শোনা যায়নি।

এমন একটি বিকল্প গঠনের অনুকূলে যে সকল দল অভিমত প্রকাশ করে আসছে সেগুলো হল বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতন্ত্রী দল, গণফোরাম, গণতন্ত্রী দল এবং সদ্যগঠিত নতুন প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, পঙ্কজ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ঐক্যকামী) বা ঐক্য ন্যাপ। কমিউনিষ্ট পার্টিসহ বামদলগুলো দীর্ঘদিন আগেই একটি ঐক্য মোর্চা (দ্বিদলীয়) গঠন করে বৃহত্তর বাম-গণতান্ত্রিক ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে আসছে। অন্যরাও নিজ নিজ মঞ্চ থেকে একই আহ্বান জানাচ্ছেন।

সবাই বলছেন, প্রস্তাবিত এ ঐক্য হতে হবে নিম্নতম কর্মসূচির ভিত্তিতে। আর ওই কর্মসূচিতে জনজীবনের সমস্যা-সংকটের সমাধান, মেহনতি মানুষদের ন্যায়সঙ্গত দাবি-দাওয়া পূরণ, নারীঅধিকার বাস্তব অর্থে সুপ্রতিষ্ঠিত করা, নারীনির্যাতন কার্যকরভাবে প্রতিরোধ, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা প্রতিরোধ, সাম্প্রদায়িকতার অবসান ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতিকে কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠা, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জন্য দায়ীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিতকরণ ও তাদের বিরুদ্ধে প্রদত্ত রায়গুলোর আশু কার্যকরকরণ, আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকারের স্বীকৃতি এবং তাদের ভূমিঅধিকার সংবিধানে সংযোজনের জন্য তাবৎ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, জামায়াত ও হেফাজতকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষিদ্ধকরণ ও তাদের আয়ের যাবতীয় উৎস বাজেয়াফতকরণ প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত থাকবে। থাকবে দুর্নীতিমুক্ত দেশগড়ার অঙ্গীকার।

আমরা পাঁচ বছর পরপর বিভিন্ন নির্বাচনে আগ্রহসহকারে ভোট দিতে অভ্যস্ত হলেও ভোটের পর বছর বছর জানতে চাই না বিজয়ী প্রার্থী তাদের প্রদত্ত অঙ্গীকার কার্যকর করলেন কিনা। জানতে চাই না বিজয়ী দলটি ক্ষমতায় এসে প্রতি বছর তার অঙ্গীকারভুক্ত দফাগুলোর কতটা বাস্তবায়ন করলে, কতটা আংশিক বাস্তবায়িত হল আর কতটা সম্পূর্ণ অবাস্তবায়িত থাকল। জবাবদিহিতার সংস্কৃতি এ পর্যন্ত আমরা গড়েই তুলতে পারিনি।

এর পরিণতি দিনে দিনে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। না, অজান্তে বা আড়ালে নয়, দিব্যি সবার সামনেই হযেছে ভয়াবহ দুর্নীতি। বিদায় নিয়েছে আইনের শাসন। মুখ থুবড়ে পড়েছে সংসদীয় গণতন্ত্র। অকার্যকর হয়ে পড়েছে আমাদের জাতীয় সংসদও।

কী ঘটল তাহলে? বর্তমান সরকারের শাসনের পাঁচ বছরের মেয়াদ প্রায় শেষ হয়ে এল। আগামী নির্বাচনের আর মাত্র কয়েকমাস বাকি। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি সরকার শুরু করেছে তা হল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু। কিন্তু তার গতি দিন দিন যেন কমছে। ফলে সকল দেশপ্রেমিক মহলই উদ্বিগ্ন- কী ঘটছে ভেতরে ভেতরে?

দেশের আসন্ন নির্বাচন কে পরিচালনা করবেন? কোন সরকার? বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার কি? তাতে আপত্তি থাকত না কারও যদি তা সর্বসম্মতভাবে গৃহীত একটি সিদ্ধান্ত হত। এ সংক্রান্ত যে পঞ্চদশ সংশোধনী ২০১১ সালের ৩০ জুন সংসদে পাশ করা হয়েছে- সরকারের করণীয় ছিল তার আগে বিরোধী দলের সঙ্গে আলাপ করে তাদের সম্মতি গ্রহণ করা এবং তাদের উপস্থিতিতে তাদের সমর্থনে ওই সংশোধনী পাস করা।

বিরোধী দল কয়েক বছর ধরেই বলে আসছে কোনোমতেই তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্দলীয় সরকারের পরিচালনা ব্যতিরেকে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। এ অভিমত শুধুমাত্র বিএনপি বা ১৮ দলীয় জোটের- তা নয়। আরও অনেক ছোট ছোট গণতন্ত্রকামী মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দলেও। বহুবার তারা এ বক্তব্য তুলে ধরেছে।

তবে বিএনপি যেহেতু অন্যতম বৃহত্তম দল সেহেতু তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তা জাতীয় আন্তর্জাতিক কোনো পর্যায়েই যে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না তা সবারই জানা। তা সত্বেও সরকার এ ব্যাপারে জেদ ধরে বসে আছেন দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। কেন? তারা বলছেন দুটি কারণের কথা।

প্রথম কারণ হল, হাইকোর্ট একটি রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা সংবিধানসম্মত নয় বলে তা বেআইনি ঘোষণা করেছে। এ রায় যে হাইকোর্ট দিয়েছিল তা সঠিক। কিন্তু ওই রায়েরই অপর অংশে বলা আছে যে, আগামী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে। দুটি বড় দলের সম্পর্কের জটিলতার কথা ভেবেই যে মহামান্য আদালত অমন অভিমত দিয়েছেন তা সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু সরকার হাইকোর্টের এ বক্তব্য সম্পর্কে চুপচাপ।

দ্বিতীয় কারণ হল, সরকার বারবার বলছে যে সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা আর বলবৎ নেই; সুতরাং সংবিধানের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করা যাবে না, তাকে মেনেই করতে হবে। কথা হল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তো সংবিধানে ছিল এবং তার অধীনেই ১৯৯১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত সবগুলো সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমান সংসদও তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিচালিত নির্বাচনের মাধ্যমেই গঠিত। সে সংসদই আবার ২০১২ সালে এসে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি তুলে দেওয়ায় এ জটিলতা। সুতরাং প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা অসম্ভব কিছু নয়। বিষয়টি রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে।

মন্ত্রীরা বলছেন, বিরোধী দল সংলাপে বসলে আলোচনার মাধ্যমে জটিলতার নিরসন করা যাবে। কিন্তু যদি সরকার সংলাপের ব্যাপারে আন্তরিক হন তবে সংলাপ আয়োজনের ব্যাপারে সরকারকেই উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে আর কালক্ষেপণ না করে বিরোধী দলকে শর্তহীনভাবে সংলাপের আমন্ত্রণ জানানো সরকারি দলের জরুরি কর্তব্য। সরকার যদি সে উদ্যোগ গ্রহণ করেন, বিরোধী দলের উচিত হবে কোনো জেদাজেদি বা শর্ত না দিয়ে সমঝোতামূলক মনোভাব নিয়ে সংলাপে বসা।

মোট কথা, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে যে জটিলতা তাই কিন্তু রাজনীতির ময়দানে ব্যাপক সংঘর্ষ সহিংসতা, হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও প্রভৃতির জন্ম দিয়ে জনজীবন ব্যাহত ও অশান্ত করে তুলছেন। তাই এ বিরোধ আর জিইয়ে রাখা উচিত হবে না। রাখলে তার দ্বারা সরকার বা প্রধান বিরোধী দল কেউই লাভবান হবে না- লাভবান হবে জঙ্গীবাদী-উগ্রপন্থী জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের মতো নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠীগুলো।

কিন্তু কথাগুলো মানতে দেশের দুটি বৃহৎ দলই চরম অনীহা দেখাচ্ছে। অতীতে ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি ভোটারবিহীন এবং অপর সকল দলের অংশগ্রহণবিহীন নির্বাচন করেছিল। বিরোধী দলে ওই সময় থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনের দাবিতে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ক্ষমতাসীন বিএনপি নেত্রী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, "নিরপেক্ষ আবার কে? শিশু ও পাগল ছাড়া নিরপেক্ষ কেউ নেই।''

এ কথা বলে তিনি তখন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি উড়িয়ে দিয়েছিলেন। আবার আজ ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগই সে ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছে। বিএনপির তোলা ওই একই দাবি নানা অজুহাতে তারা মানতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে।

ক্ষমতায় থাকাকালে এক ধরনের কথা; বিরোধী দলে গেলে ঠিক তার উল্টো। এ ব্যাপারে উভয় দলের ভূমিকাই এক।

যদি দুর্নীতির ব্যাপারে আলোচনা করা যায় সে ক্ষেত্রেও মৌলিক পার্থক্য এ্ দুটি দলের মধ্যে আর চোখে পড়ে না।

বাহাত্তরের সংবিধান প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে মতদ্বৈধতা এতকাল ধরে ছিল– ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে 'বিসমিল্লাহ্' 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' প্রভৃতি বর্তমান সরকার সংবিধানে সংযোজন করার পর এবং জামায়াতে ইসলামীকে সংবিধানিক বৈধতাদানের পর তাও আর নেই।

অনুরূপভাবে বিএনপি যেমন জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট বাঁধে– আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ওই দলকে বৈধতাই শুধু দেয় না, সকল মহলের দাবি সত্ত্বেও ওই দলকে বেআইনি ঘোষণা করতে তাদের স্পষ্ট সম্মতি দেখা যায় না।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আস্থাশীল সকল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক মহল থেকে দাবি তোলা সত্ত্বেও শুধু জামায়াতে ইসলামীই নয়, হেফাজতে ইসলামের মতো ধ্বংসাত্মক সংগঠনকেও বেআইনি ঘোষণা করতে বর্তমান সরকার আগ্রহী নয়। এর অমোঘ পরিণতি জঙ্গীবাদী শক্তির নবউত্থান এবং তার সকল আলামত স্পষ্ট।

এক কথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আদর্শ, বাহাত্তরের সংবিধান এবং গণতন্ত্র– সবই আজ মারাত্মকভাবে বিপন্ন এই দুটি বৃহৎ দলের বর্তমান নেতৃত্বের হাতে।

তাই আজ নতুন করে ভাবতে হবে সকলকেই। যদি আমরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শসূচক বাংলাদেশ চাই, যদি চাই দেশে সাম্প্রদায়িক উগ্র জঙ্গীবাদের উত্থান কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করতে, যদি চাই প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ বা বাহাত্তরের সংবিধানের অবিকৃত পুনরুজ্জীবন, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ, নারী-পুরুষের সমঅধিকার– সর্বোপরি যদি চাই গণতান্ত্রিক ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ– তবে সকল প্রগতিশীল, বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বড় দু দলের সৃষ্ট বলয়মুক্ত একটি বিকল্প গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল মোর্চা গড়ে তুলতে হবে।

এ মোর্চা নিম্নতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কিশোর, যুবক, মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত, নারীসমাজ, শ্রমিক ও কৃষককে আহ্বান জানিয়ে জনস্বার্থে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে।

এ জন্য কিছুটা সময় লাগলেও লাগতে পারে। কিন্তু মানুষ তার অভিজ্ঞতা থেকেই ওই দুটি দলের বাইরে একটি নির্ভরযোগ্য দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তি খুঁজছে। তরুণপ্রজন্ম ও তাবৎ প্রগতিশীল শক্তিকে ঢাকা থেকে শুরু করে সকল জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যন্ত ওই ঐক্যবদ্ধ মোর্চাকে নিয়ে এক বিশাল গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে ১৯৭০-এর মতো দ্বিতীয়বার আরেকটি ব্যালট-বিপ্লব সাধন করা। তাতে দেশে গণতান্ত্রিক শক্তির বিপুল বিজয় সুনিদিষ্ট করা যায়।

নতুন করে অর্জিত সে বিজয়কে আবার যেন পঁচাত্তর বা বিরাশির মতো নতুন কোনো অগণতান্ত্রিক, অপ ও গণবিরোধী শক্তি ছিনতাই করে নিতে না পারে সেজন্য পাহারাদানের ভূমিকায় তরুণসমাজকেই সদাজাগ্রত থাকতে হবে। জনতার জয় অনিবার্য।

রণেশ মৈত্র : লেখক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক।