সত্তার ঐকতান

আজহার ফরহাদ
Published : 10 June 2015, 08:39 PM
Updated : 10 June 2015, 08:39 PM

: : সত্তার ‎ঐকতান : :

আমাকে আমি প্রশ্ন করতে পারি না কারণ, আমি উত্তর দেই; আমাকে আমি উত্তর দিতে জানি না কারণ, আমি প্রশ্ন করতে থাকি। আমি একইসাথে প্রশ্নকর্তা ও উত্তরদাতা নই, যেমন আমি একইসাথে বর ও বধূ নই; আমি যে কোনো একটি, আমাকে বেছে নেয় ‎প্রশ্ন কিংবা ‎উত্তর, আমাকে বেছে নেয় বর নয়তো ‎বধূ। আমি যতদিন পর্যন্ত না প্রেমিক, ততদিন আমি একপেশে, একপাক্ষিক, প্রশ্নকারী কিংবা উত্তরদাতা; আমার ধর্ম প্রেম, তাই আমি না প্রশ্নকারী না উত্তরদাতা, না বর না বধূ–আমি ‎প্রেমিক, তাই আমি পাগল, আমার ভেতর সবই আছে, আমিই আমার আনন্দউদ্যান, আমিই আমার স্বামী, আমিই আমার ‎স্ত্রী…

: : পরিণতি নয় আমি যেটুকু জানতে পারি : :

আমি আমার পরিণতির কথা জানি না, কিন্তু আমি জানতে পারি আমার পদক্ষেপের ধাপগুলি; প্রতিটি ধাপ যদি নিষ্ঠা ও আনন্দের সাথে পার হই, তবে আমি পাশ কাটাতে পারি পরিণতিকে; বলতে পার সে কেমন করে? হ্যাঁ, যেমন করে বিন্দু বিন্দু বৃষ্টিতে বিশাল মেঘমালার মৃত্যু ঘটে–সে যায় কোথায়? মাটিকে সিক্ত করে, জলাধারে পূর্ণ হয়ে, রৌদ্রের সাথে মন্থন হয়ে, ফের মেঘমালায়….

: : ভয় ও প্রেম : :

ভীতি সবচাইতে বড় হাতিয়ার, সে ধর্মে হোক বা রাজনীতিতেই হোক; নির্বোধকে তুমি ভয় দেখিয়ে কিছুকাল ঠিক রাখতে পারবে কিন্তু যে সচেতন তাকে কিছুতেই কাবু করতে পারবে না–শুরু হবে তার সাথে তোমার দ্বন্দ্ব, সে তোমার কথায় বিরুদ্ধাচারণ করবে আর তুমি প্রতিবারই চাইবে তাকে আরও ভীত করে তুলতে। দেখো, ভয় কার থাকে? শিশুর; ভয় তার কাছে বিষ্ময়কর, ভাবনার প্রস্রবণও, কিন্তু শিশু যখন বড় হয়ে ওঠে সে ভয়কে পরাভূত করে। মানুষ চিরকাল শিশু থাকে না, ভয়ও তার থাকবার কথা নয়, কিন্তু ভয় গচ্ছিত থাকে সমাজধর্মে–ভয় হচ্ছে সামাজিক 'রিজার্ভ ব্যাঙ্ক'।

ভয় নয়, সাহস নিয়ে বাঁচো। কারণ ভীতি থেকে মানুষ নিজেকেই হারিয়ে ফেলে, সে কি করে খোদাকে পাবে? শিশুকালের ভয়কে সমগ্রজীবন ধরে রেখে লাভ নেই, ভয় পরিণত হয়ে প্রেমে প্রকাশ না পেলে মানুষ গুটিয়ে আসে, সাহস পায় না ভালাবাসার নিকটতর হবার…

: : মৃত্যু : :

তুমি বেঁচে থাকবে কতদিন? কিন্তু তুমি অন্যের ভেতর দিয়ে বেঁচে থাকবে বহুদিন। এই যে অন্যের ভেতর দিয়ে বাঁচা, তাতে তোমার কি লাভ? যদি তুমি মনে করো এই দেহখানাই তুমি, তবে নয়, যদি মনে করে থাকো তোমার অস্তিত্ব তোমার স্থুলদেহের সীমানা পেরিয়ে অসীম, তবে আছে। তুমি অসীম, কিন্তু জান না, তাই তুমি সীমিত–তোমার ইচ্ছা, চিন্তা ও তৎপরতাও সীমিত; তোমার স্বপ্ন ও বাস্তবতাও সীমিত। যদি তুমি, তোমার জন্যই বেঁচে থাকতে চাও তবে মরবে সবার আগে, সে হবে অপমৃত্যু; যদি তুমি, তোমার অসীমতাকে আবিষ্কার করতে চাও তবে তুমি মরবে মরার আগে, সে হবে তোমার মহামৃত্যু–অজ্ঞানতার ধর্ম হতে, অসাড়তার অন্ধকার হতে…

: : সুন্দর : :

দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর যা মেলে, তার প্রতি আগ্রহ একটু বেশিই; এই অধিক আগ্রহ আবার অতি অনাগ্রহেও পরিণত হয়। মানুষ কি প্রাপ্তিতে তৃপ্ত? না কি প্রাপ্তির প্রচেষ্টা ও আশায়? কোথায়? দীর্ঘ পরিশ্রমের ফসল কেউই নিজে ভোগ করতে পারে না, প্রচেষ্টার যে পথ সেই পথে যে পাওয়া, তার কাছে বস্তুগত পাওয়া খুব বেশি কিছু নয়, কিন্তু প্রাপ্তি লাগেই, কিছু না কিছু, যেমন সুন্দর মুখশ্রীর অলংকার লাগে কিছু না কিছু, নয়তো তার সৌন্দর্য কিছু না কিছুর অভাববোধ করবে না, কিছু না কিছু অপ্রাপ্তির শূন্যতা তার ভেতর ক্রিয়া করবে না, সে স্বীয় সৌন্দর্যের ব্যবহারিক পরম্পরায় নিজেকে অাবিষ্কার করতে পারবে না। ব্যবহারিক কিছু না কিছু তাৎপর্য যদি না থাকে তবে অন্তরের সৌন্দর্যকুসুমের দিকে হাত বাড়াবার দায়ও তার থাকে না।

ব্যবহারিক জীবনকে উপেক্ষা করতে নেই, তাকে অনুভবযোগ্য ও শ্রীময় করে না তুলতে পারলে ভেতরের দরজাগুলি বন্ধ হয়ে যায়, ঘরের ভেতর যেমন বাইরেও তেমন রঙ লাগাতে হয়। অন্তরের যে সুন্দর, সে বাইরেও সুন্দর, কিন্তু ভেতর-বাহিরের সেই সুন্দরকে কেমন করে বুঝবে যে সে একাত্ম? যখন দেখবে সুন্দর, অলঙ্কারকে ছাপিয়ে গেছে, আভরণকে পার হয়ে গেছে, মনেই হয় না কোথাও কোনও অতিরঞ্জন, সহজ ও সাধারণ সে, কৃত্রিম নয়…

: : অভিজ্ঞতা : :

অভিজ্ঞতার বিকল্প নাই, কিন্তু সবাই তা নিতে পারে না; অভিজ্ঞ হবার জন্য ‎পর্যবেক্ষক হওয়া জরুরী। কেবল খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকলে আর অভিজ্ঞতা এসে তোমার দুয়ারে কড়া নেড়ে যাবে তা নয়, বরং খুব কাছে এসেই সে চলে যাবে অনভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে তোমাকে। যার পর্যবেক্ষণশক্তি অধিক তার অভিজ্ঞতা দীর্ঘতর; প্রশ্ন করতে পার, অভিজ্ঞতা দিয়ে কি করবো তবে? কিছু না, কিছু করতে হবে না, কেবল অর্জন করো, অর্জন করাটাই অনেক বড় কিছু, নিজেও টের পাবে না কোথা দিয়ে কতখানি করে ফেলেছ তুমি…

: : সংঘাত : :

সংঘাতহীন জীবন শক্ত নয়, মাটির হাঁড়ি যেমন পোড়া নয়; জীবনের সংঘাত দেখে চোখে আর নাকে জল এনে লাভ নেই, তোমাকে জল মুছে সেই সংঘাতের ভেতরেই লড়াই করতে হবে। ঝড়ে দেখবে আমগাছটি নাই কিন্তু সরু ওই সুপারি গাছটি যাকে এমাথায়-ওমাথায় আছড়ে মেরেছে হাওয়া, সে ঠিকই শিরদাঁড়া খাড়া করে বেঁচে থাকে; সহজ জীবন বেছে নাও, জটিলতার বাইরে, দেখবে সংঘাত সহজেই তোমাকে কাবু করতে পারছে না…

: : ‎নতুন : :

নতুন কিছু করতে চাইছো? আগে পুরনোটা করে দেখ, পার কি না? অপরীক্ষিত সত্তা নতুন কিছুই করতে পারে না, যেমন অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষ পড়তে জানে না; কিন্তু সেও পাঠ করে, তার নিজের মতো করে প্রকৃতিকে পাঠ করতে চায়, সে জ্ঞানীও হয়, যে জ্ঞান প্রকৃতি তাকে একটুখানি আলাদা করেই দেয়। কিন্তু তার এই পাঠপরম্পরা কি নতুন কিছু? না সে অন্তরঙ্গ, নিবিড়তম, নিষ্ঠাবান? তুমি নতুন কিছু করবার আশা বাদ দাও, কেবল মনোসংযোগ ঘটাও, যেখানে তোমার ভাল লাগে, যেখানে তুমি দীর্ঘসময় কাটাতে পার; দেখবে, নতুন একটি মানুষরূপেই জন্মলাভ ঘটছে তোমার…

: : ‎মাঝি : :

আশপাশের জীবন ও জগতের চেহারা পাল্টালেই যে জীবন বদলে যাবে এমন নয় তো। মানুষের দুঃখের জগত যেন শেষ হতে চায় না কিছুতেই, সুখ যেন স্থায়ী নয় তার জীবনে–এমন কি? না, একটিবার ভাবো, দুঃখই সত্য, তারপর দেখবে সুখের আর তোমার দরকার নাই, সুখ হচ্ছে পিছল পথ, যে পথে চলতে হয় খুব ধীরে, নয়তো পা পিছলে হাঁটু ভেঙে যাবার উপক্রম; যে পথের শেষে আছে একটি নদী, নদীর ঘটে বাঁধা নৌকা, সে নৌকায় তুমি যেতে পার সুখের ওপারে, ওইখানে দুঃখ নাই জেনেছো তুমি; পিছল পথের দায় ঠেলে যখন নদীতীরে এসে পৌঁছালে তখন দেখলে যে তীরে বাঁধা একটি নৌকা, মাঝি নেই, কারণ, চিত্তসুখের নৌকা তুমি নিজেই চালাতে চাও, তোমার মতো আরও অনেকেই পৌঁছে গেছে নদীতীরে, সুখের পারাপারের আশায়।

তোমরা জড়ো হলে, সকলেই যেন মাঝি, কেউ যাত্রী নও, সকলেরই পারের আশা কিন্তু অন্যের যাত্রার মাঝি হতে চাও না, কারণ, সে তোমার সুখে ভাগ বসাবে। তোমরা বসে রইলে দীর্ঘক্ষণ, পিছল পথের বেদনাকে ভুলে গিয়ে, সুখের কাছাকাছি এসেও দুঃখিত, নৌকা একখানি, মানুষ অনেক–কেউ খোঁড়া, কেউ বিমর্ষ, কেউ অচল, কেউ ক্ষুধার্ত, কেউ পাগল কিন্তু কেউই মাঝি নও, কারণ মাঝি হতে গেলে শান্ত ও বিক্ষুব্ধ জলের পরিচয় জানতে হয়–জোয়ার ও ভাটার পরিচয় জানতে হয়–রোদে পুড়ে শীতে জমে শক্ত হতে হয়–দুঃখ ও সুখের নিত্যজীবনকে ভালবাসতে হয়–তোমরা সেই জীবনকে পাশ কাটিয়ে এসেছ, নিরন্তর কাটাতে চাও…

: : পথপার্থক্য : :

সমুদ্রের, নদীর, পুকুরের একই ঢেউ কিন্তু চরিত্রের কত পার্থক্য! একই জল অথচ স্বাদের কত ফারাক! এই চরিত্র ও স্বাদে ভরা জগত চরিত্র ও স্বাদের বিভিন্নতায় একই প্রকৃতির ভেতর অভিন্ন না হয়ে উঠতে পারলে প্রকৃতির অনুরাগ-সংঘাতের মর্ম কেমন করে বুঝবে? হয়তো কেউ স্নেহে দিশা খুঁজে পাবে, হয়তো কেউ পাবে আঘাতের মাঝেই আপন অন্তরের দেখা; প্রকৃতির নিজের ছাঁদে গড়া মানবমন, কে জানে সে কোন পথে বিকশিত হবে? আমাদের পথ আমাদের ভেতর থেকেই বের হয়, পথের ভেতর থেকে আমরা বের হই না…

: : প্রতিক্রিয়াশীলতা : :

প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারার ভেতর যেন সক্ষমতা, না দেখালে বুঝি লোকটি নির্বোধ, ভীরু, অচেতন; প্রতিক্রিয়াশীলতা মানুষের স্বভাবগত, কেউ মনে করিয়ে দেবার প্রয়োজন নাই তাকে যে তুমি প্রতিক্রিয়া দেখাও; কিন্তু, কথা হলো প্রতিক্রিয়া আসলে কি? কেমন তার চেহারা? কেবল কথা দ্বারাই তার প্রকাশ ঘটবে তেমন নয়, চিন্তার ভেতর দিয়ে সে মানুষকে টেনে নেয় অস্থায়ী বা স্থায়ী পতিতাবস্থায়। প্রতিক্রিয়াশীলতা নয় প্রতিক্রিয়াহীনতাই পরম-যোগ্যতা; প্রতিক্রিয়াহীন মানুষ কল্পনারও অতীত মনে করা ঠিক নয়, সে আছে, আমাদের আশেপাশেই, যাকে আমরা ওই যে–নির্বোধ, ভীরু, অচেতন বলে উপহাস করি, মনে করি সে চলাচলের অযোগ্য, কিন্তু যদি একবার তাকে বুঝতে পারি প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে, দেখা মিলতে পারে এক সন্তোষপূর্ণ ও আনন্দময় সত্তার–সে হয়তো জানেও না কি বহন করছে নিজের ভেতর, বহুসাধনার ধন যা, বহুবাসনার পণ তা…

: : রসিকতা : :

রসিকতা করতে পারা সাংঘাতিক যোগ্যতা বটে, কিন্তু কথা হলো ওই যে–‎সাংঘাতিক! অধিকাংশ ক্ষেত্রে রসিকতা পরমরমণীয়তার বদলে নিতান্ত রমণীয় হয়ে ওঠে, যার ভেতর রসবিকৃতির বাজার বসে। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত মহাপুরুষ পরমরসিক ছিলেন, তাঁদের সুক্ষ্ম রসিকতাকে লোকে সহজে বুঝে নেবে সে সুযোগ কোথায়? হেসে হেসে জীবনের পরমসত্যকে প্রকাশ করতে পারা সেই সাংঘাতিক যোগ্যতা যা কাউকে সমপরিমাণ শত্রু-মিত্র দ্বারা পরিবেষ্টিত রাখে সর্বদা। এরা হচ্ছেন সেই বিরলতম প্রতিভা, মৃত্যুকেও যারা সহাস্যে পান করে নেন…

: : সুযোগ : :

যে বলছে, যে বলতে চাইছে, যে বলতে পারছে না; যে লিখছে, যে লিখতে চাইছে, যে লিখতে পারছে না; যে দেখছে, যে দেখতে চাইছে, যে দেখতে পারছে না; যে ভাবছে, যে ভাবতে চাইছে, যে ভাবতে পারছে না–তাকে সুযোগ দাও আরও একটু, তোমার পক্ষে যতখানি সম্ভব কারণ, যে বলতে, লিখতে, দেখতে, ভাবতে চাইছে না সে তোমাকে তার বন্ধুতে পরিণত করবে যথাশীঘ্রই…

: : তৃপ্তি : :

পরিতৃপ্ত হওয়া আসলে হয় না অবশেষে; আমরা তৃপ্ত হতে পারি আমাদেরই সীমাবদ্ধ জীবনে, একটি তৃপ্ততা আরেকটি অতৃপ্তির দিকে ঠেলে দেয়। খণ্ড-খণ্ড জীবন যারা কাটাতে চান তাদের কাছে এমন তৃপ্ততা প্রমোদজনক কিন্তু নৌকার বদলে কাষ্ঠখণ্ডে শরীর ঠেকিয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকবার তৃপ্তি যাদের আছে তারাও কি অসামান্য তৃপ্ত নয়? ঠিক, কিন্তু সংকটের ভেতর ডুবে থাকা মন সামান্য আশার আলোকেই মহাতৃপ্তিময় করে তোলে, সুখের চারদেয়ালে বন্দী জীবন সে তৃপ্তি পায় না। এই যে আমরা কথায় কথায় আত্মতৃপ্তি বলি, অথচ তার পরিচয় জানি না, নানানরকম তৃপ্তিবোধকেই আত্মতৃপ্তির সমার্থ বলে মনে করি; কিন্তু যে তৃপ্তি পরক্ষণেই মনকে অতৃপ্ত হবার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে না তা যে আসলে তৃপ্তিই নয় সে বুঝতে পারি না। আমরা আসলে তৃপ্তির ভান করি, কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যাই যে অতৃপ্ত নই, যখন টের পাই তখনও সেই তৃপ্তির ছায়া হিসেবে জীবনকে পরিচালিত করি, কিন্তু ভুলে যাই তৃপ্তি মানুষের ছায়ামাত্র–মানুষ তৃপ্তির ‎ছায়া নয়…

: : ধর্ম : :

দেখো ধর্মটা আসলে কি? সংস্কার? সংস্কৃতি? বিশ্বাস? লোকাচার? না কি অন্যকিছু? ধর্ম ছাড়া কিছু আছে জগতে? ধর্মহীন সত্তা বিজ্ঞানসম্মতও নয়। ধর্ম থাকেই, সে মনের হোক দেহের হোক, চেতন বা অচেতনেরই হোক। কিন্তু ধর্ম নেই কোথায় সে যায়গাটি আগে খুঁজে বের করো, খুব ভাল করে লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবে ধর্ম কেবল একটি স্থানে থাকে না, সে হলো আস্থাহীনতা–সে খুঁজে পায় না তখন তার নিজের ধর্ম। প্রতিটি মানুষের নিজস্ব একটি ধর্ম থাকে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সেই ধর্ম আস্থার সুতা দ্বারা সেলাই হয়ে একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধর্মে রূপলাভ করে, কিন্তু যে মানুষটির অন্তরে প্রথম কুঁড়ি মেলে যে ধর্ম, সে মানুষই যদি হারিয়ে যায় তবে অধর্মই ধর্ম হয়ে ওঠে…

: : ‎যুক্তি ও মুক্তি : :

যুক্তি আসলে কি? ভেবে দেখেছো? যুক্তি হলো আসলে তোমার নিজের সাথে পরামর্শ–আমরা কথায় কথায় বলি না যে, যুক্তি করা কারো সাথে? তেমন একটা কিছু। এটা হলো যুক্ত হওয়া আর কিছু নয়। সে তুমি অন্য কারো সাথে হও বা নিজের সাথে, যুক্তি হলো যুক্ত হয়ে চলা। মানুষ আসলে যুক্তিহীন জীবন কাটাতে পারে না কিছুতেই, সম্ভব নয়। কিন্তু সে যুক্তিখানি নিজের চাইতে অন্যের সাথেই ঘটে বেশি। আর যুক্তিতে যেমন সুভাব থাকে তেমনি ষড়যন্ত্রও থাকে। যুক্তির অভাব আছে বলে আমার মনে হয় না পৃথিবীতে।

অভাব সে কেবল মিলনে। যুক্ত হয়ে আছে যারা তারা যে মিলিত হয়ে আছে সে কথা নিশ্চয়তার সাথে বলা যায় না। যুক্তির অভাব আমি দেখি না কোথাও, দেখি মিলনের, সম্মিলনের, একাত্মতার অভাব। এই অভাবের শুরু কোথায়? নিজের সাথে যুক্ত না হতে পারা। আর নিজের সাথে একবার যুক্ত হয়ে গেলে আর যুক্তির প্রয়োজন ঘটে না, সে তখন মুক্তিলাভ করে বুদ্ধিনির্ভর, কূটকৌশলনির্ভর, মনোরাজনীতিনির্ভর দুর্বল জীবন হতে, যে জীবন তাকে যুক্তির দাসত্ব দিয়েছে কেবল কিন্তু মুক্তি দিতে পারে নি…

: : আস্থা ও ‎সংস্কৃতি : :

বিশ্বাসমাত্রই যে পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাস তা নয়, দ্বিধা দিয়ে তো আর বিশ্বাস টেকে না; বেশিরভাগ বিশ্বাসীরাই এমন? নইলে জীবন এত হতাশ কেন? এত দ্বিচারিতা, আস্থাহীনতা? আস্থাহীনতাই বড় সমস্যা, মুখে বিশ্বাস আর অন্তরে বিশ্বাস এক নয়, আবার অন্তরের বিশ্বাস সকল ক্ষেত্রেই সমান হয় না, বিষয় হতে বিষয়ে বদলে যায়; অন্ধবিশ্বাসটা আসলে অন্ধ বলে তা নয়, ওটা অজ্ঞানতা–অন্ধবিশ্বাস বলে কিছু নেই, যেমন অপসংস্কৃতি বলেও কিছু থাকে না, সে হতে পারে সংস্কৃতিহীনতা। দেখবে যে বিষয়গুলিকে আমরা অপসংস্কৃতি বলে মত দেই তা কিন্তু না ভেবেই বলি, কিন্তু এমন কিছু ট্রেন্ড বা সংস্কার আছে সেসব গভীর বিশ্বাস বা আস্থা দ্বারা চলে না, চলে থাকে ওয়েভ বা ঠেলায়–সেগুলো সংস্কৃতি নয়, সে হতে পারে সংস্কৃতিহীনতা; এখন এটাকে যে নামই দাও। আসলে সংস্কৃতি বিষয়টা খুব মৌলিক, এর ভেতরে সংঘাত নাই কিন্তু ঝাঁকুনি আছে, সংঘাতটা থাকে অজ্ঞানতায় আর সংস্কারে…

: : ‎বাসিন্দা : :

যত উপর থেকে ঝাঁপ দেয়া যায় তত জলের গভীরে নামা যায়, কিন্তু তারপর? শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, ফের ওই ছন্দেই উঠে আসতে হয় দম নিতে; এইজন্য জলের বাসিন্দা হওয়া জরুরী, যাতে ডুবে গেলে দম বন্ধ না হয়…

: : দেহসুরযন্ত্র : :

যে তার ছিঁড়ে যায়নি, তাকে টিকিয়ে রাখতে হলে সাবধানী হতে হয়; নতুন করে তার বাঁধার আগে সবাই ভাবে ছিঁড়ে যাক, লাগিয়ে নেবো, এটাই ভুল; সাধকের সফরখানি, তাঁর পথখানি যে এক তারেই পার করে দেবে সুরগঙ্গা–তার প্রস্তুতি নিতে হয়; ভিতরে দহন কিন্তু আঙুল শান্ত, তার চাইছে ছিঁড়ে যেতে আঙুল বলছে না, মন আর তার যে একই; যেদিন গুরু দয়াময় এসে নিজেই না এই তার ছিঁড়ে ফেলেন সেদিন পর্যন্ত তা রক্ষা করতে হয়; সুরযন্ত্রখানিই তো এই দেহ…

: : শিল্প ও ‎শিল্পী : :

‎আর্ট কোথায় হারিয়ে গেল? মানুষ কই? চৈতন্যের চাইতে বুদ্ধি বেশি, জাগরণের চাইতে প্রতিক্রিয়া বেশি। প্রতীকের বাইরে যেতে পারবে না তুমি, আর প্রতীক আপনা হতেই গড়ে ওঠে; দেখবে যত বেশি মূলের কাছাকাছি তত বেশি সিম্বলিক, আমাদের বিমূর্ত চেতনাও কিন্তু এই প্রতীকের ভেতর দিয়ে প্রচ্ছন্ন। শিল্পীমাত্রেই তার প্রয়োজন আছে, তার অন্তর্গত সত্তা, বিরাট বিশ্ব, যেটা গুহাচিত্রকলায় মেলে, এ নতুন কিছু নয়–অন্তর্গত সত্তার জাগরণ। ভেতরখানা যদি শুকিয়ে যায়, তখন মানুষ সমসাময়িক হতে চায় কিন্তু সার্বজনীন না হলে কিছু সমসাময়িক হতে পারে না, একান্ত মনবৃত্তিগত চিত্রকলা আর্ট নয়, একটা খসড়াকল্প হতে পারে; আর্ট হতে হবে সর্বব্যাপী, সত্তাকে উন্মোচিত করবে তা; আমি খুব বিশ্বাস করি, শিল্পী নিজেও জানে না যে তার ভেতর কি আছে? কি করবে সে? যদি তার ভেতরের জগত উন্মোচিত হয়, তবে সে সহস্রধারায় প্রবাহিত হতে পারে, আটকাবে না।

শিল্পী হয়ে উঠতে হয়, মানুষ মাত্রেই তার প্রয়োজন, কেবল ছবি আঁকলেই শিল্পী?

: : নীরবতা : :

নীরবতা গড়ে ওঠে কেন? ভাঙবার জন্য; কেন ভাঙে? সে একখানি ধাপ, আরেকটি নীরবতায় প্রবেশ করবার জন্য; ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নীরবতা হতে গভীরতর নীরবতায় প্রবেশাধিকার এইভাবেই ঘটে…