দর্শন ও আত্মদর্শনের পথে

আজহার ফরহাদ
Published : 16 June 2015, 11:05 AM
Updated : 16 June 2015, 11:05 AM

: :  প্রথম ভাগ  : :

১.

তিনি দুয়ার খুললেন, গতকাল হতে আমার জন্যে কয়েকটি গান তৈরি করলেন, আমি সেই গান হতে আমাকে আলাদা করতে পারবো না জেনে তার প্রতিটি তান, সুর ও ভাবনামার্গকে এমন ছাঁদে বুনলেন যেন ইঁদুর ধরার কল! অন্ধকার ঘরে তাঁর চরণ ধরতে গিয়ে দেখলাম কতগুলি পিঁপড়ে, তেলাপোকা, উচ্ছুঙ্গে জড়ো হয়ে প্রণাম করছে তাকে। তাদের পেছনের কাতারে ঝুঁকে পড়লাম। পরমেশ্বর আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন, দুয়ার যে খুলে এলে তা বন্ধ করবে কে?

দুয়ার বন্ধ করতে গিয়ে দেখলাম সৎসঙ্গী সারমেয় মাথা দুলিয়ে না-না করে উঠছে! বুঝলাম তারও সঙ্গতি এইখানে। জন্মাবধি কোনো গান গাইবার সঙ্গতি যদিও আমার নাই, তবু গানে আমি মাংস, রক্ত ও চামড়ার বেষ্টনী ছেড়ে হাড়ময় হয়ে উঠি, দয়াময় এভাবেই যে শেখালেন; বুঝি এ কারণেই তিনি সারমেয় মহারাজ হাড়ময় রূপে ওঁৎ পেতেছেন…! একদিন তাকে সবটুকু দিয়ে বলবো, নে–খা… আমায় মুক্ত কর। ফকির গান ধরলেন, কীটপতঙ্গেরা চলে গেলেন যে যার স্থানে, কারণ আমি যখন নেচে উঠবো এরা জানে, এদের রক্ষে নেই। কারণ, রক্ষে যে আমারও নেই!

রক্তগুলো মাটিতে কাদা হয়ে আছে, ফেলে রাখা চাদরের মতো চামড়া ও মাংসের দলা হতে সজ্ঞান তরঙ্গ বলছে–মাওলা আলী, আর যে বল্গাহীন দেহমচ্ছব তার হাড়গোরের ঠনঠন্ নৃত্যে এই গৃহশ্মশান হতে অনন্তের তালবাদ্য ছুটছে–

উড় যা, উড় যা হন্স আকেলা

জগদর্শন কা মেলা, জগদর্শন কা মেলা। –ভক্ত কবীর

২.

বিষ্ণুপুরের ধারে কাছে কোথাও শীত বাসা বেঁধেছিল, জঙ্গলে। তখনও পৌষ আসেনি কার্তিকের শেষ। জঙ্গলের ধারে যে বাসাটি তার পেছন দিয়ে একখানা পথ যেখানে গিয়ে মিলেছে সেখানে লাল শালিগ্রামের মতো আশ্চর্য কিছু ব্যাঙের ছাতা পথ আগলে ধরেছে। এই পথ অনন্তের পানে গেছে কিনা তখন টের না পেলেও এখন বুঝতে পারি, পথিক ঠিকই গিয়েছেন।

 যে পুকুরটি গিলে ধরেছে কালো জল তার ভেতর যে কত আলো জ্বলছে সে আমি দেখেছি। এই গোঁসাই পুকুরে কারো অনুমতি নেই নামবার। কেবল গোঁসাইরা যখন নামবেন জলে আর ডুবে যাবেন ধীরে, একটা রাজতরঙ্গ তুলে আলো জ্বলে উঠবে জলের যোনীতে! কেবল এটুকু দেখবার স্বাধীনতা ছিল, বাকিটুকু দেখেছিলাম রাতগভীরে নেমে। যে রাজহাঁসটিকে দেখেছিলাম উড়ে যেতে, তাকে দেখেছি কি করে জল হতে দুধ শুষে নিতে! তার পাখায় ঈন্দ্ররেণু যেন মেঘ কামড়ে ধরতে চায়। এইখানে শতশত হাঁস, শুভ্র ও জ্যোতির্ময়! এই্খানে একা আমি, উড়বার ক্ষমতা নেই, পাখার পাখোয়াজ নেই।

 দূর হতে মা ডাকলেন, তিনি কি জানেন আমি জগজ্জননীর ডাকে এইখানে? অসংখ্য হাঁসের ভিতর একটি হাঁস!

 ৩.

মধুর দেলদরিয়ায় ডুবিয়ে করোরে ফকিরি,

করো ফকিরি ছাড়ো ফিকিরি দিন হলো আখেরি। –ফকির লালন

–ফকির গান গাইতে লাগলেন। আমার হাড়ের তানপুরায় সে গান গেঁথে রইলো। গুরুকর্ম রাতভর নৃত্যে-গানে মগ্ন হলো। এইঘরে এসে জুটলেন মা ফাতেমা। সঙ্গে দুই দুলাল। কইলেন না কিছুই, কেবল আমার নৃত্যে ফকিরের কণ্ঠে পরমেশ্বরের গান মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগলেন। আমার ফেলে রাখা চামড়া ও মাংসের দলা, রক্তের কাদা দেখে তিনি কাঁদতে লাগলেন। কেবল হাড়ের দেহখানা রেখেছি তার জন্যে, বাইরে যে সৎসঙ্গী সারমেয় বসে আছেন তার দৃষ্টি এতক্ষণে পার হয়ে গেছে আসক্তির কামাখ্যানগর, সে এখন কামরূপ দৃষ্টিকে নির্মোহ সন্তাপ দ্বারা মুছে নিয়েছে, সেও কাঁদছে…।

কিছুদিন পর কারবালা। আকাশ লাল হয় পৃথিবীতে। এইদিন।

৪.

মানুষের দেশে যাবার সাধ হলো একবার। মাটির ঘর ও সংসার ছেড়ে যাওয়া হলো না। মানুষের ঠিকানা জানবার কত চেষ্টা, কত আগ্রহ, কত ব্যকুলতা! সকলি বৃথা হলো? না।

মা আবার ডাকলেন। আমি গুরুত্বই দিলাম না। বাস্তুসাপের মতো পড়ে রইলাম সকলের অগোচরে। কিন্তু জানি এ গৃহী মানুষেরা, বস্তুসঞ্চয়ীরা গভীর গর্ত হতে টেনে বের করবে আমাকে। আমি তা হতে দেবো না। মা-র ডাকে সারা দিই কেবল তখন, যখন মাতৃস্তন্য পান আমাকে টেনে নিয়ে যায় দুগ্ধপোষ্যতার মায়াঘরে।

অমৃতের বাসনা থাকে না থাকে চাহিদা, তাকে পেতে হয়। জগজ্জননীর কোলে যেতে হয় মায়ার বাসনা ফেলে একান্ত প্রয়োজনে, সে প্রয়োজন যে মাতৃরূপে প্রচ্ছন্ন সে বিশ্বরূপ, কোল হতে কোলে যা লীলাময়! তাকে খুঁজে পেতে মানুষের দেশে যেতে চেয়েছিলাম। তাই পথ। না হলে পথ নেই, পথিক কেবল ভ্রম। ভ্রম ও ভ্রান্তি হতে মুক্তি পেতে মুখ ডুবিয়েছিলাম গোঁসাইপুকুরে। ব্রহ্মাণ্ড নড়ে উঠেছিল। যা দেখেছি তা বলা যায় না।

কেবল নির্বাক থেকে যাই। কথার মোমে আর আগুন জ্বেলে কি কাজ? শীতকাল আসছে। বিষ্ণুপুরে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠছে কুয়াশায়। বাঁশঝাড় হতে ঝরে পড়ছে শুকনো পাতা, আমি কুড়াতে যাচ্ছি। মা রাঁধবেন, ঘরে চাল নেই, আছে খুদ। আজ খিচুড়ি রান্না হবে। শুভ্র ও জ্যোতির্ময় হাঁসগুলি মাঝে মাঝে আমাদের খোয়াড়ে ডিম রেখে যায়, একটি তার ভাজা হবে।

৫.

পশ্চিমে বেনোজল বেয়ে হাঁসগুলি ধানক্ষেত তছনছ করছে। তারি মাঝে দু'একটি পানকৌড়ি, কানিবক, কাদাখোঁচা ঘাঁই মারছে। ভোর হতে এইখানে জমেছে মাছবাজার। আকাশ গুড়গুড় করছিল, আষাঢ়ের দিন, বিকেল হয়ে আসছে, সন্ধ্যাও এলো। মা বললেন আয়, মাছ ধরবো। এক একটি গুড়গুড়ানিতে ৩-৪টে কই লাফিয়ে উঠছে। এমন করে মাছ ধরতে গিয়ে রাত হয়ে এলো। আমাদের সঙ্গী হয়ে গাছের খোড়ল হতে বেরিয়ে এলেন সাপগুলো। মা বললেন, এইবার থামো বাছা। ঢের হয়েছে।

ওই যে নারকেল গাছটির নিচে, চালতা গাছের নিচে, হিজলবনের ধারে আমাদের বাসা; সেইখানে আমরা খেতে বসেছি। পাতে শুভ্র ও জ্যোতির্ময় ভাত, কই ভাজা, মা খাওয়াচ্ছেন। খেতে খেতেই ঘুম নেমে এলো, ঘুমের ভেতর রাজহংসের পাখা মেলে ধরলো বিছানা। রূপ হতে অরূপে এসে দেখি, যাদের মানুষ ভাবছি এরা সব পশু, হিংস্র, বীভৎস! তারি মাঝে কয়েকটি শিশু ডাকছে আমায়, মানবজন্মে এরা নিতান্ত সরল, বাঁচতে চায়।

পরদিন আমাকে খুঁজে পেলাম শেয়ালকাঁটার জঙ্গলে। গায়ে হাঁসের পালক লেগে। নিশ্চয় এইখানে ফেলে রেখে গেছেন। একটা উঁইঢিবির চূড়ায় উঠে আমার অবস্থা দেখছে কয়েকটি মাদালী। দেখলাম মুহররমের ঘোড়াটি কাছেই ঘাস খাচ্ছে। মনে পড়লো তাকে একবার পাখা লাগিয়ে বোরাক বানিয়েছিলাম, সে ভেবেছিল তাজিয়ার বাহার। গোঁসাইপুকুর হতে কিছুদূর গেলেই নকী মিঞাঁর আস্তানা। সে মাংস বেচে। কিন্তু তার আশুরার প্রেম, তাজিয়া বানায়, মাতম করে, রক্ত ঝরায়। মানুষ নানা কথা বলে, কিন্তু আমার বেশ লাগে। কে হাসান, কে হোসেন, কে ফাতেমা, কে আলী, পাক পাঞ্জাতন কিছুই বুঝি না, তবু একটা সূত্র খুঁজে পেলাম ইতিহাসের। আর সে ইাতহাস কোনো গ্রন্থে লিপিবদ্ধ থাকে না। তাই কাগজে আমার বিশ্বাস নেই, আস্থা আছে মানুষে।

৬.

লাগাম ছেড়ে দেয়া ঘোড়ার পিঠে ফকির রতন শা ছায়াশরীর। মায়াপুর হতে একটা পাখি হাতের পিঠে বসিয়ে, অমাবশ্যার চরাচর ধরে মধ্যবিলে উদাস। গুরুকর্ম সারা হয় নি, পাখিটিও ছেড়ে দেবার সময় হয় নি। এই অন্ধকার ও লালকাপড়ে ঘেরা দেহ দাঁড়িয়ে আছে নিথর। আমি ডাকলাম, ফকিরের হাত হতে উড়ে এসে পাখিটি ধাওয়া করলো আমায়। কিছুদূর দৌড়ে থামলাম, পাখিটিকে হাত বাড়িয়ে ধরতে চাইলাম, আকাশ ফর্সা হয়ে এলো, দেখলাম না কিছুই।

ফকিরকে খুঁজে পেলাম কাক তাড়াচ্ছেন। ভোরের আকাশ হতে প্রথম সূর্যকণা চিদানন্দরূপী পাখিটির ঠোঁট ছুঁতেই কাকগুলি চিৎকার করে উঠলো, উড়তে থাকলো জন্মান্তরের অবলুপ্ত চেতনার ধারাবাহিকতায়, অবলীলায়। ফকির তাড়াচ্ছেন কাক, আমি তাড়াচ্ছি বিস্মৃতির খান খান হয়ে যাওয়া ভঙ্গুর অস্তিত্ব। দেখা না দেখার পরম্পরা হতে বেরোতে গেলাম, পারলাম কই? তোমার পরিধি আরও জড়িয়ে ধরলো আমায়। মুক্ত হতে চেয়ে যুক্ত হলাম সমগ্রে। অচেতন হতে চেতনে। অন্ন হতে পরমান্নে।

তোমার আনন্দকে ভাগ করতে গিয়েই দেখলাম তা কেমন করে বেদনায় পরিণত হয়। তোমার বেদনাকে ভাগ করতে চাইলেও অপারগ হলাম। দুঃখময় স্থিতি হতে যে বাঁশি বাজালেন তার ঘরে প্রেমটুকু সার, আর সব অসার! বিগ্রহের দেয়াল ধরে নিশিপাগলের গোরে বাতি দিচ্ছেন ভক্তবৃন্দ, শিবমন্দিরে আজ মওলার জিকির। শিবভক্ত, নিশিভক্ত, মানুষের ভক্তরূপ মিলেছে সুরে, গম্ভীর সুরে; মায়াপুর হতে যে সুর উঠে আসে, পাখির মতন, শ্যামা কীর্তনের মতন, অন্ধ কাওয়ালের বেনেয়াজ সঙ্গীতের মতন; মধ্যবিলে উদাস ফকিরের ঘোড়াটির মতন দৌড়ে দৌড়ে আমি যে গান গাইতে চাই, তার লাগাম ধরে যে বসে আছেন সাঁই।

৭.

দর্শন ও আত্মদর্শনের পথে দুই জন। একজন সন্ন্যাসী অন্যজন গৃহী। সন্ন্যাসী পথ চলছেন যেন পথ তার চিরচেনা, গৃহী চলছেন অচেনা পথে, সন্তর্পণে, অজানায়। সন্ন্যাসীর চোখে অভিলাষ, গৃহীর অতিক্রমণের দূরাশা। দুইজন একসাথে তবু পার্থক্য বহু। দুইজন একই পথে তবু পদক্ষেপ ভিন্ন। একজন নামজপ করছেন, অন্যজন নিজের কথাই ভাবছেন; নিজের দূর্বলতা, ক্ষুদ্রতা, গ্লানি ও আমিত্বের কথা।

কিছুদূর চলবার পর সন্ন্যাসী স্মিত হেসে বললেন, ভায়া থামুন একটু, জিরিয়ে নিই। এই বলে যে গাছটির নিচে বসলেন সেটি একটি পাকুড় গাছ যার জন্ম হয়েছিল পাখির বিষ্ঠা হতে, ভাঙা দেয়ালকে গিলে মুছে দিয়ে পুরানো ধ্বংসাবশেষ। জায়গাটির নাম নিশ্চিন্তিপুর, গাছটি যে দেয়ালে জন্মেছিল সেটি ছিল নদীগর্ভে বিলীন হওয়া এক ফকিরের দরগা। তার সমাধীর ভাঙা অবশেষ। নদীর নাম কালনাগিনী। স্থানীয়রা তাকে সংক্ষেপে কালনী বলে ডাকে। এখন কালনী চলে গেছে বহুদূর , প্রায় ২ মাইল। নিশ্চিন্তিপুরে কোনো গ্রাম নাই, আছে চরাচর ব্যাপী বিল ও ধানক্ষেতের মাঠ। এইখানে কেবল শুকনো মরসুমে অস্থায়ী বসতি গড়ে ওঠে, ফসল তুলতে আর রাতভর আনন্দ করতে।

পাকুড় গাছটির মাথায় দু'টি লাল নিশান। একটি দরগার আরেকটি কালীমাতার। দূর থেকে দু'টিকেই এক মনে হয়। দরগার ঠিক পশ্চিমে একটা বেলগাছের তলায় কালীমন্দির। মা আর বাবার আশ্রয়ে এই নিশ্চিন্তিপুর, গোটা ভূখণ্ড। যেটুকু শুকনো থাকে সারাবছর সেটুকুতে কেবল এই দরগা, মন্দির আর খাদেম, সেবায়েতদের বসতি। তারপর প্রায় ১ মাইল ছোটবড় জংলা, মাঝে মাঝে ফকির ও সাধুদের আস্তানা, ভদ্রসমাজের কেনো আনাগোনাই নাই। কিন্তু এককালে এইখানে কয়েক ঘর বসতি ছিল। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে তা।

গৃহী বললেন, আমরা কোথায়? সন্ন্যাসী বললেন, ফকির নিশিকান্তের দরগা ও রক্ষাকালী মন্দির। নিশিকান্ত ছিলেন মন্দিরের ঝাড়ুদার। একদিন এক দরবেশ বেলগাছের তলায় এসে বসলেন, গাছে তখন বেলফুলের মরসুম। দরবেশ মন্দিরের সামনে বসে থাকা নিশিকান্তকে ডেকে বললেন তাকে বেলগাছ হতে একটি বেল পেড়ে শরবত করে খাওয়াতে। নিশি একবার বেলগাছের দিকে আরেকবার দরবেশের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন সবে ফুল ফুটেছে গাছে, আপনি আরও ৮-৯ মাস অপেক্ষা করুন। দরবেশ তার দিকে অদ্ভুতভাবে হেসে বললেন দেখোতো ওপরে গাছে একটি বেল কেমন পাকা! নিশিকান্ত ওপরে তাকাতেই তার চোখ বিষ্ময়ে আঁৎকে উঠলো। সে বুঝতে পারলো দরবেশ কোনো মানুষ নন, এই কালী মন্দিরে স্বয়ং শিবঠাকুর তিনি।

সন্ন্যাসীর কথা শুনে গৃহী উদাস হয়ে বলতে লাগলেন, এমন কোনো শিবঠাকুরকে যদি দেখতে পেতাম তো জীবন ধন্য হতো। নিশিকান্তের মতো তিনিও তার সেবা করে ফকির হয়ে উঠতে পারতেন। সর্বত্যাগী, অনাহারী, আত্মবিভূতিময় এক মুক্তপ্রাণ সত্তা! সন্ন্যাসী হাসতে লাগলেন। বললেন, আপনাকে এই এতদূর বয়ে নিয়ে আসলাম, আর আপনি এখনও তেমন শিবঠাকুরকে খুঁজে মরছেন? আমাকে দেখুন, আমিই কি আপনার সে শিবঠাকুর নই…?

গৃহী বুঝতে পারলেন, সন্ন্যাসধর্ম সন্ন্যাসীর সঙ্গে একসাথে চলার ধর্ম নয়, তা নিজের ভেতর দিয়ে যাত্রা, সে যাত্রা দূর্গম ও সুদূর; নিশ্চিন্তিপুরে এই আনন্দময় পাকুড় ও বেলগাছের মিলনক্ষেত্রে নিশিকান্ত ও কালীমাতার দেবদেউলে যে জ্ঞান হলো তা এই সন্ন্যাসীর অহমকে পেরিয়ে গেছে ত্রিকালদর্শনের পথে; সে পথ একান্ত নিজের, যে পথ বহুজনে মিলিত হবে একসময়, সমস্ত হারিয়ে, প্রেম ও কর্মের ধ্যানে। গৃহী নিজের ভেতর শূন্যতাবোধ টের পেল। সন্ন্যাসীর কাছ হতে উঠে দাঁড়ালেন, ফকির নিশিকান্তের মতো বেলগাছটির দিকে তাকিয়ে তিনিও দেখতে পেলেন একখানা পাকা বেল ঠিক ঝুলে আছে বেলফুলের মরসুমে। সন্ন্যাসী কইলেন, কি দেখছেন ভায়া? গৃহী বললেন, যা দেখছি তা আপনি দেখতে পাবেন না, কারণ আপনি সমস্ত দেখে ফেলেছেন; যা ভাবছি তা আপনি ভাবতে পারবেন না, কারণ আপনার ভাবনা শেষ হয়ে এসেছে; যা বুঝতে পেরেছি তাও আপনার পক্ষে বোঝা অসম্ভব, কারণ আপনি বুঝে বুঝে জ্ঞানের বোঝা বাড়িয়েছেন কেবল।

: :  দ্বিতীয় ভাগ  : :

১.

কে জানতে চাইবে এই আনন্দ কোথা হতে আসে, কখন আসে, কিভাবে আসে? শুধু ফেলে যাওয়া পথ যে করে পেছনের দিকে ছোটে, ধীরে-দ্রুত কিংবা মুহূর্তে উধাও, যে কোনও ভাবে; সেই ভাবে আমরাও পিছনে পড়ে যাচ্ছিলাম। আমি ও আমার মেয়েরা, কুমারী মেয়েরা, পবিত্র বাসনার রাজকুমারীরা, উচ্চতম অনুরাগের ও প্রেমের–প্রার্থনার নির্মল নায়িকারা, তাদের সঙ্গে করে হাঁটছিলাম। হেমাঙ্গী ও শ্যামাঙ্গী মেয়েরা তাদের বাবাকে নিয়ে পথের ধার ধরে ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ছে, ভাবছে জীবন একটু ধীর হোক, শান্ত হোক, স্থির হোক, আড়াল হোক, মন্থরতা আসুক।

একটা ধ্যানী দুপুর একটি নিস্তরঙ্গ জলাশয়ের বুকে যেমন করে আটকে থাকে, আমরাও তেমনি থমকে ছিলাম কিছুক্ষণ, একে অন্যের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম না কিছুই, শুনছিলাম না কিছুই, দেখছিলাম না কিছুই, বলছিলাম না কিছুই; কেবল অস্থিরতাকে গলে গলে পড়তে দিয়েছিলাম, বেরিয়ে এসেছিলাম স্থিরতার কঠিন হাড় হয়ে, মেদহীন-মাংসহীন-অস্থিচর্মহীন এক কোমল-কঠিন মানদণ্ডে।

প্রার্থনা হতে উঠে আরেকটি প্রার্থনায় ফিরে যাবার মাঝখানে যে ফাঁকাপথ, তাকে ধরতে চাইছিলাম; দেখলাম অখণ্ড হতে কি করে খণ্ড খণ্ড হয়ে থাকে মানুষ, সমগ্র হতে অংশে অংশে হারায়। যে আনন্দকে বুঝতে চাইলাম আমরা তাও দেখলাম কতভাবে টুকরো-টুকরো হয়ে, খণ্ডিত হয়ে, অপূর্ণ হয়ে জীবনকে অসাড় করে তোলে। কে জানতে চাইবে এই আনন্দ কোথা হতে আসে? আমরাও জানি না। আমার কুমারী মেয়েরা সেই আনন্দকে স্থির জলাধারের বুকে ধরতে চাইছে, কিন্তু ধ্যানী হতে পারছে কই? আমিও না…

২.

ফিরতি পথের ধারে একটি রাধাচূড়ার গাছ। কেউ কেটে নিয়েছে তার সকল ডালপালা। তারই মধ্য দিয়ে দুএকটি ছোট ছোট ডালে ফুটেছে ফুল, একটিও পাতা নেই, ফুলের মাঝে ভুল নেই কিছু। আমাদের ফেরার পথও তেমনি ভুলে ভরে থাকবে কেন? রেখে যাওয়া পথে কেউ কেউ ফেরে, কেউ কেউ ফেরে না, কেউ কেউ ফেরা না ফেরার মাঝেই থাকে না। আমরা ফিরেছি, কারণ আমাদের পথ কেবল নিজের জন্যতো নয়, আর কারো জন্যে তার প্রয়োজন আছে। যাবার সময় প্রকাণ্ড গাছটিতে একটি ফুলও দেখি নি, ফিরতি পথে কেটে নেওয়া শরীরে তার ঝুম হয়ে আছে চিত্রল রাধাচূড়া, নির্মম সুন্দর!

যে বাউল গাইতে পারে না সেওতো গায়, সেই গান শুনতে যে পায় সে প্রকৃত শ্রোতা। প্রকৃতি যেমন সকল শুনতে পায়, সকল দেখতে পায়, বুঝতে পারে, প্রতিদান দিতে পারে, নিতে পারে কেড়ে সকলকিছু। তাঁরও রয়েছে সেই সব। যে নিতে পারে, দিতে পারে। পাথরের নিচে চাপা দিতে, ফের পাথর ফুঁড়ে বীজকে মহীরূহে পরিণত করতে। পথের সন্ধানে বের হতে, ফের সে পথেই ফিরে এসে পথকে বিকশিত করতে। যেমন করে শান বাঁধিয়ে রাখে মানুষ পুকুরঘাটে-বটের মূলে-নদীর ধারে।

ফিরিঙ্গিবাজারের ভিতর দিয়ে এক মাস্তান হেঁটে চলেছেন। জটাধারী, ময়লা চামড়া কিন্তু পরিষ্কার ও টলটলে চোখ। বুনো নির্ভরতার ভেতর দিয়ে যেন একটি শান্ত ঝিল ঝলমল করে উঠছে তন্ময় হয়ে। এইখানে বাড়িগুলি প্রাচীন, ভাঙাচোরা। অজাতশত্রু বট, দেয়ালের গায়ে, জটাগ্রস্ত। শাহলাল মাস্তান সেখানেই বসলেন। কে বট আর কে মানুষ পার্থক্য রইলো না। একটা রুটি ছিঁড়লেন তিনি, এক টুকরো ছুঁড়ে দিলেন ভোলার দিকে, আরেক টুকরো নিজের মুখে পুরলেন। ভোলা বিস্বাদের কথা ভেবে একবার তাঁর মুখের দিকে তাকালো, তারপর প্রভুর তৃপ্তিময় ক্ষুধা নিবারণের নমুনা দেখে একই পথ ধরলো। বহুদিন সে মাংস খায় না, পরমপ্রিয় হাড় দেখেও ধরে না। কেবল শুকনো রুটি ও সামান্য গুড়। মাস্তান ও তাঁর পোষা সারমেয় এখানেই রাত কাটান।

৩.

গৃহী তার পথের সঙ্গী করে নিতে চাইলেন যাকে তিনি সন্ন্যাসী নন, তার নিজের সন্ন্যাস তাকে ভেতর থেকে ঠেলছে। সেদিনের সেই পথ, পথের মানুষ, দেউল, দরগা ও মন্দিরের চত্বর হতে যে চেতনা জাগ্রত হলো তা যে শিশুবৎ। রয়েছে তার দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবার, নির্মাণ-বিনির্মাণের আত্মযোগ। সুদূরের হাতছানি হলেই কি হয়? দীক্ষাহীন, জ্ঞানহীন, মর্মহীন, আত্মবোধহীন ধর্ম ও সংস্কারকে পার হতে না পারলে কারো পক্ষে গুরুপ্রাপ্তি অসম্ভব। গুরু পেয়েও সে মূর্খ, দীন।

গৃহের পথে পা আটকে আসে, পিছলে যেতে চায় বারে বারে। একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখা গেল মেঘহীন স্বচ্ছ নীলাকাশ, পাখি উড়ছে, শূন্যতা বোধ হচ্ছে, ভারহীন মনে হচ্ছে নিজেকে। একটা কালো ছেলে হঠাৎ দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো নদীতে। সেই দিকে তাকিয়ে মনে হলো এভাবে যদি ছুটে যাওয়া যেতো, আন্ধেলা জগত হতে ডুবে যাওয়া। মন বিবাগী স্থুলদেশ হতে প্রবর্তদেশে, খেয়ালী মন হতে সচেষ্ট মনে, শরা হতে তরা'র পথে যেতে চাইছে। কিন্তু তার যে মন বাঁধা গুরুপদে, গুরু কোথায়, সে কি অধরা হয়ে আছে? শুদ্ধ-প্রেমের বিনিময়েই কি তাঁর পদারবিন্দু!

যে নারী রোজ নদীঘাটে অঞ্জলি দেয়, যে ভক্ত প্রাত্যহিক জীবন থেকে বের করে আনে ভক্তিসুষমা, যে কুমারী প্রতিদিনকার শিউলি ফূলে সংগ্রহ করে তার আনন্দকুসুম তার কাছে কী আছে? যে দেখতে পায় না একেকটি অরুণোদয়ের পার্থক্য, দিকচক্রবালের ভিন্নতা, যামিনীর রূপবৈচিত্র্য, অন্ধকারের এষা, তার কাছে কী আছে?

সন্ন্যাসী গৃহীকে যেতে দিলেন সেই পথে যেখানে মানুষকে কিছুকাল একা থাকতে হয়, তার নিঃসঙ্গতা, নীরবতা, নিস্তব্ধতাকে অনুভব করতে, যেমন করে প্রত্যেককেই ফিরে আসতে হয় নিজগৃহে, আপন আলয়ে, এ ঘর সংসার নয়–সংসারের ভেতর থেকেও ভিন্ন, পরমসংসার। এ ঘর গুরুগৃহ, অন্তর্গত আনন্দ-নিকেতন। যে ঘরে তিনি আসবেন, তাঁর আসবার পথ প্রস্তুত আছে কিন্তু বসতে দেবে কোথায়? কোন অন্ধকারে? নিভে যাওয়া আলোর অন্ধকার না যে অন্ধকার আপন আলোয় জেগে উঠতে চায় সেখানে?

৪.

ভাসান জলে নৌকা এসে ঠেকলো ঘাটে। ঘাট পেরিয়ে পুকুরঘাট ১২০ হাত প্রস্থ। পূন্যস্নান হয় যখন পুরো বিথঙ্গল ঘাটে পরিণত হয়। অথৈ জলের মাঝে ভাসতে থাকা ছোট একটি গ্রাম। জগতমোহিনী সম্প্রদায়ের হারানো সুর খুঁজে পাওয়া যায়। শ্রীহট্টের এক প্রকৃষ্ট বৈষ্ণব সম্প্রদায়। স্থানে স্থানে ভেঙে আছে দেয়াল, ইট ও সুরকি ঝরছে, ১২০ টি ঘর মোহন্তদের খালি পড়ে থাকে বেশিরভাগ। যেদিন প্রথম পা রাখলাম, পায়ের জুতা কি করে জানবে যে এ কার আস্তানা? বিথঙ্গলের বাজার ঘুরতে ঘুরতে ভাঙা একটি দালানের ধ্বংশাবশেষে ঢুকে যেতেই চোখের সামনে যা ভেসে উঠলো তা বুঝবার আগেই পায়ের জুতা প্রথম দর্শনের আনন্দকে আঘাত করে বসলো।

অদর্শনের দর্শন এমনই। ঘুরপথে, বেমক্কা ঢুকে সমাধিমন্দিরের পরিচয় টের পাবার আগেই অপমানিত হতে হলো ভক্তদের হাতে। কি করে জানবো শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণগোস্বামীর আখড়া ও সমাধীমন্দির এটি? ধীরে ধীরে জাগ্রত হলে এই আখড়া পর্যটনের বদলে তীর্থমানস জেগে উঠলো। ডুব দিলাম অতীতকালে, যেমন করে ভাসান জলের ঢেউগুলি আছড়ে পড়ছে কিনারায়, যেমন করে ঘাটে বেঁধে রাখা নৌকাগুলি একটির সাথে আরেকটি ঠোক্কর খায় অপরিচয়ের পরিচয়ে তেমনি হারাতে লাগলাম জগত ও তার মোহিনী আনন্দকে আবিষ্কার করতে করতে। যদিও এ যাত্রা সহজ ছিল না মোটেই।

গোঁসাইপুকুরের শান বাঁধানো ঘাটে কেউ নাই। লালনীল দীপাবলীর মতো অসংখ্য মাছ পানিতে ভেসে উঠছে, জ্বলে উঠছে। তার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে নিজের চেহারাখানি দেখতে পেলাম। মনে হলো আমিও কি ভেসে উঠছি? হেসে উঠলাম, দূরে কিছু মানুষ একসাথ হয়ে এমনই মাছ দেখছে। পুকুরের জলে সামান্যতম মলিনতা নাই। কাকচক্ষু জল যাকে বলে। টেনে নিয়ে গেল সেই জল, হাঁটু ভেঙে বসে পড়লাম, আস্ত মুখে জল ছিটিয়ে দিলাম, একটা অন্তর্মুগ্ধ দ্যোতনায় শীতল হলো মুখ, ইচ্ছে হলো নেমে পড়ি জলে, পেছন থেকে চিৎকার করে উঠলেন কেউ, ভয় পেয়ে ঘাড় ঘুরালাম।

বিথঙ্গলের মোহন্তমশাই দুর দুর করে তাড়ালেন। মনে বড় দুঃখ পেলাম। এখানে কি তবে সাধারণের অধিকার নাই? তিনি হয়তো ভেবেছেন আমি নিতান্ত পর্যটক, তীর্থভাব নাই কিছু। কিন্তু কি করে জানবেন, আমি এটুকুতেই ডুবে এসেছি অতল জলে, মাছ হয়ে, শীতল হয়ে, কাকচক্ষু হয়ে, মুহূর্তের মেরাজ। স্নানঘাটের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মলিন বদন নিয়ে বিথঙ্গল আমার কাছে আশ্চর্য ঠেকে। মনে হয় কোথাও একটি ছন্দপতন। সুরে যেমন তাল, পায়ে যেমন কাঁটা। দৃশ্যমান কোনও ভক্তি পেলেন না তিনি, যাঁর সমাধি, তাঁর কাছ হতে দূরে সরে আসতে আসতে মনে হয়েছিল এতকিছু, তবু কিছু নাই, বুকের ভেতর উতরে উঠছে ভাতের মাড়ের মতো ফেনিল উদ্বেগ, পারদের মতো অস্বস্তি। এ কেমন ভ্রমণ, এমন অনুভূতি আগে কোথাও তো হলো না!

৫.

মায়ের পায়ের নিচে পড়ে থাকা রক্তজবার একটি তুলে মুখে পুরে নিলো যে, সে আমার মেয়ে। একদিন সে মায়ের পা ছুঁতে চাইলে পুরোহিত চেঁচিয়ে উঠলেন, কি করছো! কি করছো! আমি বললাম তুইতো মা, আয় তোর পায়ে রক্তজবা রাখি, বাদে তুলে নিয়ে আমিই না হয় মুখে পুরবো। মাতৃশক্তির প্রসাদ। নিজেকে ভক্ত রামপ্রসাদ ঠেকে। আত্মপ্রসাদখানি যেখানে থাকবার কথা সেখানে নাই, হারিয়ে যায়; হয়তো ফিরে আসে, হয়তো অন্য কোথাও জেগে ওঠে।

জেগে ওঠা চরের মতো মাঝে মাঝে কিছু দেবালয় জেগে ওঠে। পার্থক্য কেবল, আগে তা গড়ে তুলতো সাধকগণ, এখন সাধারণ। সাধারণের ধর্ম সাধককে বর্ম পরাতে চায়, যেমন করে কুসন্তান নাচিয়ে বেড়ায় আস্ত পরিবারকে। মানুষের ধর্ম আজ ধার্মিক হতে চাওয়া, জীবনধর্মকে আগলে ধরা নয়। আচারধর্ম, বিচারধর্ম, প্রচারধর্ম, প্রসারধর্ম, সংসারধর্ম, সঞ্চয়ধর্ম, পথের ধর্ম, ঘরের ধর্ম, নিজের ধর্ম, পরের ধর্ম–নানান ধর্মের জালে সে আবদ্ধ। আত্মধর্মকে, চৈতন্যধর্মকে সে দেখতে পায় না সম্প্রচারের অভাবজনিত কারণে।

সোনার খনির যেমন বিজ্ঞাপন লাগে না, মানুষ তা খুঁজে নেয়, আত্মধর্মকেও তার খুঁজে নিতে হয়। নিরন্তর সে খোঁজ, অবিরত।

৬.

ঘাটে বসে আছে সন্ধ্যার শেষ প্রসন্নতা ও অভিব্যক্তিগুলি। চোখ তাদের ভিজে আছে। একটা ডুহি আমগাছ থেকে ছিটকে পড়লো আমার মাথায়, মাটিতে লুটিয়ে পড়বার পর দেখলাম বাঁ পাশের চোখ বেয়ে রক্ত ঝরছে। একটা কাক জখম করে দিল। কাকটি ভাবলেশহীনভাবে বসে আছে, কেবল কিছু মানুষ ব্যস্ত হয়ে উঠলো পাখিটাকে নিয়ে। কল হতে ঠান্ডা জল ছিটিয়ে তার চোখ ধুয়ে দিচ্ছে, যস্ত্রণায় ছটফট করছে তার অস্তিত্ব।

যাদের চোখগুলি ভিজে আছে, তা হতে কিছুদিন পর হয়তো রক্তই ঝরবে, তাইতো তিনি চান। যার জন্য এই পথ, প্রবৃত্তির বন্ধ দুয়ারগুলি খুলতে চাওয়া, আসন্ন শরতের এই স্নিগ্ধ বাতাবরণে–হে প্রাণনাথ, তোমার দুয়ারের বাইরে দেখো কিছু মানুষ, সত্যকে ধারণ করতে চায়। গান গাইছে তারা, যারা আশ্রমের ভেতর নিজেদের অভিব্যক্তিগুলিকে রূপ দিতে পেরেছে। এখানে শ্রোতার চাইতে গায়ক অধিক। কেউ শব্দ করে কেউ মনে মনে গাইছে তার অন্তর্গত সঙ্গীত–ভক্তিকুসুম। আমিও গাইছি। প্রত্যেকেরই গাইতে হয়, নিজের সেই গান, যা না গাইলে চোখে অশ্রু নামে না।

আমরাও নেমেছি সেই পথে। এখানে প্রত্যেকেই শ্রমণ। ঘরে কিংবা বাইরে প্রত্যেকেই চাইছে পরিভ্রমণ। কিন্তু কি সেই সুখ, জানি নাতো–কি সেই দুঃখ, তাও না। সুখ ও দুঃখ হতে বহুদূরে একটা সামান্য জীবন, খুব সাধারণ ঘাসফুলের মতন, একটা কাচপোকার মতন বাঁচতে চাওয়া। আমাদের পরতে পরতে লেপ্টে থাকা কৃত্রিমতার মোম গলে যেদিন ঝরে যাবে সকল আভরণ–সেই দিন সম্পুর্ণ নগ্ন হতে পারি, ডুব দিতে পারি নিজেরই নদীতে, নারীতে, প্রকৃতিতে, পুরুষে, লা-মোকামে। এই হাটে, সদাই নিয়ে বসে আছে–কে বিক্রেতা, কে খরিদ্দার, জানি না তো।

৭.

তুমি না জানিলে হাল কে জানিবে আর

ভিতরে-বাহিরে তুমি, সর্বাঙ্গ যার,

টানাপোড়েন যত আছিল আমার

অধম হুসেন কহে, সকলই খোদার।। –শাহ হুসেন

এই সুন্দর শরীরখানি জলে ডুবতে চাইছে না, মন তবু অতলে যায়, আটকায়। শাহলাল মাস্তান হেঁটে চলছিলেন নদীর ধারে, তিনি গান জানেন না, তার আগমনে ঘাসগুলি, গাছগুলি, ঝিরি ঝিরি হাওয়াগুলি, অন্ধরাতের বোবা ডাহুকগুলি যেন গান গাইতে থাকে। কেউ শুনতে পায় কেউ পায় না। ময়লা জামাগুলি ঘাসের ওপর ফেলে রেখে নামলেন জলে, গোমতীর খরস্রোতা জল, স্বচ্ছ ও কোমল, মড়া কঙ্কালের স্তুপ হতে উঁকি দিয়ে তাঁর গোসল দেখছে কতগুলি শেয়াল–রাতভর গোরস্তানের মাটি খুবলে তুলে নেয়া হাড়গুলির ওপর বসে বসে শেষ হিসেব কষছে, বৃষ্টি পড়ছে ইসবগুল হয়ে, পিছলে যাচ্ছে ভোরবেলার আলো, তার ফাঁক দিয়ে।

আমার ঘরের দিকে ফিরে যাওয়া আর হলো না। বসে রইলাম কিনারায়। তারানা তুলছে জল–বৃষ্টিতে, নদীতে। পাশের জামাগুলিও ভিজছে, বহুদিনের বসে যাওয়া মলিনতা কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। এই সিক্ত পোশাক পরে কি তিনি ফের হাঁটতে থাকবেন? কোথায় যাবেন তিনি? কার কাছে? হাতের ছাতাখানি মেলে ধরলাম জামাগুলির ওপর। নেড়েচেড়ে দেখলাম, ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো কতগুলি সাপের খোলস। নানান রঙের, মাপের। গুণে দেখলাম ছয় খানি আছে। এর ভেতর একটি মনে হলো মাত্র কিছুক্ষণ আগে ছাড়া হয়েছে। ভয় হলো, আগ্রহ হলো, আশ্চর্য লাগলো, ঠান্ডা হয়ে উঠলো শরীর, বৃষ্টি বাড়ছে। দূর থেকে তাঁকে জলে নামতে দেখে মনে হয়েছিল আমারই মতন কেউ। ঘরে ফেরার পথে হয়তো ধুয়ে নিচ্ছে তার সকল ক্লান্তি, মলিনতা। কাছে এসে দেখলাম যা তাতে আরও আগ্রহ বেড়েছে। কে তিনি? কোথা হতে এলেন? আমারই পথের মাঝে আরেক পথিক! আমি তাঁর অপেক্ষায় সিক্ত ঘাসের ওপর, ছোট ছোট জলধারার ওপর, আমার নিজেরও মলিন জামা নিয়ে বসে আছি নদীর ধারে। পার্থক্য কেবল একজন তা খুলে রেখে গেছেন, অন্যজন তার ভেতরে বিদ্যমান। ভাবতে ভাবতে কখন যে খুলে ফেললাম সব আচ্ছাদন খেয়াল হলো না। এখন আমি সম্পূর্ণ নগ্ন।

ধীরে ধীরে গোমতীর জলে নেমে পড়লাম। মাস্তানের দেখা পেলাম না অথচ। কোথায় তিনি? বৃষ্টির এখন আর তেমন ফাঁকফোকর নেই, অঝর ধারায় ঝরছে। চারদিকে কেবল ধারাজল, থেমে নেই কিছু, খুব চঞ্চল হয়ে উঠলো মন, বয়ে চলছে সকল কিছু, কোথায় যাচ্ছে? কেন যাচ্ছে? কার কাছে? ভারী একটা কণ্ঠ যেন বলে উঠলো–নিজের কাছে। খুব শান্তি পেলাম মনে, ডুব দিতে আর কিছু লাগে নাতো।

২০১৩