সচল‬ ‪সারমাস্ত‬: প্রেম ও মানবতার লোকোত্তর কালাম

আজহার ফরহাদ
Published : 15 August 2015, 02:56 PM
Updated : 15 August 2015, 02:56 PM

তাঁকে বলা হয়ে থাকে 'শায়ের-এ-হাফত যবান' সাত ভাষার কবি। আরবি, সিন্ধি, সেরাইকি, পাঞ্জাবি, উর্দূ, ফারসি ও বালুচি ভাষায় তাঁর গানের বৃহৎ এক শ্রোতাগোষ্ঠী তৈরি করেছিলেন তিনি। প্রেম ও মানবধর্ম যার মূল। সিন্ধুর এই মহান সুফিসাধক সচল সারমাস্ত (১৭৩৯-১৮২৯) বিরলপ্রজ সৃষ্টিশীল মানুষদের একজন যাঁকে মানুষ ভোলে নি আজও। তিনি সিন্ধুর রানীপুরের নিকটবর্তী দারাজায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ভাল নাম আবদুল ওয়াহাব ফারুকি এবং ডাকনাম সচল বা সাচো। পরবর্তীতে তিনি কবিতায় ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। 

 

 

১.

পান করে যে প্রেমের মদ
আনন্দে তার মত্ত সব
সবখানে এক খোদা দেখতে পায়।

মনসুর মরে শূলে চড়ে
আমি খোদা সে বলে রে
সবখানে এক খোদা দেখতে পায়।

পাঞ্জাতনে ভক্তি যার
হাসান হোসেন ইমাম তার
সবখানে এক খোদা দেখতে পায়।

প্রেমদুয়ার ভরা দারোয়ান
#সচল হলো সেরা গোলাম
সবখানে এক খোদা দেখতে পায়।

………………………………………….

যেহন দিল পীতা ইশক. দা জাম
সা দিল মাস্ত ও মাস্ত মোদাম
হক্ব মওজুদ সদা মওজুদ।

সূলি তে মানসুর চড়হা কর
আনা আল হক. কালাম
হক্ব মওজুদ সদা মওজুদ।

পাঞ্জাতন পাক হিমায়েত মেরি
হাসান হুসেন ইমাম
হক্ব মওজুদ সদা মওজুদ।

দর সাইয়াঁ তে সাওয়িঁ সিপাহী
সচল খাস গু.লাম
হক্ব মওজুদ সদা মওজুদ। ( পাঞ্জাবি )

২.
ভাবলে তোমায় দীনভিখারি হলে তাই
ভাবলে তোমায় খোদাময় হলে খোদাই।
: : : :
আগর খোদ রা গদা দানী গদাঈ
আগর খোদ রা খোদা দানী খোদায়ী। (ফারসী)


…………………………………….

 

৩.
কে আমি, কে আমি, কে আমি?
আশ্চর্যে ভরা এই আমি, কে আমি?
: : : :
কিস্তাম মান কিস্তাম মান কিস্তাম
দর তাহাইয়ুর মানদেহ আম মন কিস্তাম। (ফারসী)

 

……………………………………..

 

৪.
না শেখ মাশায়েখ, না মাখদুম
না মোল্লা কাজী, না পীর
নির্বোধ ঠগের কোন ধারা হতেই নও তুমি।
সচল, না মজে আল্লাহতে
শিখবে না এই প্রেমশিল্প তুমি। *
: : : :
না কি শায়খ মাশায়েখ য়ারো, না কি মাখদুম থিয়া সীন
না কি মুল্লা, না কি কা.জী, না কি মুয়াল্লাম পীর বানয়া সীন
না কি থাহ ঠগি জা থাহে, রঙ্গান সান রাখিয়া সীন
সচল সিওয়ে ইশক. আল্লাহ, কো বি হুনর না সিখয়া সীন। (সিন্ধি/সেরাইকি)

 

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
* এই কালামটি সচল লিখেছিলেন এমন এক সময় যখন মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়েছিল মোল্লা, পীর, ধর্মগুরু দ্বারা। রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে চলেছিল সর্বস্থলে। সচল তাদের সম্পর্কে বলছেন যে, তাদের দেখতে যেন খাজা খিজিরের মতো পূণ্যাত্মা কিন্তু আসলে তারা আজাজিলের মতো শয়তান।

 

৫.
ভুলেছি আমায়, ভুলেছি নামায
হয়েছি পাগল তাঁর প্রেমে আজ,
করেছি পান প্রেমমদ দিন রাত
কাজি-মোল্লার সাথে আমার কি কাজ!

: : : :

ভিসরিয়ো রোজো, নাহ ভেদ নিমায মুঁখে
কয়ো মাস্ত পিরিআঁ যে খানি নায মুঁখে,
শওক. শারাব পীয়াঁ, পির ভাত রাতিয়াঁ দিভাঁ
কোনহে ভারি কাজি মুল্লাঁ জো কো লিহায মুঁখে। ( সিন্ধি )

 

………………………………………………..

 

৬.
প্রেমে মজে হলে মানুষ, আত্মভ্রমণের দিকে মন,
দেখতে সে আদমসূরত, দুই দিনের মেহমান,
সচল, তুমিইতো রাজা, গুরু এ সত্য বলে যান।

: : : :

ইশকোঁ থি ইনসান, আয়ো সাইলানি সিয়ার তে,
সূরত মেঁ আদম জে, আদম দাম মাহমান,
সতগুর সাচ সুনায়ো, সাচ্চা তুঁ সুলতান। ( সিন্ধি )

 

………………………………………………….

 

৭.
মুখে মুখে কলেমা পড়ে, বন্দী হলো মুসলমান
আরব হতে আহমদ রাসুল, দেয় নি তোমায় এনে ঈমান
মানুষ হতে পরমমানুষ, সচল নিজেই হয় সোবহান।

: : : :

কলমে মুঁখে জিঁ কায়ো, মুরুঁ মুসলমান,
না কী আহমদ মোকলিয়ো সো আরব খান ঈমান,
পর আদমিয়াঁ লেখে আদমি, সাচ্চো সো সুবহান। ( সিন্ধি )

 

 

 

 

সত্য বলতেন বলে সচল বা সাচ্চু নাম হয়েছিল তাঁর। মাস্ত ও বেহাল হয়ে সর্বদা তিনি তৌহিদে বাস করতেন। যে কারণে তাঁর কালাম বিষয়বুদ্ধি ও আচারসর্বস্ব মানুষের জন্য পীড়াদায়ক বটে। সচল সারমাস্ত যে সময় বাস করতেন তখন ধর্মীয় দাঙ্গা বিশেষ করে শিখ-মুসলিম বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। এই বিরোধের সময় তিনি পরম সত্যের প্রতি মানুষকে আস্থাশীল হয়ে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ না করে এক খোদার সৃষ্টিরূপে বিবেচনা করবার কথা বলেছিলেন। এমনকি অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিখদের পক্ষাববলম্বন করে মুসলমানদের বিরত করতে চেয়েছিলেন রক্তপাতমূলক হিংসা ও দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে। যদিও তাঁকে মোল্লা, মুফতির প্রবল সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে কিন্তু তিনি ছিলেন অটল সেই পথের পথিক যেখানে কেউ পথ ভোলে না। নিচের কালামগুলি সেরাইকি ভাষার।
……………………………………………………………………………………………..

 

৮.
মিশে আছো তুমি আলাদাও তুমি
কি বলি তোমায়!
মূর্তিও তুমি খোদাও তুমি
কি বলি তোমায়!

এইখানে নাই তো কোথাও নাই
কে আছে সে যে কথা কয়?
নাচনেওয়ালীর বেশে নেচে নেচে
সচল তাঁরই নামে গুণগান গায়।

: : : :

তু মিলা ভি হ্যায় তু জুদা ভি হ্যায়
তেরা কেয়া কেহনা
তু সনম ভি হ্যায় তু খোদা ভি হ্যায়
তেরা কেয়া কেহনা।

ইথ নাহিঁ তে কিথ নাহিঁ
ইহো কওন পেয়া বোলায়েন্দা
কাঁজরি ওয়ালি সুরত বান কে
সচল নাম সাড়েন্দা।

( ভাষা : উর্দূ / সেরাইকি )

 

………………………………………………

 

৯.
শীগগির আসো প্রাণপ্রিয় ধন
কেঁদে কেঁদে আমি বেহাল এখন।

রোজ রোজ ডেকে মরি পথপানে চেয়ে
ফিরে যদি আসো তুমি পরানের ধন,
দুয়ারে দাঁড়ায়ে আছে সচল যেমন
লক্ষ হাজার আশিক তোমার তেমন।

: : : :

সিঙড়া আওয়েঁ সাঁওল য়ার
রোওন্দি ওয়াতাদিইয়্যাঁ যারোযার।

রাহাঁ তেড়িয়াঁ রোয গোলায়েন্দিয়াঁ
মান তু আওয়েঁ কাহিঁ ওয়াল য়ার
দর তেরে তে সাচ্চু জেহে
আশিক. লাখ হাজারো য়ার।

( ভাষা : সেরাইকি )

 

 

 

 

আত্মপরিচয়ের সংগ্রামে মানুষের একমাত্র পরিচয় হয়ে ওঠে ‪#‎প্রেম‬। প্রেমহীন কোন পরিচয়ই মানুষকে পরিচিতি দান করতে পারে না, অসীম ঐশ্বর্য্যকে সে মরীচিকাভ্রমে হারাতেই থাকে। হযরত সচল সারমাস্ত যে উচ্চতা হতে তাঁর কাফি বা কালাম রচনা করেন তার ধারেকাছে বাস করতে পারাও সাধনাই বটে। সবচাইতে মজার দিকটি হলো এই যে গূঢ় অধ্যাত্মচেতনার অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়গুলি তিনি রচনা করেন তা ফেরে খুব সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। সিন্ধুর মাটি এক সনাতনী দীর্ঘ ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় যাঁদের জন্ম দিয়েছে তাঁরা যেন সিন্ধুকেও বারবার জন্ম দিয়ে গেছেন। সচল সারমাস্ত, দিওয়ানা হাল ও মাস্তানী উপলব্ধির তুরীয়ানন্দে নিজেই কেবল নেচে ওঠেন নি সমগ্র সিন্ধু ও ভারতবর্ষকে নাচিয়ে তুলেছেন একটিমাত্র ধর্মে, আর তা হচ্ছে প্রেম। নিচের কালামটি উর্দূ হতে অনূদিত।

………………………………………………………………..

 

১০.

বুদ্ধি বলে সজ্ঞান হয়ে আয় তো,
প্রেম বলে না পাগলামিটাই চাই তো।

: : : :

বুদ্ধি বলে মুখ ঢেকে রাখ ওড়নাতে
প্রেম বলে ছাড় মুখ না রাখিস ঘোমটাতে।

: : : :

মুফতি, কাজী, আলেম হয়ে যায় গোলাম
প্রেম হলো তাই লক্ষ পাগলামির ইমাম।

: : : :

প্রেম হৃদয়ের পূর্ণ প্রাণের শক্তিরূপ
দরিদ্র পায় রাজত্ব উপহারস্বরূপ।

: : : :

প্রেম সে সাগর যার না আছে ধার কিনার
ঢেউ তোলে তার বুকের ভেতর বেশুমার।

: : : :

বাধ্যতা, ভয়ভীতির কথা বুদ্ধি কয়
প্রেম বলে তোর হোক যদি বদনামও হয়।

: : : :

প্রেম যদি হয় কর্তা, বুদ্ধি পাহারাদার
এ যদি হয় সান্ত্রী-সেপাই সে সম্রাট তার।

: : : :

প্রেম মহাজন হয় তো জগত দেয় সাড়া
প্রত্যেকে তার বশ্যতায় আত্মহারা।

: : : :

প্রেমশিখাতে উজ্বল হয়ে উঠলো যা
সে দিয়ে সব মলিন পর্দা জ্বালিয়ে যা।

: : : :

প্রেম আপাদমস্তক হলো গোপন-জ্ঞান
দুই জগতেই বিশেষ রাখা তার সম্মান।

: : : :

প্রেম দেহমনের কাছে ফানার প্রকাশ
দেখতে ফানা আসলে তা বাক্বার বিকাশ।

: : : :

বুদ্ধি হলো মাথার অন্ধ অনুকরণ
প্রেম হলো মূল একত্ববাদের উচ্চারণ।

 

…………………………………………..

 

আক.ল ক্যাহতি হ্যায় কে আ হাস্তি মে আ
ইশক. ক্যাহতা হ্যায় নেহি মাস্তি মে আ।।

: : : :

আক.ল ক্যাহতি হ্যায় লে মুহ পর নাকা.ব
ইশক. ক্যাহতা হ্যায় কে ছোড়ো সব হিজাব।

: : : :

কা.জি ও মুফতি ও আলেম হ্যায় গু.লাম
ইশক. লাখোঁ কে জুনুঁ কা হ্যায় ইমাম।

: : : :

ইশক. আন্দর কি হ্যায় সারি আগাহি
বাখশ দেতা হ্যায় গদাওঁ কো শাহী।

: : : :

ইশক. হ্যায় দরিয়ায়ে না প্যায়দা কিনার
মওজ আন্দর মওজ বেহদ বেশুমার।

: : : :

তা'আত ও তাক.ওয়া কি বাতেঁ আক.ল কি
ইশক. ক্যাহতা হ্যায় হো রুসওয়াই তেরি।

: : : :

ইশক. শাহ অওর আক.ল বা দারওয়ান হ্যায়
য়ে সিপাহি হ্যায় তো উয়ো সুলতান হ্যায়।

: : : :

ইশক. হ্যায় মহাজন জাহাঁ পর হো গ্যায়া
হর কোয়ি তাআত মে উস কি খো গ্যায়া।

: : : :

ইশক. কি লও সে মুনাওয়ার কর চলা
ফির জ্বালা দে উস সে পরদে দাগ. দা।

: : : :

ইশক. সর সে পাওঁ তক আগা.হে রায
ইশক. হ্যায় দোনো জাহাঁ মে শাহবায।

: : : :

ইশক. জিসম ও জাঁ কো প্যায়গা.মে ফানা
হ্যায় ফানা দর আসল প্যায়গা.মে বাকা.।

: : : :

আক.ল ক্যায়া হ্যায় সর তাপা তাক.লিদ হ্যায়
ইশক. ক্যায়া হ্যায় নারায়ে তাওহিদ হ্যায়।