সারমাদ‬ কাশানি‬ : : প্রেম ও আত্মোৎসর্গের মিলনতীর্থ : : নির্বাচিত রুবাঈ

আজহার ফরহাদ
Published : 30 August 2015, 08:37 PM
Updated : 30 August 2015, 08:37 PM

( ১৫৯০-১৬৬১ )

ছিলেন এক ইহুদী বণিক। ভারতে এসেছিলেন ব্যবসায়ের কাজে। আর যাওয়া হয় নি তাঁর। সুফিচেতনায় দীক্ষা নিলেন। পরিণত হলেন বিষ্ময়কর মরমীজীবনের অধিকারী। গোঁড়া ধর্মমতের বিরুদ্ধে সর্বদা কথা বলতেন বলে রোষানলে পড়েছিলেন অনেকের, এমনকি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কোপানলে পড়েন তার উচ্চমার্গসম্পন্ন অভিব্যক্তির চরমতম দুর্বোধ্য প্রকাশের ফলস্বরূপ। আওরঙ্গজেব তাঁকে ১৬৬১ সালে হত্যা করেন বিচারে দণ্ডিত করে, তার বিরুদ্ধে খোদার প্রতি অবিশ্বাস ও অমান্যতার অভিযোগে। যদিও পরে তার এই বিচারিক সিদ্ধান্তকে তিনি ভুল ছিল বলে স্বীকার করেন, এমন কথিত আছে।

সারমাদ মুঘল রাজপুত্র দারা শিকোহ ও বাদশাহ শাহজাহানের নিকট অত্যন্ত সম্মানের ব্যক্তি ছিলেন। ইতিহাসে স্বীয় কালে এবং তার পরবর্তী সময়েও সারমাদ আক্রান্ত হয়েছেন অন্যায় ও অজ্ঞানতার দ্বারা, যারা তাঁকে মাটিচাপা দিতে চেয়েছে অক্লান্তভাবে। কিন্তু সারমাদ সারমাদই, তাঁকে ভারতেবর্ষের মনসুর হাল্লাজ বলা হয়ে থাকে, তাঁর উচ্চতর অধ্যাত্ম-অভিজ্ঞানপূর্বক আত্মবলিদানের কারণে।

নীচের অনুবাদগুলি মূল ফার্সি রূবাই ও ইংরেজি অনুবাদ মিলিয়ে যথাসম্ভব পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করা হয়েছে। আমি ফার্সি ভাষা অল্পবিস্তর জানি, হয়তো ইংরেজি অনুবাদগুলি না থাকলে তার পাঠোদ্ধার আরও মুশকিল হতো। কিন্তু ইংরেজির ওপর ভরসা করতে পারি নি, কারণ ভাষা হিসেবে ফার্সির যে গভীরতা ও উজ্জ্বলতা সে অন্তত ইংরেজিতে সম্ভব নয়। তাই চেষ্টা করা হয়েছে মূলসুর ও ব্যঞ্জনাকে যথাসম্ভব বজায় রাখতে। এই দুঃসাহসকে আমার ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বলে আশা করছি।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

১.
সারমাদ, না প্রেমবেদনায় হলাম আমি কামপরায়ণ
করুণ প্রজাপতির হৃদয় না পায় মৌমাছির ধরন,
পার হয়ে যায় জীবন যদি প্রিয়তমের সঙ্গলাভে
শাশ্বত পরমসুখে সব লোকে হয় সুখী এমন!

: : : : : :

সারমাদ গ.ম-এ-ইশক. বুলহাওস রা ন-দেহন্দ
সোজ-এ-দিল-এ-পারওয়ানা মগস রা ন-দেহন্দ
উমরে-বায়াদ কে য়ার আ-য়াদ বে কিনার
এয়নদওলত-এ-সারমাদ হামা কস রা ন-দেহন্দ।

২.
ধন্য শতবার তারে আমায় প্রীত হলেন যে সাঁই
প্রতি নিঃশ্বাসে তারই দয়া, হৃদকম্পনেও তাই,
ক্ষতি কি তবে ভূক্তভোগী হলাম না হয় প্রেমে
লেনদেনে সুদ হারালো যদিও আসল ছাড়ি নাই।

: : : : : :

সাদ শুকর ক্য দিলদার যে মান খু.শনূদ অস্ত
হর দম বা কারাম ওয়া হর নফস দর জূদ অস্ত
নুক.সান ব্য মান অয মেহর-ও-মোহাব্বাত না রসীদ
সওদা ক্য দিলম কার্দ তামামাশ সূদ অস্ত।

৩.
নির্দয় সে পরাণপ্রিয় একটুও না দেখলো আমায়
হৃৎবেদনা, দুঃখবিলাপ পায় না সাড়া কি করি হায়
বুকের ভেতর আছেন তিনি সর্বময় অন্তর্যামী
বেহাল মনে থাকুক যত ব্যথাই সে না খবর পায়।

: : : : : :

আন শোখ. বা মন নজর না দা'রাদ চে কূনাম
আহ-এ-দিল-এ-মান আসর না দা'রাদ চে কূনাম
বা আ'ন ক্য হামেশা দর দিলাম মি মানাদ
আয হা'ল-এ-দিলাম খ'বর না দা'রাদ চে কূনাম।

৪.
দূরত্ব প্রিয়তম হতে? একমুহূর্তও নয়
সামান্য বোঝাপড়া ও ভাবনাও তাই সম্ভব নয়
সাগরসম তাঁর কাছে এক ভাঙা পানপাত্র আমি
এমন অসাড় পাত্রে সাগর ধরবে তা কি করে হয়?

: : : : : :

দূরি নাফাসে মেরা অয ওউ মুমকিন নীস্ত
এয়ন য়েক জেহেতি বা গুফতুগু মুমকিন নীস্ত
ওউ বেহর-দিলম সুবু অস্ত-এয়ন হার্ফ-এ-গা.লাত
গুনজায়েশ-এ-বেহর দর সুবু মুমকিন নীস্ত।

৫.
সারমাদ! ধর্ম তোমায় অভিযোগ দিল ঐক্যনাশের
এক পলকের উন্মাদনায় বলি হলে বিশ্বাসের
তোমার যে ধন-সম্পদ তা বিনয় ও ভক্তিপ্রেমটুকুই
সে প্রতিমার চরণে তাই মন রাখলে সমর্পণের।

: : : : : :

সারমাদ! দের-এ-দীন আজব শিকস্তি করদি
ইমান ব-ফিদা-এ-চশম-এ-মাস্তি করদি
বা ইজয-ও-নিয়ায জুমলা নক.দ-এ-খু.দ রা
রফতা-ও-নিসা'র-এ-বুত-পরস্তি কারদি।

দিল্লীর পথে পথে নগ্নদেহে ঘুরে বেড়াতেন তিনি। তাঁর শত্রুরা কোনও সাধারণ মানুষ ছিলেন না, সবাই ছিলেন রাজদরবারের প্রখ্যাত আলেম, কাজী, শাস্ত্রজ্ঞ এমন কি খোদ বাদশাহ আওরঙ্গজেব নিজেই। আওরঙ্গজেবের শাসনামলের শুরুর দিকে ভ্রাতৃহত্যা ও স্বীয় পিতার প্রতি অবিচারের কারণে তাঁকে চারপাশের শত্রুর প্রতি নজরদারি বাড়াতে হয়েছে। ‍মুঘল শাসনামলে সবচাইতে অধিক আনুষ্ঠানিক আচারধর্মের প্রয়োগ ও ভিন্নমতের দমন চলেছে তাঁর আমলেই। যদিও আওরঙ্গজেবের সুফিসাধকদের প্রতি অনুরাগ ইতিহাসে দুর্লভ নয়, কিন্তু সারমাদ শহীদ হয়ে উঠেছিলেন মূর্তিমান আতংক তার কাছে। পিতা ও ভ্রাতার অত্যধিক আনুকূল্য লাভে সক্ষম সারমাদ স্বাভাবিকভাবেই আওরঙ্গজেবের চক্ষুশূলের কারণ এ কথা নিশ্চিতরূপে বলা যায়। দারা শিকোহ সারমাদকে গুরুতুল্য মনে করতেন এবং তাঁর কালাম, কথামালার প্রতি অত্যন্ত অনুরাগী ছিলেন।

সারমাদ সম্পর্ক সমকামিতার অভিযোগ আনা হয়েছে ঐতিহাসিক আলোচনায়। যার বেশিরভাগই অজ্ঞানশীলতা ও পশ্চিমা জ্ঞানচর্চার অগভীর প্রকাশ। ১৬৩১ সালে তিনি যখন ভারতে প্রবেশ করেন, তার আগেই তিনি ইহুদী মরমী জ্ঞানচর্চার সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত। ভারতের কালজয়ী সব সুফিসাহিত্য ও সাধকদের স্পর্শকে তিনি এড়াতে পারেন নি। যা তাঁর অধ্যাত্মজীবনকে বদলে দেয় এবং তিনি নবজন্মলাভ করেন এক আলোকময় ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত গভীর ও গূঢ় জীবনে। ভারতে আসবার পর তিনি অভয় চাঁদ নামে এক হিন্দু তরুণের প্রেমে পড়েন। তাঁর এই প্রেমই ইতিহাসে তাঁকে ভুলব্যাখ্যার সুযোগ করে দেয়। যদিও এই প্রেম ছিল মাধুর্যভজনের, উক্ত তরুণের পিতা সারমাদ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হবার পর তিনি নিজেই তার সন্তানকে অনুমতি দেন সারমাদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করবার। সেই সময় অভয় চাঁদ হয়ে উঠেছিলেন সারমাদের ছায়াসম এবং আরবী, ফারসী এবং হিব্রু ভাষায় ব্যুৎপত্তিলাভ করেছিলেন।

দিল্লীতে সারমাদ অনুগ্রহ লাভ করেন সুফি সৈয়দ হারে ভারের নিকট। পরবর্তীতে তাঁর প্রতি মুঘল সম্রাট শাহজাহান ও তাঁর পুত্র দারা শিকোহর অনুগ্রহলাভ ইতিহাসে সুবিদিত। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচিন্তার প্রতি তিনি বিশেষ সমালোচনার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। মুসলিম, হিন্দু ও ইহুদী ধর্মাচার সম্পর্কে ছিল তাঁর নিজস্ব মতামত যা তাঁকে ধর্মবিরোধীরূপে শাস্ত্রকামী মানুষদের কাছে পরিচিত করে তোলে। তাঁর উপহাস, কৌতুক ও নগ্নাবস্থার প্রতি সাংঘাতিভাবে নাখোশ ছিলেন আওরঙ্গজেব। একটি গল্প কথিত আছে এমন :

একবার আওরঙ্গজেব দিল্লীর পথে বেরিয়েছিলেন, পথের ধারে তখন বসে আছেন সারমাদ। তিনি সেখানে থামলেন এবং নির্দেশ দিলেন সিপাহীদের যে তাঁকে যেন কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। সারমাদ অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন, যদি তুমি মনে করো যে আমার নগ্নতাকে ঢেকে রাখা প্রয়োজন, তবে তুমি কেন তোমার মনকে আমার নিকট হতে ঢেকে রাখ না? আওরঙ্গজেব যখন যাবার প্রস্তুতি নিলেন পাশে পড়ে থাকা সেই কাপড়টির দিকে তাকালেন, এবং দেখতে পেলেন রক্তাক্ত কাটা মাথার স্তূপ তার পরিবারের সদস্যদের যাদের তিনি হত্যা করেছিলেন। হতভম্ভ হয়ে তিনি সারমাদের দিকে তাকালেন এবং বললেন, কে বলেছে তোমায় এ কথা! সারমাদ হেসে বললেন, এখন আমায় বলো তুমি, আমি কি ঢাকবো? তোমার পাপ না আমার নগ্নতা?

নিচের রুবাইয়ের কালামগুলি অনুবাদে মূলভাব কতখানি রক্ষা পেয়েছে, তার জন্য আমি নিজেই অপরাধী।

………………………………………………………..
একত্ববাদ‬ : : ০৬
………………………………………………………..

বন্ধু ছিল শত শত লোক শত্রু হলো কেমন করে
অন্তরে তাঁর শান্তনা পাই, যে বন্ধু রয় ভেতরে
বেছে নিলাম একত্ববাদ, মুক্তি পেলাম অনেক হতে
আমি যে তার সে আমার, হলো শেষে এমন করে।

………………………………………………………..
অন্তরাকাশ‬ : : ০৭
………………………………………………………..

বন্ধু হে তাঁর আলিঙ্গনে হৃদয় তোমার রাখতে দাও
অন্তরে যে আকাশ তোমায় সে আকাশে উড়তে দাও
এই প্রেমিকের মুখের কথা রেখো মনে ভুলবে না
দুই জগতের ভাবনাসকল মন থেকে তাই মুছে নাও।

………………………………………………………..
খোঁজ‬ : : ০৮
………………………………………………………..

হৃদয় খুঁজে মরে ভোরের মৃদু হাওয়ায় সৌরভ তোমার
চোখ খুঁজে মরে সৃষ্টির বাগানে পুষ্পমুখ তোমার
হয় তুমি পথ দেখাবে তোমার সেই আবাসস্থলে
নয় তো আমায় দাও ছেড়ে একলা চলি পথে আমার।

………………………………………………………..
সত্য‬ : : ০৯
………………………………………………………..

আমি তখন সত্য হতে আসা আলোয় স্নানরত
ত্যাগ করে সব পরিকল্পনা, ফন্দিফিকির ছিল যত
সে তুরিয়ানন্দ পেতে হও তুমিও আমিত্বহীন
দেখবে তোমার অস্তিত্বসার দীপ্তিময় খোদারই মত।

………………………………………………………..
দয়া‬ : : ১০
………………………………………………………..

তাঁর মহানুভবতার সমুদ্রে নেই কোন বেলাভূমি
কণ্ঠে নেই জোর কৃতজ্ঞতার, হৃদয়ে অজ্ঞান আমি
যদিও পাপে পূর্ণ আছি, তার দয়া সদা প্রবহমান
অমান্যতার সাগরস্নানে থেকেও ডুবে মরি নি আমি।

………………………………………………………..
মহাবিশ্ব‬ : : ১১
………………………………………………………..

এ বিশ্বচরাচর, জগতসংসার আসলে বহুরূপীই তো
আশাহত হলে এই আশাবাদী, বসন্ত হয় তো এই হেমন্ত
ভুলে যাও চড়াই-উৎরাই, হয়রান হয়ো না তুমি
বেদনার প্রতিকারও তবে আরেকটি বেদনাই তো।

………………………………………………………..
ফানা‬ : : ১২
………………………………………………………..

প্রেমের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে আমি অধিষ্ঠিত হলাম
আর মানুষের অনুগ্রহের কারাগার হতে মুক্ত হলাম
জ্বলন্ত মোমের মতো গলে পড়লাম এই উজ্জ্বল সভায়
জ্বলে জ্বলে ঐশ্বরিক রহস্যালোকে অভিষিক্ত হলাম।

………………………………………………………..
একত্ববাদ : : ১৩
………………………………………………………..

আমি আর সে মিলে এক, যেমন শব্দ ও তার ব্যাখ্যা
দেখো বিচ্ছিন্নতায় একাত্ম হই, যেমন চোখ ও তার দেখা
একমুহূর্তের জন্যও আমি আলাদা নই তাঁর কাছ থেকে
দেখো আমরাই যৌথ সবখানে, যেমন ফুল ও ফুলের গন্ধটা।

………………………………………………………..
বসবাস‬ : : ১৪
………………………………………………………..

কেবল মন্দির আর মসজিদ নয় তাঁর নিবাস
সমগ্র সৃষ্টিজগতই তাঁর অস্তিত্বের অধিবাস
এ সৃষ্টিজগত যার পরম আখ্যানে মুগ্ধ রয়
কিন্তু প্রজ্ঞাবান চায় তাঁর প্রেমে হোক সর্বনাশ।

………………………………………………………..
‪‎নগ্নতা‬ : : ১৫
………………………………………………………..

তিনি প্রীত হন আমার বিনম্র স্বভাব দেখে
মন্দ দৃষ্টি আর মদমত্ততা চুরি হয় আমার হাত থেকে
তিনি আছেন অন্তরে; তাঁকে খুঁজে পেতে ভেতরে আমার
কী আশ্চর্য কথা, সে চোর আমাকে বাধ্য করে নগ্ন হতে!

………………………………………………………….

চিত্র ১ : এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনার আলোকে মিনিয়েচার চিত্রকলা। ছবিটির মূল বিষয় হলো মহান সুফি ফকির ও মরমী কবি সারমাদ কাশানীর সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়া এবং মাথা কেটে শাস্তি বাস্তবায়ন করবার মুহূর্ত। এটি একটি প্রতীকি চিত্রকলা। এখানে কেবল ঘটনার আদর্শটিকে চিত্ররূপ দেওয়া হয়েছে। সারমাদ কাশানী তাঁর আত্মত্যাগের কারণে সারমাদ শহীদ নামেই অধিক পরিচিত। তিনি ভারতে সক্রেটিস কিংবা মনসুর হাল্লাজের ভাগ্যবরণ করছেন।

চিত্র ৩ : শেষ চিত্রকলাটি পাকিস্তানের ৬০ দশকের বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পী সাদেকাইনের আঁকা। সাদেকাইন তাঁর নানান ছবিতে প্রতীকরূপে শহীদ সারমাদকে অঙ্কিত করেছেন।