তারেক মাসুদের সঙ্গে একটি শেষ না হওয়া তর্ক

জাহেদ সরওয়ার
Published : 16 August 2011, 01:25 PM
Updated : 16 August 2011, 01:25 PM

দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বইপ্রকাশের সঙ্গে জড়িয়ে আছি। দেশে চলচ্চিত্র বিষয়ক খুব বেশি বইপত্র নাই। এটা পীড়াদায়ক। ঘুরে ফিরে সেই বাণীশিল্পের বই। একটা পরিকল্পনা করেছিলাম। দেশে যারা চলচ্চিত্র নিয়ে গভীরভাবে কাজ করছে তাদের দিয়ে কিছু বইপত্র লেখাবো। তারই সূত্র ধরে প্রথম তারেক মাসুদের সঙ্গে পরিচয়। ফোনে আলাপের পরদিনই বাসায় যেতে বললেন। আমার চাইতেও উনি বেশি উৎসাহী। প্রথম সাক্ষাতে যা জানলাম তা হচ্ছে উনিও বহুদিন ধরে এ ধরনের একটা প্রজেক্টের কথা ভাবছেন। আর নিজের লেখাগুলোও গোছাচ্ছেন। উনি গ্রহণ করতে জানতেন। একেবারে নিখাদ ভাবে।

ফেব্রুয়ারি বইমেলা এলো বলে। বইটা গোছানোর সংকটকালীন বেদনার চাইতেও আনন্দিত হই তার সঙ্গ পাওয়ায়। কারণ চলচ্চিত্র পরিচালক হলেও তারেক মাসুদের সঙ্গে প্রায়ই কথা হতো বিশ্বসাহিত্য নিয়ে। অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া যে কত বড় সহনশীলতার পরিচায়ক, তাকে দেখে আরেকবার অনুভব করি।

বলা যায় গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ আমাদের ঘনিষ্ট হতে সহযোগিতা করেছিল। মার্কেজের হেন বই নাই যা তারেক মাসুদের পড়া ছিল না। বলা যায় মুখস্থ। নিজেও এক সময় পাগলের মত মার্কেজ পড়েছি। সে সব দিনকে মার্কেজময় বললেও অত্যুক্তি হয় না। যদিও মার্কেজকে এখন উপন্যাসের আঙ্গিকের কারণে যত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, বিষয় বা বক্তব্যের জন্য তত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না।

তখন রানওয়ে রিলিজ হয়েছে। অদ্ভুত পরিকল্পনা তার। এ ছবি হলে দেখানো হবে না। এমনকি ঢাকায়ও দেখানো হবে না। তাহলে দেখবো কেমনে? তিনি বললেন, রাজধানীতে দেখানো হবে সারাদেশে দেখানো পর। তিনি নিজের পরিকল্পনা মতো কাজ করেছিলেন। ছবিটা নিয়ে সারাদেশ চষে বেড়িয়েছেন। এইরকম কমিটেড কোনো পরিচালকের কথা আমার জানা নেই। তিনি বলেন যাদের জন্য ছবিটা বানিয়েছি তারা যদি দেখতে না পেলো তো কাজটাই অসম্পূর্ণ থেকে গেলো। যখন যেখানে যাচ্ছেন মেসেজ লিখে জানাচ্ছেন। একদিন চট্টগ্রাম থেকে ফোন দিচ্ছেন, অন্যদিন খুলনা থেকে। শিশুর মতো উচ্ছল তারেক মাসুদকে দেখতে থাকি। ফোনে বলছেন তিনি ছবি দেখাচ্ছেন, মানুষ ছবি দেখতে আসছে, এটাও আসলে তার গবেষণার বিষয়। সে সব দৃশ্যও তিনি চিত্রায়ণ করছেন নিয়মিত। এটা নিয়েও হতে পারে আরেকটা ছবি।

এর মাঝেই একদিন ফোন করে বলেন অমুক তারিখ এসো। আলী রিয়াজও আসবে, রানওয়েটা দেখে ফেলো। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে রানওয়ে দেখতে যাই। মার্কিন প্রবাসী রিয়াজ ভাই তারেক মাসুদের ঘনিষ্ট বন্ধু। তুই-তোকারি সম্পর্ক। (জানি না এই মৃত্যু সংবাদ শুনে তার কী অবস্থা হয়েছিলো)। রিয়াজ ভাইসহ সেদিন বসে রানওয়ে দেখি তারেক মাসুদের বসার ঘরের প্রজেক্টরে। রানওয়ে দেখতে গিয়ে প্রথম যে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলেছিলাম তা হচ্ছে ক্যামেরার কাজ। এত পরিপক্ক নিপুণ ক্যামেরার কাজ দেখে মনটা ভরে উঠল আশায়। এত উন্নতি হয়েছে আমাদের ছবির। তখনই জানতে পারলাম মিশুক মুনীরের কথা।

রানওয়ে দেখার পর আমাদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেন। অসাধারণ বাগ্মী রিয়াজ ভাই যে দৃষ্টিকোণ থেকে ছবিটিকে দেখলেন এবং ব্যাখ্যা করলেন–মুগ্ধ হয়ে আমরা শুনলাম। সবকিছু মনেও নেই। তিনি বলছিলেন, ছবির কেন্দ্রে যে পরিবার সেটা যেন বর্তমান বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি। কারণ বাংলাদেশে লাখ লাখ মানুষ শ্রমিক হয়ে যায় বিদেশে। বাংলাদেশের লাখ লাখ বালিকা ১৫০০ টাকায় চাকরি করে গার্মেন্টস্-এ আর মাইক্রো-ক্রেডিট প্রোগ্রাম পুরা দেশটাকে একটা জালের মতো ঘিরে আছে। এইসব হতদরিদ্র পরিবারের বেশিরভাগ ছেলে মাদ্রাসায় কয়েক ক্লাস পড়ার পর অথর্ব বেকারে পরিণত হয়। অন্যদিকে যারা আন্দোলন করছে তারাও জানে না তাদের মূল লক্ষ্য কি। তাদেরকে চালাচ্ছে বা ফাইন্যান্স করছে অন্য একটা আলাদা প্রোগ্রাম। কিন্তু তাদের লেবাস ইসলাম। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মূল ক্রাইসিসটাকেই চিহ্নিত করেছে মুভিটি।'

নিজের পালা এলে বললাম লিখিত জানাবো। এরপর রানওয়ে নিয়ে তৎকালীন সাপ্তাহিক মিডিয়াওয়াচ-এ একটা লেখা লিখি 'রানওয়ে: পথ জানে না পথের তালাশ' নামে। লেখাটায় বলেছিলাম, 'টেকনিক্যাল যে যে কারণে একটা ছবিকে আমরা সেরা বলি তার সবকিছুই আছে ছবিটায়। সত্যিকার অর্থেই মুগ্ধ করার মতো দৃশ্যাবলি, লোকেশন, নতুন অথচ অসামান্য অপেশাদার অভিনয় শিল্পীদের অভিনয়, চিত্র-অনুভবের গভীরে নিয়ে যাওয়ার মত লোকসঙ্গীতের ব্যবহার। চিত্রনাট্যের গতিশীলতা। আর মিশুকের পরিপক্ক ক্যামেরার কাজ তো আছেই। কিন্তু একটা টলটলায়মান নিম্নবিত্ত পরিবার নামক দোজখ থেকে বেরিয়ে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখা, এই অচলায়াতন বদলে দেবার স্বপ্ন দেখা যুবকটি আবার কেন ফিরে আসে? তাকে তার মা সুদে কেনা গরুর কাঁচা দুধ দিয়ে মুখ ধুয়ে বরণ করে নেয়। তার মানে সে আর বেয়াড়া হবে না। সে বর্তমান অবস্থাকেই মেনে নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত এই গল্পের গতিটাকে থমকে দিয়েছে। অনেকটা আত্মহনন চিন্তার মত।'

পরে লেখাটা আমার প্রবন্ধ সংকলন রাজ্য ও সাম্রাজ্যে-এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রকাশিত হবার পর তারেক ভাইকে মেসেজ পাঠাই। বিকালের দিকে তিনি ফোন করে বলেন, তোমার বিতর্কের জায়গাটা বুঝতে পেরেছি। আমি আসলে ছবিটাতে কোনো সমাধানই দেখাতে চাইনি। এ বিতর্ক তার বাসায় বসেও আমরা করেছি দিনের পর দিন। মাঝে মাঝে বিতর্কে অংশ নিতেন ক্যাথারিনও। শিশু নিষাদও পায়ে পায়ে এসে দাঁড়াত বসার ঘরে। বলে রাখা ভাল, যে বইয়ের সূত্রে তারেক মাসুদের সাথে যোগাযোগ, অনেক পরিকল্পনা সত্ত্বেও আমরা বইটার গোছানোর কাজ সম্পূর্ণ করতে পারিনি। কারণ তারেক মাসুদ নিজেই ছিলেন পরিপূর্ণ চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের চিন্তা আর পরিকল্পনা ছাড়া তার মাথার ভেতর আর কোনো পরিকল্পনা কাজ করতো না অথবা ইচ্ছা করেই রাখতেন না।

আমার কথা ছিল, রানওয়ের জঙ্গী হতে যাওয়া ছেলেটা ফিলসফিক্যালি কনভার্টেট। সে কিন্তু সঙ্গ দোষে জঙ্গী বা মুক্তির পথ খুঁজতে যায়নি। তার বাবা সৌদি আরব গেছে কাজের খোঁজে গ্রামের জমিজমা বিক্রি করে। মা গ্রামীণ ব্যাংকের লোন শোধ করতে করতে শেষ। ছোটবোনটি ১৫০০ টাকায় গার্মেন্টস্-এ চাকরি করে। সারাদিন, মাঝে মাঝে রাতেও। টাকার অভাবে তার আর মাদ্রাসায় পড়া হলো না। কোথায় তার মুক্তি। সে মামার কম্পিউটারের দোকানে কর্মরত, মাদ্রাসা পড়ুয়া জঙ্গী ছেলেটার সাথে চলে যায়। পরে সে দেখে জঙ্গীদের কাজকর্ম। তারা সিনেমা হল উড়িয়ে দিচ্ছে, বিভিন্ন অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। তাদের সাথে মধ্যপন্থী দলগুলো আবার জড়িত। স্রেফ রক্ত দেখেই কি ছেলেটা ভয় পেয়েছিল? এই হানাহানি দেখে সে ফিরে আসে আবার। কিন্তু সে কোথায় ফিরল। একটি অমীমাংসিত সংসারে, সমাজে, রাষ্ট্রে। এর মানে প্রচলিত ব্যবস্থাকে সে মেনে নিল।

এই ছিল বিতর্কের জায়গা। তিনি বলেছিলেন, 'এখানে নয়, অন্য কোনো ভাবে আসবে মুক্তি।' সেই অন্য কোনোটা দেখানোর দায়িত্ব চলচ্চিত্র পরিচালকের নয়। আমি বললাম তাহলে তো এটা সেই পুরানো কেচ্ছাই হয়ে গেলো যে অবশেষে তারা সুখে শান্তিতে বাস করিতে লাগিল। এরপর আসত ইলমাজ গুণ-এর কথা, ওসমান সেমবেন-এর কথা। যারা ক্যামেরাকে বুলেটের মত ব্যবহার করেছেন তাদের কথা। আমি বললাম, আমি খুশি হতাম যদি ছেলেটা জঙ্গী হামলায় মারা যেতো। চলচ্চিত্র মানে তো শুধু ছবি তোলা নয়। চলচ্চিত্রও তো কিছু একটা বলতে চায়। এভাবেই বার বার তার সাথে তর্কটা জমে উঠলেও শেষ হতো না। কিন্তু নিজেকে উৎরানোর প্রচেষ্টা তার মজ্জাগত। সেটা তার ছবিগুলো পরপর দেখলে বুঝা যায়। হেঁটে যাবার অনেক পথ সম্মুখে তৈরি করতে পেরেছিলেন তিনি, হেঁটে যেতেনও যতদূর যাওয়া যায়। তিনি বলতেনও আমি পথ পেয়ে গেছি জীবন সন্ধানের। কিন্তু কে আসলে তাকে চলতে দিল না, আমার বোধগম্য নয়। এই দমন-পীড়নের দেশে, গণপিটুনিতে গণহত্যার পরিবেশে, সড়ক দুর্ঘটনায় অগণিত পরিচয়হীন লাশের দেশে, মৃত্যু উপত্যকায় জন্ম নেওয়াটাই কি তার অস্বাভাবিক মৃত্যুর একমাত্র কারণ?

লেখকের আর্টস প্রোফাইল: জাহেদ সরওয়ার
sjahedpoet@gmail.com

ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts