কী পাইনি, তার হিসাব মেলাতে

গোলাম মুরশিদ
Published : 25 March 2016, 02:31 PM
Updated : 25 March 2016, 02:31 PM

সামাজিক উন্নতির যতো সূচক আছে, তার সবই নির্দেশ করে ২৬শে মার্চ আমাদের জন্যে এসেছিলো কী অকৃপণ অবদান নিয়ে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার অর্জন কতো ইতিবাচক। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ একটা বড়ো রকমের হোঁচট খেয়েছিলো। অর্থনীতিতে তার ছাপ পড়েছিলো। প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় তার আঘাতটা লেগেছিলো আরও তীব্রভাবে। দুর্ভিক্ষের সময় মানুষ অন্যের বমিও খেয়েছিলো–শোনা যায়। বাংলাদেশ ছিলো তখন পৃথিবীর সবচয়ে দরিদ্র চার-পাঁচটি দেশের মধ্যে একটি। কিন্তু এক দশকের মধ্যে মানুষ সেই প্রচণ্ড অভিজ্ঞতার কথা ভুলে গিয়েছিলো।

তারপর গত তিন দশকের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। কেবল গড়ে ওঠেনি, এমন বিস্তীর্ণ যোগাযোগ ব্যবস্থা এ অঞ্চলে আগে কখনো দেখা যায়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য এখন কালবাজারি-নির্ভর নয়, সে এখন আপন মহিমায় প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশ এখন আমদানির চেয়ে রপ্তানি করে অনেক বেশি। ৭২-৭৩ সালে শিল্প বলতে বোঝাতো জিঞ্জিরার নকল-কারখানা। এখন বহু ক্ষেত্রে দেশ শিল্পের জন্যে স্বনির্ভর। বাংলাদেশ পোশাক শিল্পে এখন বিশ্বের একটা প্রধান রপ্তানিকারক দেশ। বাংলাদেশে কেবল পোশাক নয়, জাহাজ পর্যন্ত তৈরি হয়।

এখন বাংলাদেশ তার দারিদ্রকে অনেক পেছনে ফেলে এগিয়ে এসেছে সামনের দিকে। বাংলাদেশের দারিদ্র্যসীমা এখন আগের তুলনায় অনেক পিছিয়ে পড়েছে। এখন আর সে পৃথিবীর দরিদ্র দেশগুলোর অন্যতম নয়। এখন সে নিম্নমধ্য আয়ের দেশ। এবং যেভাবে সে উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্চে, তাতে অচিরে সে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে বলে অর্থনীতিকরা আশা করছেন।

কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর শিক্ষায় তার পরিমাণগত উন্নতি। শিক্ষার মান কতোটা উন্নত হয়েছে, সে নিয়ে সন্দেহ থাকতেই পারে। উচ্চশিক্ষা অনেকটাই নামে মাত্র উচ্চশিক্ষা। কিন্তু আসলে যেখানে তার সত্যিকার উন্নতি হয়েছে, তা হলো: দেশে সাক্ষরতা – শিক্ষার হার – দ্বিগুণের চেয়েও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে যে-মেয়েরা এই সেদিনও শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে ছিলো ছেলেদের তুলনায়, সেই মেয়েরা এখন শিক্ষায় ছেলেদের হারিয়ে দিয়েছে – সংখ্যার দিক দিয়ে, মানের দিক দিয়ে। ১৯৭১ সালেও খুব কমসংখ্যক নারী চাকরি করতেন, আজ দেশের বড়ো বড়ো পদেও অধিষ্ঠিত আছেন নারীরা। কেবল তাই নয়, অর্থনীতিতে নারীরা গ্রামের দূরতম প্রান্তেও ভূমিকা রাখছেন। মাঠে কাজ করছেন, রাস্তায় নির্মাণে অবদান রাখছেন। শিক্ষা, সেবা ইত্যাদিতে এক সময়ে মেয়েরা ভূমিকা পালন করতেন। আজ তাঁরা বিমান চালনা করছেন, সামরিক এবং পুলিশ বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন, বিচারকের আসনে বসেছেন, উপাচার্য হয়েছেন। দেশের পোশাক শিল্পের কর্মীদের প্রধান ভাগই নারী। অর্থনীতিতে অবদান রাখার মাধ্যমে তাঁরা আজ নিজেদের পরিবার এবং সমাজেও নিজেদের বক্তব্যকে তুলে ধরতে সক্ষম হচ্ছেন। রাজনীতিতে নারীরা এখন সর্বোচ্চ স্থানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এমন কি, গ্রামের স্থানীয় সরকারেও তাঁরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন।

আরও একটা তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি হয়েছে গড় আয়ু বৃদ্ধিতে। ১৯০০ সালে যেখানে গড় আয়ু ছিলো তিরিশের ঘরে, এখন সেটা বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। শিশুমৃত্যুর হার একেবারে হ্রাস পেয়েছে।

এসব দিক বিবেচনা করলে বাংলাদেশকে উন্নতির একটা দৃষ্টান্ত বলে গণ্য করতে হয়।

কেবল একটি জায়গাতে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে, পিছিয়ে পড়ছে। যেসমস্ত মানবিক গুণাবলীর জন্যে মানুষ জন্তুকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়, সেসব মানবিক গুণ কেবল তাদের মধ্যে কম দেখা যাচ্ছে, তাই নয়, ক্রমাগত সেসব গুণ তাদের মধ্য থেকে লোপ পাচ্ছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। মানুষ আজ টাকার জন্যে তার মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিতে পারে। ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তির জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বীকে খুন করতে পারে। প্রতিদ্বন্দ্বীর শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করে মাটি চাপা দিতে পারে, অথবা পানিতে ভাসিয়ে দিতে পারে। আইনের প্রয়োগ যাদের হাতে, তারা আজ আইন হাতে তুলে নিতে দ্বিধা করছে না। যৌনক্ষুধা মেটানোর জন্যে মানুষ শিশুকেও ধর্ষণ করতে দ্বিধা বোধ করে না।

দেশ কি কেবল শিক্ষার হার? অর্থনৈতিক সূচক? গড় আয়ুবৃদ্ধি? বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বৃদ্ধি? দেশ মানুষের জন্যে। দেশের জন্যে মানুষ নয়। আমাদের স্বাধীনতা দিবস কেবল বাহ্যিক উন্নতির সূচকগুলো উদযাপন করার কথা মনে করিয়ে দিতে আসে না। সে আমাদের মানবিক অর্জনগুলোকেও পরিমাপ করার কথা মনে করিয়ে দেয়। সেখানে আমরা যেন কেবল পিছিয়ে না-পড়ি!
২৪ মার্চ ২০১৬, লন্ডন