খেটে খাওয়া মানুষদের কথা চিন্তা করে, একবার পিছন ফিরে তাকান!

মেঘ-রুদ্র
Published : 24 April 2012, 11:25 AM
Updated : 24 April 2012, 11:25 AM

মোড়ের টঙ্গ দোকানটা আজ তিন দিন যাবৎ বন্ধ। বৃদ্ধ করিম চাচা এই দোকানের মালিক। তিনদিন যাবৎ তিনি বাসা থেকে বের হননি। খোলাও হয়নি দোকান। চা বানাতে বানাতে উপদেশের বাণীও ছুড়ে দেননি কোন আগন্তুককে। কারণ একটাই হরতাল। তাঁর প্রতিদিনের রুটিন ছিল ফজরের নামায় পড়ে ফুলগাছগুলোর পরিচর্যা করা, মুরগিগুলো বিষ্ঠা পরিষ্কার করে,এদের খাবার দেওয়া। তারপর গোসল করে ধোয়া উঠানো গরম ভাত খেয়ে দোকানটা খোলা। চায়ের পানি গরম হতে না হতেই লোকজনের ভীর লেগে যেত। সাধারণত যারা গ্রাম থেকে আসতো- প্রথম তো তারা স্থায়ী কোন কাজ না পেত, তখন তারা ছুটা কাজ বেচে নিত। এই ছুটা কাজের লোক জন প্রায় সবাই মোড়ের এই টং দোকানটিতে এসে হাজির হতো। তারা সবাই চাচার হাতে এককাপ চা খেয়ে যে যার কাজে চলে যেত। কখনো চায়ের দাম পরিশোধ করতো কখনোবা কাজ শেষ করে এসে চায়ের দামটা দিয়ে যেত।

এদের মধ্যে জমির শেখ এসেছেন রংপুর থেকে তার তিনটা মাত্র মেয়ে। বড় দুটা মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলেও ছোট মেয়েটা রয়ে গেছে। একবার এ মেয়েটার বিয়েও ঠিক হয়েছিল, কিন্তু যৌতুকের টাকা দিতে না পারায় তার বিয়েটা বন্ধ হয়ে যায়। তাই রাগে-দুঃখে গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছেন এই যান্ত্রিক শহরে। তাঁর ইচ্ছে কাজ করে টাকা জমিয়ে ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দিবেন। অথচ আজ তিন দিন যাবৎ তার কাজ নেই? যেখানে বেঁচে খাকাটা নিতান্ত কষ্টকর হয়ে উঠেছে, সেখানে মেয়ের বিয়ের টাকা জোগাড় করা এ যেন গরিবের ঘোড়ার রোগ?

রফিক মিয়া এসেছে কিশোরগজ্ঞ থেকে। তার ছোট ভাই এবার এইস.এইচ.সি পরীক্ষা দিচ্ছে। বাবা মরা যান পাঁচ বছর আগে, দু'বছর হলো মা মারা যান। তারা দু'ভাই এক বোন। বোনটার বিয়ে হয়েছে। সংসারে এই দু'টি ভাই ছাড়া আর কেই নেই। ভাইকে মানুষের মতো মানুষ করবেন বলে নিজে বিয়েটুকু পর্যন্ত করেন নি। তার এক কথা আগে ভাইটা মানুষ হোক, তারপর দেখা যাবে।

ভাইকে দেখভাল করার জন্য বোনকে রেখে চলে এসেছেন ঢাকায়। বাড়তি কিছু পয়সা রোজগার করে ভাইকে উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি করাবেন।কিন্তু আজ তার কাজ নেই, অলসভাবে দিনপার হচ্ছে।এক অজনা শঙ্কা কাজ করছে তার মনের ভেতর, তাহলে ভাইয়ের লেখাপড়াটা…….।

ছালেহা খাতুন এসেছেন সুনামগঞ্জের তাহিরপুর থানার সোলেমানপুর থেকে। বৃদ্ধ মা-বাবা ছাড়া তার আর এ দুনিয়াতে কেই নেই। বিয়েও একবার হয়েছিল, কিন্তু স্বামী এখন নিরুদ্দেশ। মা-বাবার সুখে সুখী হতে চেয়েছিল ছালেহা। বাবা হাঁপানি রোগী,মা প্যারালাইজড রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনবছর হলো শয্যাসঙ্গী। প্রতিদিন শ, দেড় শ টাকার ঔষধ লাগে। আর পথ্য সেই পাথর মেশানো সাদা ভাত আর ডাল। তিনদিন কাজ করতে না পারায় ছালেহা আজ দিশেহারা। উনুনে আগুন নেই, বাবার শ্বাসকষ্টটা বেড়েছে,ঔষধ চাচ্ছেন বারবার। দিব-দিচ্ছি, আনবো -আনছি বলে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ছালেহা। গত দু'দিন যাবৎ এর-তার কাছে চেয়ে বাঁসি ভাত এনে দিয়েছিলেন মা-বাবার মুখে। কিন্তু আজ কার কাছে হত পাতবে? কপাল ছাপাড়ানো ছাড়া আর কী-ই-বা করার আছে ছালেহার?

করিম চাচা বারান্দায় পেপার পড়ছেন আর মনে মনে দুশ্চিন্তা করছেন, এই খেটে খাওয়া মানুষগুলোর কী হবে? যাদের একদিন কাজ না পেলে উনুনে আগুন জ্বলে না? সেখানে টানা তিন দিন? এরা কি বেঁচে আছে না…..?

চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন-কেন এত কষ্ট করে স্বাধীন করেছিলাম এই দেশ ? জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে গিয়েছিলাম দু'বেলা দু'মুঠো ভাত শান্তিতে খেতে পারব বলে? নিশ্বাস ভরে বাসাত নিতে পারবো বলে? আমার প্রজন্ম স্বাধীন বাংলায় বেড়ে উঠবে বলে?

কই গেল আমার সেই স্বাধীনতা? জমির শেখ তো এ দেশে বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি চায়নি? চেয়েছে গা-গতরে খেটে দু'মুঠো অন্নের জোগান আর মা মরা মেয়েটার গায়ে লাল একটা শাড়ি? এটা কি খুব বেশী চাওয়া? নাকি এই চাওয়াটা তাঁর অন্যায়?

রফিক তাঁর ভাইকে লেখাপড়া শিখিয়ে এ দেশের সম্পদ করতে চায়? সে তো চায়নি দুর্নীতি করে কালো টাকার পাহাড় গড়তে? গ্রামের নিতান্ত সহজ-সরল এই ছালেহা আলিশান বাড়িতে থাকতে চায়নি? চেয়েছে শুধুমাত্র বৃদ্ধ মা-বার মুখে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী দু'টা ট্যাবলেট তুলে দিতে।

যেখানে আমাদের হর্তাকর্তারা সামান্য পেটের ব্যাথা অনুভব করলে, রাজ্যের সব কাজ ফেলে ছুটে চলেন ফাইভ স্টার ক্যাটাগরির বিদেশি হাসপাতালে? আর সেই একই রাজ্যে ছালেহাদের একদিন কাজ বন্ধ থাকলে, মুখের আহারও বন্ধ হয়ে যায়? কী অপূর্ব আমাদের এই দেশ?

করিম চাচা দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলেন-যে দেশে মানুষের নিরাপত্তা নেই, দিন-দুপুরে ছিনতাই-রাহাজানি, মানুষ গুম, কোলের শিশু অপহরণ, নিজ ফ্ল্যাটে মানুষ খুন? এদেশে আমাদের বেঁচে থেকে আর লাভ কী? কালকে যে আমিও খুন হবো না এর গ্যারান্টি কী?

এদেশের প্রতিটা মানুষ এখন এক একটা জীবন্ত লাশ। আজ তিন দিন যাবৎ জীবন্ত লাশ হয়েই আমার চারদেয়ালে বন্দি হয়ে আছি? এখানে একটা কথা থেকে যায় , তাহলে সরকার আছে কী জন্যে? এদেশের সকল নাগরিকের জীবন,মালের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব কী সরকারের উপর বর্তায় না? সরকার কী ঐসব খেটে খাওয়া মানুষের কষ্ট দেখে না, নাকি দেখেও না দেখার ভান করে আছে?

বিরোধী দলের ডাকা হরতাল কাদের জন্য? এদেশের ষোল কোটি খেটে খাওয়া মানুষের জন্য নাকি যারা আলিশান কামরায় কাটা চামচ দিয়ে মুরগির রান খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেন তাদের জন্য? কথায় কথায় হরতাল, ভাঙ্গচুর, অগ্নিসংযোগ, নিরীহ মানুষ খুন-ই কী তাদের রাজনীতি? গত তিনদিনে যে কয় জন ড্রাইভার, পথচারী খুন হয়েছেন, ফিরিয়ে দিতে পারে আপনাদের রাজনীতি?

হাসি খুশিতে ভরিয়ে দিতে পারবেন তাদের ভেঙ্গে যাওয়া পরিবারগুলোকে? যা ফিরিয়ে দিতে পারবেন তা কেড়ে নেওয়ার অধিকার তো নেই?

সমস্যা আসবে, তার সমাধানের পদক্ষেপও নিতে হবে? তাই বলে তো নিরীহ মানুষ খুন করে কী এর সমাধান হবে? অতীতেও বহুবার জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতির খেলা হয়েছে, কিন্তু ঐ খেলায় হার ছাড়া অন্য কোন বস্তুর সাথে আমরা পরিচিত হইনি? মধ্যেখানে কতগুলো নিরীহ মানুষের বুক খালি? তাদের স্বজনদের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠে, বোধকরি কংক্রিটের দেয়ালও ভেদ করে যায় কিন্তু এই পাষাণ মানুষদের মন গলে না?

ষোল কোটি এই নিরীহ, খেটে খাওয়া মানুষদের কথা চিন্তা করে, একবার পিছন ফিরে তাকান! এরা কেউ না কেউ আমাদেরই একজন ভাই, বোন, ভগ্নি। পৃথিবীর এমন কোন দেশ নেই যেখানে নিজের ভাই, বোনকে মৃত্যুর হাতে ঠেলে দিয়ে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায়?

মেঘ-রুদ্র
সিলেট-২৪-০৪-২০১২খ্রি