মুক্তিযুদ্ধে নকশালবাড়ির বৈঠক

এম ইনায়েতুর রহিম
Published : 13 Feb 2012, 02:45 PM
Updated : 5 July 2021, 05:53 PM

বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের রাজনৈতিক সচেতন মানুষ 'নকশালবাড়ি' ও 'নকশাল' শব্দ দুইটির সাথে বেশ পরিচিত। এ শব্দ দুইটি শোনা বা মনে হওয়া মাত্রই অনুভূত হয় নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। মূলত 'নকশালবাড়ি' ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমার একটি এলাকার নাম। এলাকার নাম অনুসারে থানার নামও নকশালবাড়ি। ওই নকশালবাড়ি এলাকা বাংলাদেশের উত্তর সীমান্ত পঞ্চগড় জেলার বাংলাবান্ধা থেকে কাছে। আবার নেপাল সীমান্তেরও খুব কাছে। 

ভারত উপমহাদেশ তো বটেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও নকশালবাড়ির পরিচিতি পায় ১৯৬৭ সালের মে মাসের শেষ দিকে। স্থানীয় জমিদার-জোতদারদের বিরুদ্ধে সাধারণ বর্গাচাষী, কৃষক-ভূমিহীনদের বিদ্রোহের কেন্দ্র ছিল এ নকশালবাড়ি। কমিউনিস্ট নেতা চারু মজুমদার, কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল এর নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল সশস্ত্র কৃষক আন্দোলন। 'লাঙ্গল যার, জমি তার' -এ শ্লোগানে উজ্জীবিত হয়ে শুরু হয় শক্তি প্রয়োগে জোর-জবরদস্তিভাবে লাল পতাকা উড়িয়ে জমিদার-জোতদারদের জমি দখল, ক্ষেতের ফসল কাটা। ১৯৬৭ সালের ২৫ মে নকশালবাড়ির বেঙ্গাইজোত গ্রামে জড়ো হয়েছিল হাজারো কৃষক, শ্রমজীবী মানুষ। এর আগে আন্দোলকারীদের তীরের আঘাতে নিহত হয়েছিলেন নকশালবাড়ি  থানার একজন পুলিশ কর্মকর্তা। আন্দোলনকারীদের নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে পুলিশ আক্রমণ চালায় আতাদের ওপর। রক্তাক্ত হয় বেঙ্গাইজোত গ্রাম। নিহত হন দুইজন শিশুসহ ১১ জন। নিহতদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা ছিল বেশি, কেননা তারা ছিলেন মিছিলের সম্মুখভাগে। তাদের দুগ্ধপোষ্য শিশুরা ছিল পিঠে বাঁধা। এ ঘটনার পর থেকে নকশালবাড়ির সে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে 'নকশাল আন্দোলনে' নামে। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশেও নকশাল আন্দোলনের ঢেউ লাগে বিভিন্ন আঙ্গিকে। 

১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঐতিহাসিক একটি ঘটনার সাক্ষী এ নকশালবাড়ি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ এর ২৬শে মার্চ এর প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে শুরু হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রতিরোধে সশস্ত্র যুদ্ধ। একাত্তরের ১০ এপ্রিল রচিত হয় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং গঠিত হয় কারারুদ্ধ বঙ্গবন্ধু-কে রাষ্ট্রপতি করে বাংলাদেশের প্রথম সরকার। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ। একাত্তরের ১৭ এপ্রিল তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে (পরবর্তীতে যার নামকরণ হয় মুজিবনগর) দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও শপথ নেওয়ার মাধ্যমে শুরু হয় বাংলাদেশের প্রথম সরকারের ঝঞ্ঝাময় চ্যালেঞ্জিং পথ চলা। এ সরকার বহুলভাবে পরিচিতি লাভ করে 'মুজিবনগর সরকার' হিসেবে। সরকার গঠনের পর কোন কোন মহল প্রশ্ন ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করে সরকার গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে। আবার কোন মহল হতে দাবি করা হয়- 'যুদ্ধের সময়ে প্রয়োজন বিপ্লবী সরকার'। আবার কারো দাবি ছিল 'সর্বদলীয় জাতীয় সরকার' কিংবা 'জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট' গঠন। সর্বোপরি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও তার কতিপয় সহযোগীর প্রচেষ্টা ছিল সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্ব নেওয়া; সরকারের প্রতি আস্থাহীনতার পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। এ পরিস্থিতিতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী এবং ভারত সরকারের কাছে এ ধরনের একটি বার্তা যায় যে, ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বাংলাদেশের নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের প্রতিনিধিদের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ও সরকার গঠনের বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন। 

ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুজিবনগর সরকারে প্রতি জনপ্রতিনিধির আস্থার বিষয়টি দৃশ্যমান করা জরুরী হয়ে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে একাত্তরের ৬ ও ৭ জুলাই নকশালবাড়ি ভারতীয় বর্ডার ফোর্স (বিএসএফ) এর আঞ্চলিক সদর দপ্তর সংলগ্ন শালবাগানে অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যের যৌথ সভা। সভায় ১৩৫ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য ও ২৩৯ জন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য উপস্থিত ছিলেন। 

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকটিতে উপস্থিত ছিলেন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানীসহ প্রায় সব নেতারাই।

 ওই বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের মধ্যে অন্যতম ছিল-

ক. বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাকে অকুণ্ঠ সমর্থন এবং তার প্রতি অবিচল আস্থা রেখে স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে  যাওয়া;

খ. মুজিবনগর সরকারের প্রতি পূর্ণ আস্থাজ্ঞাপন;

গ. পাকিস্তানের সাথে যে কোন রাজনৈতিক সমঝোতার সম্ভাবনা নাকচ;

ঘ. পাকিস্তানের কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধুর নি:শর্ত মুক্তি দাবী এবং এ লক্ষ্যে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলা;

ঙ. বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা-নির্যাতন বন্ধে জাতিসংঘসহ বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলো যাতে পাকিস্তান সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে- সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া;

চ. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা যাতে কোন ভাবেই বিঘ্নিত না হয় সে বিষয় আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি  আকর্ষণ;

ছ. যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পাকিস্তান সরকারকে অস্ত্র সরবরাহের নিন্দা প্রকাশ ও বাংলাদেশ গণহত্যা বন্ধের দাবী;

জ. যুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।

ওই বৈঠকে খন্দকার মোশতাক ও তার কতিপয় অনুসারী সরকারের ওপর অনাস্থা ও বিভিন্ন সিদ্ধান্তে বিরোধিতা করার কারণে তিনি অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হন এবং এক পর্যায়ে বৈঠক ত্যাগ করেন। 

জনপ্রতিনিধিদের ঐতিহাসিক ওই বৈঠকের পর স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুক্তি সংগ্রাম নতুন গতি লাভ করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ও তার সরকারের পূর্ণ আস্থা অর্জনে সক্ষম হয় মুজিবনগর সরকার। ওই বৈঠক সম্পর্কে ৩০ জুলাই ১৯৭১ মুজিবনগর হতে প্রকাশিত জয় বাংলা পত্রিকায় (১ম বর্ষ: ১২ তম সংখ্যা) আহমদ রফিক সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন- "এই বৈঠক প্রমাণ করেছে ইয়াহিয়া চক্রের বর্বরতার মুখেও বাংলাদেশের গণঐক্য অটুট, গণপ্রতিনিধিরা ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীনতার চুড়ান্ত লক্ষ অর্জনে দৃঢ়সংকল্প। এ বৈঠক আমাদের মুক্তিবাহিনীর মনে নতুন প্রেরণা এনেছে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনে এনেছে নতুন প্রত্যয়, সুপ্ত সাহস। বহি:বিশ্বের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোও উপলব্ধি করেছেন, বাংলাদেশের এক মাত্র বৈধ ও প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।" (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিপত্র: ষষ্ঠ খণ্ড, পৃ: ৪৫)

অবশ্য ওই সম্পাদকীয়তে বৈঠকের স্থান মুজিবনগর উল্লেখ করা হয়েছিল। সম্ভবত এটা করা হয়েছিল কৌশলগত কারণে। মূলত বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে বৈঠকটি বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল তেঁতুলিয়া-বাংলাবান্ধার কাছে নকশালবাড়ি বিএসএফ-এর আঞ্চলিক সদর দপ্তর সংলগ্ন শালবাগানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এলাকাটি বর্তমানে শিলিগুড়ি-বাঘডোগরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিকটবর্তী। তৎকালীন জাতীয় পরিষদ সদস্য অধ্যাপক আবু সাইয়িদ তার লেখা 'যেভাবে স্বাধীনতা পেলাম (পৃ: ১৯৫)' বইয়ে উক্ত বৈঠকটি বাঘডোগরায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন। বাঘডোগরা, নকশালবাড়ি পঞ্চায়েত সমিতি ও কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ব্লকের অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ নকশালবাড়ি প্রশাসনের অধীন। উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে, বর্তমান পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া-বাংলাবান্ধা অঞ্চল মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্ত মুক্তাঞ্চল হিসেবে। যুদ্ধের সময়ে ওই এলাকা সফর করেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান, প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী-সহ অনেকেই। 

রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী সম্পাদিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র (মুক্তিযুদ্ধ পর্ব) ১৯৭১, পৃষ্ঠা-১৮৬ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিপত্র: ষষ্ঠ খণ্ড, পৃ: ৪৮২-তে বৈঠকটি সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের বাংলাদেশ মিশন, বহি:বিশ্ব প্রচার দপ্তর কর্তৃক মুজিবনগর হতে ২১ জুলাই ১৯৭১-এ প্রকাশিত ইংরেজি সাপ্তাহিক 'বাংলাদেশ' এ প্রকাশিত 'ELECTED REPRESENTATIVES-VOW AFRESH' শিরোনামের ওই প্রতিবেদনটিতে বৈঠকটির স্থান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন কিছু উল্লেখ না করে 'বাংলাদেশের কোন এক স্থানে অনুষ্ঠিত হয়' মর্মে উল্লেখ করা হয়। 

১৬ জুলাই ১৯৭১ 'দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া' পত্রিকায় ওই বৈঠকের খবর প্রকাশ হয় 'AWAMI M.P.s' ALL-OUT WAR PLEDGE' শিরোনামে। ওই প্রতিবেদনেও বৈঠকটির সুনির্দিষ্ট স্থান উল্লেখ না করে বাংলাদেশের কোন এক স্থান (somewhere in Bangladesh) উল্লেখ করা হয়। (বাংলাদেশ ডকুমেন্টস: ভলিউম-১, পৃষ্ঠা-৩৩৬)

ওই বৈঠকে অংশগ্রহণকারী মুজিবনগর সরকারের পশ্চিম জোন-১ এর চেয়ারম্যান তৎকালীন এমপি এম আব্দুর রহিম এ বৈঠকটি সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এভাবে-

উপস্থিত এমএনএ এবং এমপি-দের নিয়ে নকশালবাড়ির বিশাল শালবাগানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন মুজিবনগর সরকারের তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানীসহ আরও অনেকে। এটিকে একটি মিনি যৌথ পার্লামেন্টও বলা যায়। এই অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। আমরা জনপ্রতিনিধি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি অবিচল আস্থা রেখে আমৃত্যু যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সদা প্রস্তুত। সর্বসম্মত রেজুলেশন গ্রহণ করে সেটা ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্টকে দেয়া হয়। কিন্তু মুজিবনগর সরকারের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ আমাদের এই সিদ্ধান্তে ভিন্নমত প্রকাশ করেন। এই সভাতেই তার ডিফারেন্স অব অপিনিয়ন এলো। খন্দকার মোশতাক প্রকাশ্যেই পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করার কথা বললেন। তিনি কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব করলে সভায় উত্তেজনা দেখা দেয়। তখন রাগ করে খন্দকার মোশতাক তাৎক্ষণিকভাবে অধিবেশন ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে আরও জানা গেছে, খন্দকার মোশতাক কনফেডারেশন গঠনের জন্য যুদ্ধকালেই নাকি গোপনে তার প্রতিনিধি হিসেবে কয়েক জনকে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছিল। এই অন্তর্ঘাতকের হীনমানসিকাতার চরম বহি:প্রকাশ ঘটে '৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে এবং ৩রা নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে।

… আমার স্মৃতির পাতায় আজও অমলিন হয়ে আছে নকশালবাড়ির সেই ঐতিহাসিক অধিবেশনের কথা। যেখানে সমবেত সদস্যগণের অবস্থানকালে আতিথেয়তার জন্য যে সব সামগ্রী আমাদের সরবরাহ করা হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল একটি দড়ির খাটিয়া, তিনটি কম্বল, একটি মশারি, একটি পানীয় জলের বোতল ও একটি মগ। খাবার সরবরাহের দায়িত্ব ছিল বিএসএফ কর্তৃপক্ষের।

 বাঙালি জাতির সেই দুর্যোগময় মুহূর্তে বিশ্বমানবতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সেদিন সেই ঐতিহাসিক অধিবেশনে গৃহীত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার উদ্যোগী হয়ে যৌথ কমান্ড বাহিনী গঠন করে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় সাহায্য ও সহযোগীতা প্রদান করে। আমার বিশ্বাস ভারত সরকার দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত যে সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করেছিল তা জাতি কোনোদিন ভুলবে না।" (মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুর- সম্পাদক সুকুমার বিশ্বাস, প্রকাশক মাওলা ব্রাদার্স; দিনাজপুরে মুক্তিযুদ্ধ-সম্পাদনা ড: মোহাম্মদ সেলিম।)

৬ ও ৭ জুলাই ১৯৭১ নকশালবাড়িতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের যৌথ বৈঠক স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে নতুন গতিসঞ্চার করে। জনপ্রতিনিধিদের অকুণ্ঠ সমর্থনে মুজিবনগর সরকার আইনানুগ সরকার হিসেবে ভারত সরকারসহ বিশ্বের বিভিন্ন সরকার ও দেশের কাছে যথাযথভাবে উপস্থাপন ও প্রতিনিধিত্ব করার পথ সুগম হয়। তরান্বিত হয় আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ।