(বাংলাদেশের) মাননীয় অর্থমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি পূরণ

হৃদয়ে বাংলাদেশ
Published : 8 June 2012, 05:13 AM
Updated : 8 June 2012, 05:13 AM

আমাদের সংস্কৃতিতে প্রতিশ্রুতি পালন একটি বিরল ঘটনা। বাংলাদেশের সৌভাগ্য যে বর্তমান অর্থমন্ত্রীকে বাংলাদেশ পেয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে তাঁর কাঙ্খিত লক্ষ্যে, অন্য ভাষায় তাঁর উপর আরোপিত লক্ষ্যে, তিনি ধীর কিন্তু স্থির ও দৃঢ় পদক্ষেপে পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন। তাঁকে আমাদের কৃতজ্ঞতা জানানো উচিৎ।

উপরের মুখবন্ধের সুত্র (বাংলাদেশের) মাননীয় অর্থমন্ত্রীর সর্বশেষ বাজেট ঘোষনা। বাজেট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা যোগ্য মানুষেরা হয়ত এই ব্লগেই করবেন, আমার পোস্টে বিস্তারিত বলার সুযোগও নেই, আমি নিজেকে এ কাজের যোগ্য মানুষ নই বলে স্বীকার করতে হীনমন্যতায়ও ভুগছিনা। তাই মোটের উপর (বাংলাদেশের) মাননীয় অর্থমন্ত্রীর প্রসবিত বাজেটের কিছু প্রধান বিষয়ের (ইংরেজীতে বলা যেতে পারে Salient Features) উপর আলোকপাত করবো।

একজন সাধারন পেশাদার হিসেবে, অন্য যে কোন শিক্ষিত মানুষের মতোই, বাজেটের কিছু বিশেষত্ব আমার নজরে এসেছে, তা আমি আপনাদের সাথে ভাগাভাগি করতে চাই যাতে একটি বিদগ্ধ আলোচনার সুত্রপাত করা যায়। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, একটি বাজেটের প্রভাব এবং ভার জনগনের উপর পড়ে। তাই বাজেটকে একটি খটোমটো ও জটিল অর্থনীতির বিষয় বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া উচিৎ হবেনা।

* এবারের বাজেটে প্রথমেই যে বিষয়টির উপর চোখ আটকে যায় তা হলো ১০% কর দিয়ে সব খাতে কালো টাকা সাদা করা যাবে। কালো টাকার উৎস হচ্ছে জনগনকে লুন্ঠন। তাহলে জনগনের লুন্ঠিত টাকা কোন প্রশ্ন ছাড়াই যেখানে খুশি সেখানে বিনিয়োগ করে রাষ্ট্রীয় অনৈতিকতা পোষকতার একটি সাফল্যের পালক সরকারের টুপিতে যোগ হলো। আমরা আশা করবো, মন্ত্রী-আমলারা আর নৈতিকতার গান গাইবেন না।

* বাজেটে করের আওতা বাড়ানো হয়েছে (যারা সেল ফোনে সারা রাত ধরে ওঁর সাথে প্রেমালাপ করেন, তারা মনে রাখবেন বিলের সাথে ২% কর যোগ হবে) এবং অতি স্বাভাবিকভাবেই উচ্চবিত্তদের আহত না করে তা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর উপর। কর্পোরেট কর বৃদ্ধি না করে চাকুরীজীবীদের ন্যূন্যতম কর ৫০% বাড়িয়ে তিন হাজার করা হয়েছে। ফলে যারা কর দেন তাদের এখন কর আইনজীবীদের কাছে দৌঁড়াতে হবে এবং কর কর্মকর্তাদের সেলামী বাড়িয়ে দিতে হবে।

* (বাংলাদেশের) মাননীয় অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় জানাননি কোন কোন খাতে সেবার (বিদ্যুৎ, জ্বালানী) মূল্যবৃদ্ধি হবে। একই সাথে কোথায় কোথায় ভর্তুকি কমানো হবে। ফলে, গ্রাহকেরা মোটামুটি টেনশনে থেকে বিদ্যুৎহীন নির্ঘুম রাত কাটাতে পারবেন।

* আমরা জানছি যে সরকারী-বেসরকারী খাতে অর্থবরাদ্দ বেড়েছে। অর্থাৎ আমাদের 'শিল্পোদ্যোক্তারা' নির্বিঘ্নে কালো টাকা নিয়ে জনসেবামূলক প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে পারবেন। আর অতি অবশ্যই এইসব প্রকল্প মুনাফার জন্য পরিচালিত হবে।

* সরকার নগদ অর্থ ঘাটতির মোকাবেলায় ব্যাঙ্ক থেকে আরো বেশী ঋণ নেবে। যা অতি অবশ্যই ব্যাংকগুলোর তারল্য কমাবে। আগামি বছরেও একখানা চেক নিয়ে ব্যাঙ্কে গেলে পুরো টাকা একবারে পাবেন না। একই সাথে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের ঋণ লাভ প্রায় অসম্ভব হবে। অথচ আমরা স্বীকার করি বা না করি, দেশীয় উদ্যোক্তারাই কিন্ত কর্মবাজার ও সুযোগ সৃষ্টি করেন এবং দেশীয় বাজারে তাদের পণ্য বিক্রয় বানিজ্য চক্রের মাধ্যমে অর্থপ্রবাহ ও জিডিপিতে অর্থনীতির ভাষায় Multiplier সৃষ্টি হয়।

* রাজনৈতিকভাবে খালেদা জিয়া যাই হোন, তিনি যে আইএমএফ থেকে কঠোর শর্তে ঋণ নেয়ার কথা বলেছেন, (এবং অর্থমন্ত্রী যাকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন যে কেউ প্রমান করতে পারলে তিনি চলে যাবেন), তা সত্য। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম এম আকাশ জানাচ্ছেন, "শর্তটা হলো, ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়ামের দাম বাড়লে সেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদ্যুতের দামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে।" (সুত্র: বাজেট-ভাবনা,অধ্যাপক এম এম আকাশ, বিডিনিউজ২৪.কম)

উপরের অল্প কয়টি উদাহরণ থেকে আমরা ধারনা করতে পারি যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সরকারী নিয়ন্ত্রণ কমবে, উচ্চবিত্তদের কর সুবিধা প্রাপ্তি হবে এবং মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে ভর্তুকি হ্রাস করা হবে। এই তিনটি বিষয়ই অনেকের কাছে পরিচিত মনে হবে। কারন যারা অর্থনীতি নিয়ে খানিকটা পড়াশোনা করেন, তারা জানেন যে এই সূত্রগুলি মুক্তবাজার অর্থনীতি ধারনার মহান পিতা মিল্টন ফ্রিডম্যানের মস্তিষ্কপ্রসূত। এই সুত্রগুলোই বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এর মতো ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান তাদের মূলনীতি হিসেবে গ্রহন করেছে। বিশ্বব্যাংকের নির্বাচিত (chosen) এ এম এ মুহিত গত চারবছরে প্রশংসনীয় ধৈর্য্যের সাথে একটু একটু করে বিশ্বব্যাংকের কাছে দেয়া তাঁর প্রতিশ্রুতি প্রায় পূরণ করে ফেলেছেন। যারা এতক্ষণ ভুরু কুঁচকে ভাবছিলেন জনাব এ এম এ মুহিত কী প্রতিশ্রুতি পালন করেছেন? এখন নিশ্চয়ই তাঁদের দ্বিধা কেটেছে এবং বুঝতে পারছেন কার কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন এই বাজেট। একই কারনে, আমি জনাব এ এম এ মুহিতকে (বাংলাদেশের) অর্থমন্ত্রী বলেছি। কারন তিনি তো আর বাংলাদেশের কথা মাথায় রেখে এই বাজেট প্রস্তুত করেননি। তিনি মুনাফাভিত্তিক, ভর্তুকি হীন এবং সরকারী নিয়ন্ত্রনমুক্ত বাজেট করেছেন। মিল্টন ফ্রিডম্যান নরক থেকে নিশ্চয়ই জনাব এ এম এ মুহিতকে সাবাসি দিচ্ছেন।
সংযোজন ৯ জুন, ২০১২: "আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ১ বিলিয়ন ডলার সহায়তা চুক্তির কারণে কৃষিতে ভর্তুকি কমানো, বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি বিষয়ে সরকারের তথ্য আড়াল করা, করারোপের মাধ্যমে সরকারের আয় বাড়ানো এবং ব্যয় কমিয়ে আনা হয়েছে…….। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সুত্র: আমার দেশ http://www.amardeshonline.com/pages/details/2012/06/09/148943

সবাইকে ধন্যবাদ।