টিলা দেশের সহজ কথা

নেংমিঞ্জা বাপন
Published : 12 March 2016, 05:04 AM
Updated : 12 March 2016, 05:04 AM

ছোটবেলা থেকে শুনে আসা ময়মনসিংহ গারো পাহাড় কথাটি বড় হয়ে বেমালুম ভুলে যেতে শুরু করেছি। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলের বা উত্তরাঞ্চলের কারো সাথে যখন প্রথম পরিচয় হয় তখনই ময়মনসিংহ গারো পাহাড়ের কথা জিজ্ঞেস করেন। উৎসুক হয়ে জানতে চান আপনাদের এলাকা, দেশ, গ্রাম দেখতে কেমন? আমি একটু চুপ করে উত্তর দেবার চেষ্টা করি সুন্দর। বেড়াতে আসবেন। কিন্তু গারো পাহাড় নিয়ে দ্বিমত থাকায় আমি কোন গারো পাহাড়ের বাসিন্দা কিনা এই নিয়ে নিজেরও প্রশ্ন জাগে। তবে যতটুকু জানি বা জানার চেষ্টা করেছি শেরপুর জেলার কিছু থানা গারো পাহাড়ের নিকটে পরেছে। যদিও বর্তমানে গারো পাহাড় বলতে শুধু ভারতের মেঘালয় রাজ্য, আসাম এইগুলির গারো খাসিয়াদের বসবাসকৃত পাহাড়িয়া এলাকাকে বোঝানো হয়। হয়তো ময়মনসিংহ গারো পাহাড় কথাটি ভুলবশত কোন একসময় কেউ প্রবর্তন করেছিল না হয় গারোদের বসবাসের কারনে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোকে গারো পাহাড় নামে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু শুনতে খটকা হলেও সত্য যে সত্যিকারের গারো পাহাড় দেখতে হলে আপনাকে ভারত যেতে হবে! কিন্তু এই শেরপুরের নালিতাবাড়ীর সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে আদিবাসী বাঙালি সবাই গারো পাহাড়ের ছায়ায় বড় হয়। মাঝে মাঝে বর্ষায় প্রবল বর্ষণের পর আকাশ থেকে যখন মেঘ কেটে যায় তখন বিকেলের মিষ্টি আলোতে দূর থেকে কৈলাশ পাহাড়ের কালো রেখা দেখা যায়। এখানকার ছোট ছোট সবুজ টিলার ঝোপঝাড় বর্ষায় খুব বেশী সবুজ হয়ে ওঠে।

এইসব টিলাদেশের জনগণ টিলা বেয়ে অভ্যস্ত। কারো ঘরবাড়ি টিলায় সাজানো। আবার কারো কারোর টিলার ঢালে। এমন একটা সময় ছিলো যখন খুব গভীর জঙ্গলের ভেতরেও মানুষ বসবাস করতে শুরু করে দিয়েছিল। ২০০০ সালের পর হঠাৎ বন্যহাতির বিচরণ শুরু হলে মানুষ আবারও বনকে নিঃসঙ্গ বানিয়ে দেয়। দক্ষিণ এলাকার দিকে ভিটাবাড়ি করতে জমি জমা কিনতে শুরু করে।

আর বনের একছত্র রাজা হয়ে উঠে শখানেক হাতির পাল। কিন্তু দিনের বেলাতে যদি একা বেড়াতে যান ভয় পাওয়ার কিছু নেই কারণ বনেজ সম্পদ আহরণ করার প্রয়োজনে গভীর বনেও মানুষের কথা বার্তা, গাছ কাটার আওয়াজ, লাকড়ি টুকানো মানুষের অভাব হবেনা। এখানকার সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো পাহাড়ী বাঙালীর সম্প্রীতি। এইসব এলাকার নির্জনতম স্থানগুলিতে খুব একটা বড় ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়না। এমনকি পাহাড়ে লাকড়ি সংগ্রহ করতে যাওয়া আদিবাসী নারীরাও কোনরকম সমস্যায় পরেনা। এইসব সম্প্রীতির পেছনে এলাকার সবাই যেনো খুবই দায়িত্ববান । ওরা সবাই সবাইকে চিনে। যে শিশুরা বেড়ে উঠছে তারা বাঙালী/আদিবাসী ভেদাভেদকে অগ্রাহ্য করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে খেলছে, স্কুল যাচ্ছে। এখানকার আদিবাসীদের ভাষা অনেক বাঙালীরাই বলতে এবং বুঝতে পারেন। দোকানে কিছু একটা কিনতে গেলে আপনি যেকোন ভাষায় চাইতে পারেন! শীতকালের সময়টা এখানে ভিন্ন। বুরো আমাদের প্রয়োজনে ছোট ছোট পাহাড়ী ঝিরিগুলো আটকে দিয়ে পানি ধরে রাখা হয়। এতে গোটা এলাকার অনেকাংশই বড় বড় লেকে পরিণত হয়। অনেকের ক্ষেত/জমি প্রায় ৪-৫ মাস পানির নীচে থাকলেও অভিযোগ নেই কারোর। কারণ ঐসব উঁচু জমিতে বুরো আবাদ হয়না। এখানকার খোদ এলাকাবাসীরাই নিজেদের সমস্যা জাতিভেদ ভুলে সমাধান করেন। কিন্তু হঠাৎ ছিটেফোঁটা নোংরা নীতি/রাজনীতি মাঝে মাঝে এইসব এলাকার জনগণকে ধাক্কা দিতে আসে। সম্প্রীতির সুতো ছিড়ে দিতে আসে। তাই ইদানিং দুশ্চিন্তা বাড়ছে। শান্তি, সম্প্রীতি, ভালো থাকা, ঐসব অনাগত দিনগুলোতে বীভৎস দানবের পেটে চলে যাবে না তো ?

ছোটবেলার একজন বন্ধুর কথা মাঝে মাঝে খুব মনে পরে। তাঁর নাম ছিলো মোঃ মোস্তাক। ক্লাশ ফোর পর্যন্ত পড়েছিলাম তাঁর সাথে। আমার পাশে  বসতো। একদিন হঠাৎ স্কুলে আসা বন্ধ হয়ে গেলো। কি যেনো একটা রোগে ভোগেছিল সে। তারপর হঠাৎ না ফেরার দেশে। সেদিন মন ভালো ছিলনা। আজও ভালো থাকেনা। শৈশবের অনেক বন্ধুদের সাথে দেখা হয় আড্ডা হয়।

সবুজ টিলার ফাঁকে ফাঁকে বুনে রাখা গল্পগুলিতে ছুঁয়ে দেখা হয়। কিন্তু কিছু জমে থাকা কষ্ট আঙুল কামড়ে দিলেই স্তব্ধ হই কিছুক্ষণ। এখানকার স্বপ্ন খুব ছোট। মানুষেরা দিনান্তে দু'শো টাকা পেলেই সুখী। বনফুলের কড়া ঘ্রাণ নাকে লাগিয়ে ঘুমটা ভাঙে। বাঁশ দিয়ে বানানো দড়জার খিড়কী খুলে উঠোন দর্শনের আগেই পেটের খিদেটা মোচড়িয়ে উঠে। গরীবের জীবনে গরীব পেটের এমনই স্বভাব। বাজারের সবচেয়ে কম দামী চাউলের সর্বশেষ ভোক্তা এদের অনেকেই। সকালটা সব সময়ই এদের কর্মে যাবার তাড়া অথবা কর্ম খোঁজার তাড়ায় ব্যাস্ত। কেউ কেউ কোন ধনাঢ্যের স্থায়ী দিনমজুর। কেউ কাজের আশায় পাশের গ্রামের দোকানটায় গিয়ে বসে। যদি কেউ কামলা খুঁজতে আসে সে আশায়। এদের ভালো করে বাঁচার মানেটা ছোট্ট করে বাঁচা। দুনিয়া মানেই একটি মানুষের পেটের জন্য আধ পোয়া ভাতের চাউল। এদের সবার শৈশব মিশে আছে ছোট ছোট টিলার ভাঁজে। বর্ষায় ভিজে যাওয়া সবুজ ঝোপঝাড়ে। পোড়া কয়লায় মাজা দাত বেড় করা হাসিতে। এই সম্প্রীতি বেঁচে থাকুক। শান্তি আর সুখ, ছায়া হয়ে থাকুক গারো পাহাড়ের মতো।  টিলা দেশ চিরসবুজ হয়ে থাক।