ভালো নেই আদিবাসী শিশুরা

নেংমিঞ্জা বাপন
Published : 4 April 2016, 05:30 PM
Updated : 4 April 2016, 05:30 PM

২০০৭ সালের দিকে পার্বত্য এলাকার একটি দুর্গম গ্রামে গিয়েছিলাম। তখন পার্বত্য এলাকাগুলোতে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক ছিলোনা। একটি আদিবাসী বাড়িতে বসে চা খাচ্ছিলাম। সেই সময়টাতে ঐ গ্রামে বিটিভিও দেখা যায়না। তবে তাঁদের বাড়িতে টেলিভিশ থাকলেও একমাত্র ভরসা ছিলো সিডি প্লেয়ার। বাড়িটির একজন শিশু খেলছিলো। তাঁর মা ঢাকা কোনদিন দেখেননি। তবে মায়ের স্বপ্ন ছেলে শিশুটি একদিন বড় হবে। শহরে পড়াশোনা করতে যাবে। এমন হাজারো আদিবাসীর শিশুরা পাহাড় সমতলে বড় হয় কিছু বড় বড় স্বপ্ন ধারণ করে। এইসব স্বপ্নের শিকড়ে ধারালো ব্লেড ঠেসে ধরে অগোচরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা কিছু বৈষম্য।

প্রাথমিক শিক্ষা সর্বস্তরে বাধ্যতামূলক করা হলেও এটির আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে দুর্গম জনপদের বাসিন্দারা। আবার কিছু এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভাব অনেকের চোখে লাগছেইনা। যেমন ধরা যায় সিলেটের চা বাগান এলাকাগুলিতে প্রাথমিক বিদ্যালয় খুব একটা নেই। সেখানকার তথ্যমতে চা বাগান মালিকেরা বিদ্যালয় স্থাপনে বাঁধাতো দিচ্ছেনই, চা শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা গ্রহণেও বাঁধা দিচ্ছেন! জাতিগোষ্ঠীর পরিচিতকরণে পেশার ছাপ রেখে দেবার এই পায়তারা আদিবাসী শিশুদের বুঝে উঠার আগেই কয়েক পয়সা পাইয়ে শিক্ষা নামক শব্দ থেকে কেটে ছেটে তাঁদের ঝরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

পার্বত্য এলাকার চাইতে যদিও সমতল এলাকার আদিবাসী শিশুরা বেশী পরিমাণে স্কুলগামী হতে পারছে তবুও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বৈষম্যমূলক আচরণ ও পারপার্শ্বিক অবস্থা দেওয়াল হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

প্রায় দুবছর আগে শেরপুর জেলার একটি দুর্গম গ্রামের কথা। কোঁচ জনগোষ্ঠীর দু'জন মেয়ে শিশু প্রায় আড়াই কিলোমিটার হেটে প্রাইমারী স্কুলে যাওয়া আসা করতো। কিন্তু আর বেশীদুর এগুতে পারেনি। পঞ্চম শ্রেণীর পাঠ না চুকাতেই ছেড়ে দিতে হলো পড়াশোনা। এর পেছনে যে ঘটনাটি তা হলো, জংলা পথে একদিন স্কুলে আসার সময় ঐ একই এলাকার কিছু অআদিবাসী বখাটে তাঁদের শ্লীলতাহানির চেষ্টা চালায়। নিরাপত্তাজনিত সমস্যা তো তাঁদের থাকছেই সাথে থাকছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর খামখেয়ালিপনা। উদাহারণ স্বরুপ, বিগত বছরে একজন আদিবাসী শিশু সরকারী স্কুলে যাবেনা এমন কথা তুললে প্রশ্ন করলাম কি কারণে স্কুল বাদ দেওয়া হচ্ছে? শিশুটি জানালো বিদ্যালয়ের শিক্ষক তাঁর ধর্ম নিয়ে এটা ওটা প্রশ্ন করেন। পারলে তাচ্ছিল্যও করে বসেন। কিছু কিছু স্কুল, কলেজে আবার বাংলা ভাষার উচ্চারণগত সমস্যার কারণে অনেকেই আদিবাসী শিশুদের বা শিক্ষার্থীদের অপমানও করেন ! কিন্তু শিক্ষার উপর বিষ ঢেলে দেওয়া কু-উপায়গুলোতে কারোর দৃষ্টি দেবার সময় থাকেনা যদিও, কিন্তু ঠেলেঠুলে কিছু শিশু এগিয়ে আসছে ঠিকই কিন্তু প্রায় বেশিরভাগ শিশুরাই দিনকে দিন বঞ্চিত হয়েই চলেছে।

পাহাড়ে শিক্ষিতরা ঠিকই যাচ্ছেন টাকা কামাতে কিন্তু পাহাড় থেকে শিক্ষিত বেড়ুচ্ছেনা। বরং শিশু নির্যাতনের হার হরহামেশাই বেড়ে চলেছে। মেন্টালি টর্চার হচ্ছে নীরবে আবার অনেক আদিবাসী শিশুই যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। মিডিয়া আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে যাচ্ছে আর আসছে। একের পর এক ডকুমেন্টারি, প্রামান্য চিত্র তৈরি হচ্ছে কিন্তু সুবিধা বঞ্চিত আদিবাসী শিশুদের জীবন মান উন্নয়নে কোন ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছেনা। আমাদের সমস্যা হলো আমাদের যা শুনায়, যা দেখায় সেটিই বিশ্বাস করি। তৃণমূলদের এগিয়ে যাবার কথাগুলি সবার আগে সবার কানে পৌঁছালেও তাঁরা সবার পেছনেই থেকে যাচ্ছে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা থাকলেও সেখানে অবাঙালী শিক্ষক থাকেনা। শিক্ষক নিয়োগে আর শিক্ষাদানে সুবিধাবঞ্চিতদের কথা সবসময় অব্যক্ত থাকে। একে সহজ ভাষায় বৈষম্য না বলে দমিয়ে রাখার কু-কৌশল বললে ভুল হবে কি ?

শিশু শ্রম বন্ধের লক্ষ্যে যেসব আইন করা হয়েছে সেসবের কোন প্রয়োগ নেই। বরং অভিভাবকদের দোষারোপ করেই শিশু শ্রমকে বৈধ্য করে ফেলেছে আমাদের সমাজটা। ইট, বালু পাথর টেনে-তোলে অনেক আদিবাসী শিশুকেই দেখা যায় দিন শেষে কয়েক পয়সা হাতে বাসায় ফিরতে। কিন্তু আদৌ কি কারণে এমন পরিস্থিতে তাঁদের দিনকাল যাচ্ছে সেটা ধামাচাপা দিতে পরিবারকে ফাসানো হচ্ছে। এই মানসিকতা সবারই আছে। শুধু মানসিকতা না দমিয়ে রেখে সুযুগ আদায় করবার বৃটিশ কায়দা রপ্ত করেছি আমরা এই সুবিধার সাগরে ডুবে থাকা মানুষেরা। যাদের পেটে ভাত নেই তাঁদের মাথায় মগজ উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা ছেঁড়া কাথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখার সমান। কিন্তু ছেঁড়া কাথার গল্প লিখে আমরা সুশীল হচ্ছি, লেখক হচ্ছি, রাষ্ট্রযন্ত্র হচ্ছি ঠিকই কিন্তু সংবেদনশীল হয়ে উঠছিনা। দেশে এতদিনে মাত্র কয়েকজন শিশু হত্যা হয়নি, দিনকে দিন হত্যা হচ্ছে বহু শিশুর ভবিষ্যৎ। আদিবাসী শিশুরা ভালো নেই।